গত বছর ডিসেম্বর মাসে একদিন আমার ভাতিজি তাসনিম সুলতানা আভা ফোন করে জিজ্ঞেস করল, আমি ওদের স্কুলে যেতে পারব কি না। ও ধানমন্ডির একটি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? ও জানাল, শিক্ষিকা বলেছেন, ওদের অভিভাবকদের মধ্যে যদি কেউ মুক্তিযোদ্ধা থাকেন বা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন এমন কেউ থাকেন তাহলে তাকে নিয়ে যেতে। তার মুখ থেকে শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস শুনবে। আভা আমার কথা বলায় শিক্ষিকা নিয়ে যেতে বলেছেন। স্কুলের শিক্ষিকার ফোনকল পেয়ে নির্দিষ্ট দিনে যাওয়ার পর আমাকে ব্রিফিং করা হলো, শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রশ্ন করবে আর আমি আমার স্বচক্ষে দেখা অভিজ্ঞতা থেকে জবাব দেব। যথারীতি অনুষ্ঠান শুরু হলো। কিন্তু দেখলাম, শিক্ষার্থীরা শুধু ‘জাতির পিতা’-কেন্দ্রিক প্রশ্ন করছে। আমি কৌশলে ওদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ময়দানে টেনে নিলাম। বললাম, ১৯৭১ সাল ছিল মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্ব। তার আগে ২৪ বছর আমাদের পূর্বপুরুষরা স্বাধীনতার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন। বললাম শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কথা। একাত্তর পর্বে এসে উল্লেখ করলাম বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তারই পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দেওয়ার কথা। দেখলাম ওরা অনেকে জিয়াউর রহমানের নামই শোনেনি। এর কিছুক্ষণ পর ক্লাস টিচার এসে বললেন, ‘স্যার আমাদের আরেকজন বক্তা আছেন। আপনি শেষ করলে তিনি শুরু করবেন।’ আমি ‘তোমরা বড় হলে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে পারবে। তবে সেজন্য বই পড়তে হবে এবং দেশপ্রেমিক নাগরিক হতে হবে’ বলে অধিবেশনের সমাপ্তি টানলাম। লাইব্রেরি কক্ষে এসে দেখি ছোট ভাই বসা। সে জানাল, আমি যে একসময় বিএনপি করতাম এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব ছিলাম, কথা প্রসঙ্গে হেড মিসট্রেসকে সে জানিয়েছে। তখনই বুঝলাম, কেন আমাকে অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করতে বলা হলো।
মূলত ওই অনুষ্ঠানটি ছিল গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন প্রকল্পের অংশ। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানো এবং সে চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেই নেওয়া হয়েছিল ওইসব প্রকল্প। কিন্তু সেই চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া বা বাস্তবায়নের নামে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনষ্ট করে নতুন প্রজন্মকে জানানো হয়েছে অর্ধসত্য, কখনোবা পুরো অসত্য-বিকৃত ইতিহাস। এভাবেই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ‘চেতনা’ শব্দটির ব্যবহার-অপব্যবহার হয়েছে।
তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলটির নেতাকর্মী, সরকারের মন্ত্রী-যন্ত্রীরা কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করার কথা বলতেন। কখনো আবার বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চেতনাকে সমুন্নত রাখারও দৃপ্ত শপথের জানান দিতেন। এসব শুনতে শুনতে মানুষের মনে এই প্রতীতি জন্মেছিল যে, আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি, নেতা-পাতিনেতা, নেতার হাতারা দেশজুড়ে যা করে বেড়াচ্ছিলেন, সেগুলোই বোধকরি মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চেতনা। এজন্য