যে কোনো সংকট-বিপর্যয়ে অতীতে যেমন ছিল, ঠিক তেমনই বর্তমানে রাষ্ট্র ও সমাজের যে কোনো বেইনসাফির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নজরুলের সৃষ্টিকর্ম এখনো আমাদের প্রেরণা। আমাদের গৌরবের একাত্তর ও নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর এবারের ২০২৪-এর রক্তাক্ত ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবে যে কবি আবারও তার কবিতায়, গানে, কণ্ঠে আর দেয়ালের গ্রাফিতি ও লিখনে প্রাসঙ্গিক হয়ে এই জাতির সঙ্গে নিজের অপরিহার্য অস্তিত্বের জানান দিলেন তিনি নজরুল আর সেটা তিনি বহু আগেই বলে গেছেন—
‘আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলে শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কুলে যে সমাজে যে ধর্মে যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি না সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’
তিনি সারা দুনিয়ার জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের কবি। অসাম্যের বিরুদ্ধে সাম্যের কবি। মূলত নজরুলের চেতনাই স্বাধীন বাংলাদেশের চেতনা। ফ্যাসিবাদী শাসনের গত ১৬ বছর এই চেতনার দ্বার রুদ্ধ করে জাতিকে বিভক্ত করে ভুলপথে চালিত করা হয়েছিল। ফ্যাসিস্টরা ভুল চেতনার বয়ান তৈরি করে ‘চেতনা’ শব্দটিকেই কলঙ্কিত করেছে। জুলাইয়ের নববিপ্লবে বাংলাদেশ ফিরে পেয়েছে তার কাঙ্ক্ষিত গতিপথ। এই নজরুলকে আমরা আবার আমাদের করে পেয়েছি। তার চেতনায় জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। জাতির এই ঐক্য ধরে রাখার জন্য নজরুল চর্চার কোনো বিকল্প নেই।
১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে নজরুল ইনস্টিটিউট এই মহান কবির জীবন ও তার সৃষ্টি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। নজরুল রচনা, স্বরলিপি গ্রন্থ, নিজস্ব পত্রিকা, স্মারক গ্রন্থ, গবেষণা গ্রন্থ ও বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদসহ এ পর্যন্ত মোট প্রকাশনার সংখ্যা ৪৩৭টি। এ ছাড়া রয়েছে অডিও ক্যাসেট, সিডি, তথ্যচিত্র, পোস্টারসহ কবি নজরুলবিষয়ক তথ্যের বিশাল ভান্ডার। সঙ্গে রয়েছে একটা দারুণ সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। আমি এখানে যোগদানের পর বিস্মিত হয়েছি এটা দেখে যে, এই বিপুল তথ্যভান্ডার বছরের পর বছর প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে পড়ে রয়েছে। ঢাকা শহরের মানুষ জার্মান কবির নামে প্রতিষ্ঠিত গ্যেটে ইনস্টিটিউটকে অথবা ছায়ানটকে যেভাবে চেনে, সেভাবে নজরুল ইনস্টিটিউটকে চেনে না। এর একটাই কারণ, নজরুলকে যেভাবে প্রমোট করা বলি অথবা ব্র্যান্ডিং করা বলি অথবা প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া বলি—এর কোনোটাই ভালোমতো করা হয়নি। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে আমি আমার পরিকল্পনা সাজিয়েছি।
১. সংবিধানে জাতীয় ফুল, পাখি, প্রাণী, বৃক্ষ, মাছ, খেলা, ফল, বন, নদী ইত্যাদি থাকলেও আমাদের জাতীয় কবির নামটা এখনো সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আমাদের চেতনার বাতিঘর কবি নজরুলকে প্রত্যক্ষভাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে এবং জাতীয় কবির গেজেট অতি দ্রুত প্রণয়ন করতে হবে।
২. স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেণিতে এবং সিলেবাসে গুরুত্বের সঙ্গে নজরুলের রচনা ও দর্শনকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর পক্ষে কবি নজরুল ইনস্টিটিউট দাবি তুলবে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে উদ্যোগী হয়ে আলোচনা করবে।
৩. নজরুল ইনস্টিটিউটকে গণমুখী করার লক্ষ্যে বাংলা একাডেমির মতো সর্বসাধারণকে ইনস্টিটিউটের সদস্য হওয়ার সুযোগ তৈরি করা হবে এবং সদস্যদের অংশগ্রহণে নিয়মিত সভার আয়োজন করা হবে।
৪. নজরুল সাহিত্যকর্ম ও সমসাময়িক বিশ্বে স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে নজরুলের চিন্তাধারার প্রাসঙ্গিকতা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ ও গবেষণার জন্য বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ‘নজরুল সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার মতো দ্বিপক্ষীয় এবং সাংস্কৃতিক সহযোগিতার সম্পর্ককে সুদৃঢ় করতে কাজ করবে।
৫. বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার নজরুল ইনস্টিটিউট নামটি পরিবর্তন করে ‘কবি নজরুল ইনস্টিটিউট’ করেছে, যা যথাযথ হয়নি। তিনি তো শুধু কবি নন, তিনি আমাদের ‘জাতীয় কবি’! ইনস্টিটিউটের নামটি ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউট’ করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
৬. নজরুল ইনস্টিটিউটের জন্য যুগোপযোগী অর্গানোগ্রাম তৈরি করা হবে এবং ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিকে পেনশনযোগ্য করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
৭. নজরুল-স্মৃতিবিজড়িত সব স্থান ও স্থাপনা অবিকৃত আকারে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
৮. গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন ধানমন্ডি লেকে ‘নজরুল সরোবর’ নির্মাণের ব্যাপারে সিটি করপোরেশন যে জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে, সেখানে দ্রুততার সঙ্গে কাজ শুরু করার বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।
৯. নজরুলের সব সৃষ্টি ইংরেজি, আরবি, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশসহ পৃথিবীর প্রধান প্রধান ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করা হবে। এরই মধ্যে নজরুল সমগ্র ইংরেজিতে অনুবাদের কাজ শুরু হয়েছে।
১০. বিদেশে বাংলাদেশের সব মিশনে নজরুল কর্নার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
১১. এবারের ছাত্র-জনতার বিপ্লবে আবারও প্রমাণ হয়েছে নজরুল এ জাতির জীবনে কী ভীষণ প্রাসঙ্গিক। দেশজুড়ে দেয়ালের গ্রাফিতি রেখেছে তার নিদর্শন। আমাদের কাজ হবে এই নজরুল চেতনায় জাতীয় ঐক্যকে অটুট রাখার জন্য প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ তথা বিভিন্ন কর্মসূচি তৈরি করা।
(ক) জাতীয় কবির প্রকাশনাসমূহ তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য বিভাগীয় শহরে ‘নজরুল কর্নার’ স্থাপন করে প্রকাশনা বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা। সেই লক্ষ্যে এরই মধ্যে আমরা সাতটি বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারদের কাছে চিঠি প্রেরণ করেছি।
(খ) দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় কবি নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত প্রকাশনাসমূহ বিক্রয় বৃদ্ধির জন্য জেলা প্রশাসক/উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর পত্র প্রেরণ করা।
(গ) এই সময়ে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরতে সমকালীন ইস্যুর সঙ্গে নজরুল চেতনাকে মিলিয়ে দেশব্যাপী বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সভার আয়োজনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় ‘২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আমাদের নজরুল’ শীর্ষক জাতীয় রচনা প্রতিযোগিতা শুরু করেছি।
(ঘ) নতুন প্রজন্মের মধ্যে নজরুল সংগীতের আবেদন তৈরি করার জন্য ‘নজরুল কনসার্ট’ আয়োজনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।
১২. তথ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় একটি আন্তর্জাতিকমানের নজরুল বায়োপিক নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
১৩. নজরুলের সব সৃষ্টিকর্ম একটি ওয়েবসাইটে নিয়ে আসতে হবে, যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা এখনো করা হয়নি। যেটা হবে ‘নজরুল ডিজিটাল আর্কাইভ’, যেটা ই-বুক আকারে পাওয়া যাবে।
১৪. বিশিষ্ট নজরুলসংগীত শিল্পী ও আবৃত্তি শিল্পীদের মাধ্যমে দেশব্যাপী নিয়মিতভাবে নজরুলসংগীত ও নজরুলের কবিতা আবৃত্তির প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।
১৫. নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপনের জন্য বরিশাল ও মানিকগঞ্জে স্থাপত্য নকশা প্রণয়ন করে জমির সার্ভে নকশা স্থাপত্য অধিদপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে।
১৬. ঢাকা বেড়াতে এলে কবি রমনা পার্কে আসতেন, রমনা পার্ক তার একটি প্রিয় জায়গা ছিল। তার একটি রম্য গানে রমনা পার্কের কথা উল্লেখ আছে এভাবে—
“আরে (তুমি) ইতি উচি চাও বৃথাই, আমি কমুনা, কোথায় তোমার যমুনা।
কইলকাতা আর ঢাকা রমনার লেকে পাবে তার নমুনা”।
নজরুল-বন্ধু ড. কাজী মোতাহার হোসেন নজরুলের ভাষ্যেই রমনা লেকের যাওয়ার স্মৃতিচারণ করেছেন এবং কবির বন্ধু আবদুল কাদির লিখেছেন নজরুল তাকে নিয়ে রমনা লেকের ধারে বেড়াতে গিয়েছিলেন এবং সেখানে বসে তার একটি বিখ্যাত গজল ‘নিশি ভোর হল জাগিয়া’ রচনা করেছিলেন। নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত এই রমনা লেকের নামকরণ ‘নজরুল লেক’ বা ‘নজরুল সরোবর’ করা ও একটি নজরুল মঞ্চ তৈরি করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আমরা চিঠি দিয়েছি।
১৭. নজরুলবিষয়ক অনুষ্ঠান আয়োজন ও মহড়ার জন্য ইনস্টিটিউট বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে অডিটোরিয়াম বা প্রয়োজনীয় কক্ষ বরাদ্দ প্রদান করবে।
১৮. নজরুল ইনস্টিটিউট লাইব্রেরি রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হবে এবং লাইব্রেরির সদস্যপদ তৈরি করে লাইব্রেরি ব্যবহারের পর্যাপ্ত সুযোগ নিশ্চিত করা হবে।
১৯. প্রতিটি জাতীয় অনুষ্ঠানে জাতীয় কবিকে যথাযথভাবে তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
আমার প্রধান লক্ষ্য কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভৌগোলিক সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বজনীন করার কাজকে বেগবান করা। নজরুল আমাদের উন্মেষে, রাষ্ট্রের নির্মাণে, মাটি ও মানুষের মুক্তির সংগ্রামে ও আকাঙ্ক্ষায়, তারুণ্যের উদ্দীপনায়, সংকটে, আনন্দে-বেদনায়, প্রেমে, সবসময় প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন এবং থাকবেন। আমাদের তারুণ্যের বেড়ে ওঠার জন্য কবির চব্বিশ বছরের সব সৃষ্টি সম্ভার যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে। সাম্য, মৈত্রী, বিশ্বাস আর ইনসাফের সমাজ নির্মাণের জন্য আমাদের বারবার নদীর মতো নজরুলের কাছেই ফিরে আসতে হবে। কারণ নজরুল হলেন সেই মহাসমুদ্র, যেখানে সব নদী এসে মিশে যায়।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট