সনাতন ধর্মশাস্ত্রে ‘দুর্গা’ নামটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, ‘উ-কার’ বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়, শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। বিপদনাশিনী দেবীমাতা দুর্গা। দুর্গতি থেকে ত্রাণ করেন বলেই দেবীর নাম হয়েছে দুর্গা। এ ছাড়া মহিষমর্দিনী, শূলিনী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারি, বাহারী, চণ্ডী, লক্ষ্মী, উমা, হৈমবতী, কমলা, শিবাণী, যোগনিদ্রা প্রভৃতি নামে ও রূপে মায়ের পূজা হয়ে থাকে।
শ্রীচণ্ডী মতে, দুর্গাদেবী ‘নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ’ বা সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি। অর্থাৎ মহাদেবের তেজে মুখ, যমের তেজে চুল, বিষ্ণুর তেজে বাহু, চন্দ্রের তেজে স্তন, ইন্দ্রের তেজে কটিদেশ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পায়ের আঙুল, বসুদের তেজে হাতের আঙুল, কুবেরের তেজে নাসিকা, প্রজাপতির তেজে দাঁত, অগ্নির তেজে ত্রিনয়ন, সন্ধ্যার তেজে ভ্রু, বায়ুর তেজে কান এবং অন্যান্য দেবতার তেজে শিবারূপী দুর্গার সৃষ্টি হয়। এরপর দেবতারা তাকে বস্ত্র ও অস্ত্র দান করেন। মহাদেব দেন শূল, বিষ্ণু দেন চক্র, বরুণ দেন শঙ্খ, অগ্নি দেন শক্তি, বায়ু দেন ধনু ও বাণপূর্ণ তূণীর, ইন্দ্র দেন বজ্র, ঐরাবত দেন ঘণ্টা, যম দেন কালদণ্ড, বরুণ দেন পাশ, ব্রহ্মা দেন অক্ষমালা ও কমণ্ডলু, সূর্য দেন রশ্মি, কালখড়্গ ও নির্মল চর্ম, ক্ষিরোদ সাগর দেন অক্ষয়বস্ত্রসহ বিভিন্ন অলংকার ও আভরণ, বিশ্বকর্মা দেন পরশুসহ নানাবিধ অস্ত্র, অভেদ্য কবচমালা, হিমালয় দেন সিংহ, কুবের দেন অমৃতের পানপাত্র, শেষ নাগ দেন নাগহার ও অন্যান্য দেবতা তাদের সাধ্যমতো জিনিস উপহার দেন।
দুর্গাপূজার বিধিসম্মত সময়কাল হলো চৈত্র মাস; যে পূজা বাসন্তীপূজা নামে পরিচিত। পুরাণে উল্লেখ আছে, রাজা সুরথ ও বণিক সমাধি বৈশ্য দুর্গাপূজা করেছিলেন মেধস মুনির আশ্রমে বসন্তকালেই। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ গ্রন্থে রয়েছে, রাজা সুরথ চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী ও নবমী তিথিতে শাস্ত্রবিধিমতে দেবী দুর্গতিনাশিনীর (পার্বতী) পূজা করেছিলেন। বসন্তকাল উত্তরায়ণের অন্তর্গত। উত্তরায়ণে দেবতারা জাগ্রত থাকেন বলে বাসন্তীপূজায় বোধনের প্রয়োজন হয় না।
শরৎকালে অনুষ্ঠিত হয় শারদীয় উৎসব দুর্গাপূজা। কেউ কেউ আবার দুর্গাপূজাকে অকালবোধন বলেও উল্লেখ করেন। রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্র শরৎকালে অর্থাৎ অকালে সীতাকে উদ্ধার এবং রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করার জন্য দেবী দুর্গার পূজা করে শক্তি অর্জন করেছিলেন। তাই এ পূজাকে অকালবোধন বলা হয়ে থাকে। সংস্কৃত ‘অকাল’ ও ‘বোধন’ শব্দ দুটি বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ‘অকাল’ শব্দের অর্থ ‘অসময়, শুভকর্মের অযোগ্য কাল বা অনুপযুক্ত কাল’। অন্যদিকে ‘বোধন’ শব্দটির অর্থ ‘উদ্বোধন, নিদ্রাভঙ্গকরণ বা জাগ্রত করা’। ‘অকালবোধন’ শব্দটির অর্থ ‘অসময়ে বোধন বা জাগরণ’ (হিন্দু সংস্কারে) ‘অসময়ে দেবী দুর্গার আরাধনা’। এই প্রসঙ্গে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস লিখেছেন, যে সময় (শ্রাবণ থেকে পৌষ) দুর্গাপূজা হয়, তখন সূর্যের গতি দক্ষিণ দিক দিয়ে হয়। এই ছয় মাস দক্ষিণায়ন। অপর ছয় মাস (মাঘ থেকে আষাঢ়) উত্তরায়ণ। উত্তরায়ণ দেবতাদের দিন এবং দক্ষিণায়ন রাত্রি। রাত্রিকালে দেবীদুর্গা (পার্বতী) নিদ্রিত থাকেন বলে তার বোধন করে পূজা করতে হয়। সাধারণত ষষ্ঠীতেই বোধন শুরু হয়।
কালিকাপুরাণ অনুসারে, ব্রহ্মরাত্রিতে দেবীর বোধন করেছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। দেবতার অর্চনার পক্ষে রাত্রি নিশ্চয় অকাল। প্রচলিত বিশ্বাস এই যে, দেবীর পূজার শ্রেষ্ঠ সময় হচ্ছে বসন্তকাল। চৈত্রমাসের শুক্লাষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত দেবীর বাসন্তী পূজার রীতি প্রচলিত ছিল সমাজে। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, দুর্গাপূজা বৈদিক রুদ্রযজ্ঞের আধুনিক সংস্করণ। রুদ্রযজ্ঞের অগ্নিই দুর্গা। শাস্ত্র অনুসারে, ছয় মাস উত্তরায়ণ দেবতাদের একদিন ও ছয়মাস দক্ষিণায়ন দেবতাদের একরাত্রি। উত্তরায়ণ শুরু হলে বিষ্ণুর উত্থান, সে সময় উত্থান একাদশী হয়। দেবগণ রাতে ঘুমিয়ে থাকেন দিনে অর্থাৎ উত্তরায়ণে জাগেন। উত্তরায়ণ তাই যজ্ঞাদি অনুষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ সময়। বিষ্ণুশক্তি বিষ্ণুমায়া দুর্গাও রাতে ঘুমিয়ে থাকেন। তাই দক্ষিণায়নকালে শরতে দেবীর উদ্বোধন বা জাগরণ অকালবোধনই।
অকালবোধন হলো শারদীয়া দুর্গাপূজার শুরুর অনুষ্ঠান। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথি অথবা শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে দেবী পার্বতীর দুর্গা রূপের পূজার শুরুতে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, শরৎকাল দেবলোকের রাত্রি দক্ষিণায়নের অন্তর্গত। তাই এ সময় দেবদেবীর পূজা করতে হলে, আগে দেবদেবীদের বোধন অর্থাৎ জাগ্রত করতে হয়। একাধিক পুরাণ ও অন্যান্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত আছে, রাবণ বধের আগে রামচন্দ্র দেবী পার্বতীর কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে বিল্ববৃক্ষতলে বোধনপূর্বক দুর্গাপূজা করেছিলেন। শরৎকাল দেবদেবীর পূজার ‘শুদ্ধ সময়’ নয় বলে রামচন্দ্র কর্তৃক দেবী পার্বতীর বোধন ‘অকালবোধন’ নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, শাস্ত্রমতে, বসন্তকাল দুর্গাপূজার সময় হলেও আধুনিককালে শারদীয়া দুর্গাপূজাই সর্বাধিক প্রচলিত। রাবণ বসন্তকালে চৈত্র মাসে দেবী পার্বতীকে পূজা করে সন্তুষ্ট করলে দেবী তাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু যদি সে দেবীর পূজার মন্ত্রে শ্রীচণ্ডীতে কোনো রূপ ত্রুটি করে, তবে দেবী তাকে ত্যাগ করবেন। এই কারণে রামচন্দ্রের সব অস্ত্র রাবণের ওপর বিফল হয়। তখন ব্রহ্মা রামচন্দ্রকে দেবী পার্বতীর পূজা করতে বলেন। কারণ দেবী এই সময় মর্ত্যে তার বাবা-মার ঘরে আসেন। রামচন্দ্র দেবী পার্বতীর পূজা করলে দেবী কর্তৃক তার উদ্দেশ্যে আনা একটি পদ্ম তিনি হরণ করেন। তখন রামচন্দ্র নিজের চোখ দেবীকে অঞ্জলি দিতে উদ্যত হলে দেবী পার্বতী তাকে বিরত করেন ও বর প্রদান করেন। তারপর হনুমান দশমী তিথিতে রাবণ কল্যাণে শ্রীচণ্ডী পাঠরত বৃহস্পতিকে অজ্ঞান করে শ্রীচণ্ডী অশুদ্ধ করলে রাবণকে ত্যাগ করেন দেবী। রাবণ দেখে দেবী তাকে ত্যাগ করে কৈলাসে চলে যাচ্ছেন। রাবণের শত মিনতি করার পরও দেবী পার্বতী আর ফিরে তাকান না। তারপর রামচন্দ্র রাবণকে বধ করেন। বর্তমানে দেবীর অকালবোধন রূপটিরই পূজা হয়ে থাকে।
আশ্বিনের শুক্লাষষ্ঠী থেকে শুক্লানবমী পর্যন্ত দেবী দুর্গার পূজা হয়ে থাকে। দেবীর সঙ্গে যুক্ত হয় আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্যাবিজ্ঞানদায়িনী দেবী সরস্বতী, সর্বৈশ্বর্য প্রদায়িনী দেবীলক্ষ্মী, সর্বসিদ্ধিদাতা গণেশ, বলরূপী কার্তিক এবং ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন ত্যাগ ও বৈরাগ্যের মূর্তবিগ্রহ দেবাদিদেব মহাদেব। এ যেন একই সঙ্গে শক্তি, জ্ঞান, ঐশ্বর্য, সিদ্ধি, বল ও বৈরাগ্যের এক অপূর্ব সমাবেশ।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