পাবলিককে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কেননা, তারা যা চাক্ষুষ করবে, তাতেই তো বিশ্বাস স্থাপন করবে। অনেক দিন আগের একটি কথা মনে পড়ছে। ১৯৭৪ সাল, আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। দৈনিক বাংলা কিংবা দৈনিক সংবাদে একটি নিবন্ধ পড়েছিলাম। নিবন্ধটির শিরোনাম বা লেখকের নাম মনে নেই। লেখক মন্তব্য করেছিলেন, বর্তমানে (সে সময়) দেশে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই চলছে দেদার। মানুষ খুন হচ্ছে। সরকারি দলের হোমড়াচোমড়ারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনে ব্যস্ত। এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে জনগণ অতিষ্ঠ। অন্যদিকে সরকারের মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতারা প্রতিদিন চেঁচিয়ে বলছেন, দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে। তাদের কথায় জনগণের মনে বিশ্বাস জন্মাতে পারে যে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে বোধহয় দেশে এমন অরাজকতা সৃষ্টি হয়। এ ধারণা জনগণের মনে বদ্ধমূল হয়ে গেলে তারা হয়তো আরও বেশি জোরে চিৎকার করে বলবে—‘এই যদি হয় সমাজতন্ত্রের নমুনা, তাহলে আমরা সমাজতন্ত্র চাই না।’
যত্রতত্র অতি ব্যবহারে যেমন অস্ত্রের ধার কমে যায়, তেমনি কোনো নীতি বা আদর্শের অতি ব্যবহার তার গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা জনবিরক্তির উদ্রেক করে। জনগণ হয়তো ভয়ে কিছু বলতে পারে না, তবে মনে মনে পথ খোঁজে সে উপদ্রব থেকে নিষ্কৃতির। অলৌকিক কিংবা লৌকিকভাবে যখন সে মুক্তির দুয়ার খুলে যায়, মানুষ তখন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। যেমনটি হয়েছে এ বছরের ৫ আগস্টের পর। গত মুদ্দতে আওয়ামী লীগের লোকজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা এত বেশি প্রচার করেছে যে, মানুষ তা শুনতে শুনতে চেতনা হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়েছিল। তার ওপর যারা সে চেতনার কথা বলত, তাদের কথার সঙ্গে কর্মের কোনো মিল ছিল না। আমাদের মহান স্বাধীনতার লক্ষ্য বা আদর্শ ছিল একটি শোষণ-বৈষম্যহীন সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলা। আর তা করতে হলে দরকার ছিল যারা দেশ পরিচালনা করবেন, তাদের সৎ ও দেশপ্রেমিক হওয়া। আর দেশপ্রেমিক হতে হলে একজন মানুষকে, তা তিনি রাজনীতিক হোন বা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা বা কর্মচারী, তাকে শতভাগ সৎ হতে হয়। এই সততা শুধু মৌখিক নয়, হতে হবে মৌলিক।
কিন্তু গত দেড় দশকে আমরা কী দেখেছি। ক্ষমতাসীন দলটির নেতাকর্মী কিংবা সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে সততার ছিটেফোঁটাও কি ছিল? বরং অসততা কত প্রকার ও কী কী সেটা তারা উদাহরণ সহকারে দেশবাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সরকারি বড় বড় প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে টাকার পর্বত তৈরি, তা থেকে আবার সিংহভাগ বিদেশে পাচার, ব্যাংকের টাকা দেদার লোপাট, শেয়ার মার্কেটে হরিলুট, সরকারি কাজের টেন্ডার ভাগবাটোয়ারা, দেশব্যাপী দখল-চাঁদাবাজির মচ্ছব ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশকে পরিণত করা হয়েছিল দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে। যারা এসব অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন তারা নিজেদের পরিচয় দিতেন ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ হিসেবে। প্রশ্ন হলো, এসব কি ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর চেতনা’?
গত সাড়ে ১৫ বছর নিজেদের ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে তার আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের বুলি আওড়ে যারা রাষ্ট্রীয় অর্থ সম্পদ লোপাট করেছে, তাদের পরিচয় কিন্তু আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই প্রকাশ করে গেছেন। সে সময় দেশব্যাপী ব্যাপক দুর্নীতি-লুটপাট প্রত্যক্ষ করে তিতিবিরক্ত হয়ে বিভিন্ন বক্তৃতা-ভাষণে যেসব উক্তি করেছিলেন, তার দু-চারটি এখনো সামাজিকমাধ্যমে ঘুরে বেড়ায়। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমার গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য সারা দুনিয়া থেকে ভিক্ষা কইরা আনি, আর চাটার দলের চাটারা সব চাইট্টা খায়া ফালায়।’ আরও বলেছিলেন, ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য সাড়ে নয় কোটি কম্বল আইল, আমারটা পাইলাম না। চোরের দল আমার কম্বলটাও বেইচ্চা খাইছে।’ আক্ষেপ করে তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষ পায় সোনার খনি আর আমি পাইছি চোরের খনি। পাকিস্তানিরা সবকিছু ধ্বংস কইরা দিয়া গেছে, রাইখা গেছে কতগুলি চোর। এই চোরগুলারে নিয়া গেলে বাঁচতাম।’ শেখ মুজিবুর রহমানের ওই খেদোক্তি প্রমাণ করে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ক্ষমতাসীন দলটির নেতাকর্মী ও প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কী রকম দুর্নীতি-লুটপাটে লিপ্ত ছিল। শেখ মুজিব যে চাটার দলের কথা বলেছিলেন, গত ৫০ বছরে তার পরিধি কমেনি বরং বহুগুণ বেড়েছে। সেই বর্ধিত চাটার দলের সদস্যরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জিগির তুলে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছে। এজন্য তারা আশ্রয় নিয়েছে নানারকম ফন্দি-ফিকিরের।
‘চেতনা’ বাস্তবায়নের নামে রাষ্ট্রীয় তহবিলের হরিলুটের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে গত ২ অক্টোবর কালবেলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। ‘চেতনা বাস্তবায়নের নামে ৩ বছরে ব্যয় ২শ কোটি’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সাত বছরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় অন্তত ১০টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যা টাকার অঙ্কে ছাড়িয়েছে ৫ হাজার কোটিরও বেশি। এর মধ্যে গত তিন বছরে নানা প্রকল্প দেখিয়ে ১৭৯ কোটি টাকা সরাসরি খরচ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের নামে। এসব খরচ করা হয়েছে সভা-সেমিনার, স্কুল-কলেজ পরিদর্শন, টিভিসি চলচ্চিত্র নির্মাণ, পত্রিকা টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন ইত্যাদি বাবদ। নিবন্ধের শুরুতে যে ঘটনার কথা উল্লেখ করেছি, সেটাও বোধহয় চেতনা-জাগানিয়া প্রকল্পের অংশ ছিল। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সে সময়ে সভা-সেমিনার-পরিদর্শন বাবদ খরচ করা হয়েছে শতকোটি টাকা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, যেহেতু ৫০ কোটি টাকার ওপরে প্রকল্প হলে একনেক সভার অনুমোদন লাগে, তাই এসব প্রকল্প ৫০ কোটির নিচে রাখা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নামে। রাষ্ট্রীয় তহবিলের এমন তছরুপ নজিরবিহীন।
জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্বন্ধে নতুন প্রজন্মকে সচেতন করে তোলার গুরুত্বের কথা অস্বীকার করা যাবে না। কেননা, ওরা যদি দেশ ও জাতির ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক অবগত হতে না পারে, তাহলে ওদের ভেতর দেশাত্মবোধ জন্ম নেবে না, দেশপ্রেমিক সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না। আর সেজন্য প্রয়োজন জাতির সঠিক ইতিহাস ওদের সামনে তুলে ধরা, বিকৃত বা অর্ধসত্য ইতিহাস নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস লিখতে গেলে মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ কিংবা জিয়াউর রহমানকে বাদ দেওয়া যাবে না। তাদের বাদ দিয়ে বা এড়িয়ে গিয়ে ইতিহাস লিখলে তা হবে বিকলাঙ্গ ইতিহাস। অথচ বিগত বছরগুলোতে তা-ই করা হয়েছে।
লক্ষণীয়, নতুন প্রজন্মের মনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গেঁথে দেওয়ার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ চেতনা বিপণনের কর্মসূচি নিয়েছিল। কিন্তু তারা কি সফল হয়েছে? যদি হতো, তাহলে ৫ আগস্টের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পর সেই নবপ্রজন্ম কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল কিংবা স্ট্যাচুকে অবমাননা করতে দেখা যেত না। কেউ কেউ বলেন, আওয়ামী লীগ আসলে বঙ্গবন্ধুর চেতনা বিকাশ করতে গিয়ে তার বিনাশ সাধন করেছে। অপরিমিতিবোধ ও অপরিণামদর্শী কর্মের ফল এর চেয়ে ভালো হয় বলে মনে হয় না।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক