গাল্পিক কেবলই বলেছেন, এক ভদ্রলোক দুই বিয়ে করেছেন। অমনি শ্রোতা প্রতিক্রিয়া দিলেন, শুনতে হবে না। কোনো ভদ্রলোক দুই বিয়ে করেন না। অতএব, চরিত্রের নৈতিকতা হারানোর ফলে আবেদন ফুরিয়ে গেছে গল্পটির। অতি সতর্কতার সঙ্গে গাল্পিক দ্বিতীয় গল্প শুরু করলেন। মাঝামাঝি পর্যায়ে বললেন, বরাবরের মতো প্রহসন সফল হলে তিনিই হতেন মহানায়ক। অনুসারীদের কুকর্ম যদি ফাঁস না হতো, তবে তো সবকিছুই রূপকথার মতো মানুষের মুখে মুখে ঘুরত। শ্রোতা আবারও বাগড়া দিলেন। যদির কথা নদীতে ফেলেন। দাদা যদি না মারা যেতেন, এখনো বেঁচে থাকতেন। এ ধরনের গল্পে আবেগ থাকে। তবে, ব্যস্ত শ্রোতা মন বসাতে পারেন না। কোনো অর্থ খুঁজে পান না। শ্রোতা আরও বলেন, আপনার গল্প বলার কথা। কিন্তু ফাঁকে ফাঁকে আপনি মন্তব্য করছেন। গল্পে দর্শন থাকতে পারে। সেটা বাড়তি লাভ। কিন্তু বেশি হলে গল্প ধর্ষিত হয়। সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। কথক বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনি চুপ থাকুন। আপনি শ্রোতা। অথচ সব বিষয়েই আপনি বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন। এটাই বাকস্বাধীনতার সুফল বলে কাঁধ ঝাঁকায় মুক্ত শ্রোতা। শুধু বললে হবে না। দায়িত্বশীল হতে হবে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। কথাগুলো পুরোনো, ক্লিশে। কিন্তু দরকারি। রাজদরবার থেকে তরকারি কেনায় গলদঘর্ম লোকটিও ভুক্তভোগী। ব্যথায় জর্জরিত আমজনতার মুখে কথার ফুলঝুড়ি। কোনো কথাই কেউ মাটিতে পড়তে দিচ্ছেন না। ছোঁ মেরে লুফে নিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন মুখোমুখি। এক উৎকট উপস্থিতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। হাটে-মাঠে-ঘাটে-অফিস-আদালতেও কম যায় না। কথা বলাই যেন এখন জরুরি কাজ। কতকাল যেন বলতে পারেনি এ জনপদের মানুষ। কথা বলার অপরাধে মামলা-হামলা-গুমের ভয় উঠে গেছে। এমনকি, বাকস্বাধীনতা হরণকারীর সমর্থকও উসকানিমূলক কথা চালাচালি করছে। দ্বিতীয় স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। তবে এর চেয়েও বেশি মানুষ উদয়াস্ত খেটে মরছে বেঁচে থাকার অমোঘ নিয়মে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে ঝুঁকি নিচ্ছে পরিবারের জন্য। নীরবে সচল রাখছে দেশের অর্থ আর নীতি। নিজেরটা নিজেকেই করে খেতে হবে। ‘অত কথায় কাজ নেই’—আপ্ত বাক্যটিই তাদের জীবনের মূলমন্ত্র। অথচ দিন-রাত তাদের কথা বলে বলে করে কেটে খাচ্ছে কিছু লোক। এর মধ্যে রয়েছে রাজনীতিবিদ, আমলা, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ অনেক পেশাজীবী। নিজেদের কাজ ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনাসহ তাবৎ বিষয়ে তাদের আগ্রহ। এমনকি ক্রস কানেকশনও হয় তাদের মধ্যে। যেমন, সাংবাদিককে গণমাধ্যম শেখাতে চায় আমলা বা রাজনীতিবিদ। আবার, উল্টোটাও দেখা যায়।
সম্প্রতি ‘রিসেট বাটন’ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সমালোচনা করেছেন অনেকে। তাদের মধ্যে রয়েছেন পতিত সরকারের পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাজানো সংবাদ মাহফিলের নিয়মিত পারফরমাররা। যোগ দিয়েছেন ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী সিনেপাড়ার শিল্পীরা। ইউনূস সাহেবকে নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক নানা ট্রল করেছেন। এই ছন্নছাড়া এতিমদের কোনো কোনো রসিকতা আবার আত্মঘাতীমূলক। অবশ্য, অভিনয়শিল্পে বলা হয়; লজ্জা-শরম-ভয়, এই তিন থাকতে নয়। সত্যি সেলুকাস! বিচিত্র এই দেশ, বিচিত্র এই দেশের মানুষ। দুদিন আগেও ভয়ে জড়োসড়ো ছিলেন সমালোচনাকারীরা। এখন তারাই জোরেশোরে ক্ষোভ জানাচ্ছেন দ্রুত সমস্যা সমাধানে। অথচ, ড. ইউনূসের সম্বল মাত্র অনভিজ্ঞ অল্পসংখ্যক উপদেষ্টা, অবসর থেকে ফেরা কয়েকজন চুক্তিভিত্তিক ও দীর্ঘ বঞ্চিত শত শত ক্ষুব্ধ আমলা। বৈষ্যমের শিকার হওয়ায় তারা আবার দক্ষ-যোগ্য হয়ে ওঠার সুযোগ পাননি। এ ছাড়া, রয়েছেন হাসিনা রেজিমের বিশ্বস্ত প্রভাবশালী দায়িত্বশীলরা। যাদের কাজই ছিল আগে প্রধানমন্ত্রী তোষণ আর বিরোধীদের ষড়যন্ত্র সন্ধান। দেড় দশকের অভ্যাসবশত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে তাদের আবার অকৃতজ্ঞও বলা যাবে না। এসব জোড়াতালি দিয়ে চলছে ইউনূস সরকার। যে কারণে তালির চেয়ে গালির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সহযোগিতা আদায়ের ক্ষেত্রে বিশ্ব দরবারে বহুল সমাদৃত ইডনূসকে ঠেকানো প্রায় অসম্ভব। এরই মধ্যে বিষয়টি ভারত ও ভারতপন্থিরা বুঝতে পেরে নতুন নতুন তরিকা বাতলে দিচ্ছে। অতীতের অনাচার, স্বৈরাচার ও অর্থ পাচারের মতো বিষয়গুলো জনগণ আর দেখতে চায় না। রিসেট বাটনে চাপ দিয়ে জাতি সামনের দিকে এগোতে চায়। এ সাধারণ কথাটি অতীতের মতোই তথাকথিত সুযোগসন্ধানী বুদ্ধিজীবী ও নিরীহ আঁতেলরা ফেনায়িত করছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের গত দেড় দশকেও তারা তাই করেছে। চাপে থাকা সক্ষমতা হারানো লোকগুলো এর মধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধ ঢুকিয়ে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে পুজো দিতে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে তার আদর্শ কুঁজো করে ফেলেছে। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে গণতন্ত্রহীন দেশের সার্বভৌমত্ব কাঁটাতারে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। গণধিকৃত ছিবড়ে লোকগুলো নানা অজুহাতে রস আস্বাদনের চেষ্টা করবে। এজন্য মুরুব্বিকে কথা বলার ক্ষেত্রে সদা সতর্ক থাকবে। ষড়যন্ত্রের ব্যবহার করে কোনো ষড়যন্ত্রীই যেন উঁহুঁ উঁহুঁ করতে না পারে। সমালোচনাকে আহ্বান জানিয়েছে বর্তমান সরকার। সেজন্য আকথা-কুকথার এজেন্ডায় ব্যস্ত পরাজিত শক্তিকে দমনপীড়ন করা যাবে না। বরং, সাবধানতা অবলম্বন করে হুঁশিয়ার থাকতে হবে।
দ্রুত নির্বাচন ও নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত রাজনৈতিক দলগুলো। এ ব্যাপারে রাজপথ, সভা-সেমিনার ও বিভিন্ন ধরনের বৈঠকে সোচ্চার তারা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটি খুবই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক চাওয়া। মাঝেমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। এতে দেশের প্রধান দল বিএনপি নির্বাচনী রোডম্যাপের প্রতি জোর দিয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সংস্কার কমিটি গঠনের সমালোচনা করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া গঠন করা কমিটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি আশঙ্কা করছেন, নির্বাচন আয়োজনে দেরি হলে জনগণ এসব কর্মকাণ্ডে অন্তর্বর্তী সরকারের এখতিয়ার কতটুকু, তা জানতে চাইবে। ইউনূস সাহেবের ব্যক্তিগত যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ না থাকলেও প্রশাসনিক দক্ষতার ব্যাপারে সংশয় তৈরি হবে। জামায়াত এ ক্ষেত্রে কিছুটা ‘ধীরে চলো নীতি’তে চলছে। সরকারকে সংস্কারে সময় দিয়ে দল গুছানো ও ইসলামী জোট গঠনে ব্যস্ত তারা। আওয়ামী শাসনামলে সাংগঠনিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দীর্ঘদিনের পুষে রাখা নীতিও বিসর্জন দিতে উন্মুখ জামায়াত ইসলামী। কওমি জননীর আশীর্বাদপুষ্ট হেফাজতে থেকে তালপাতার বাতাস খেতেও কসুর করছে না। তবে, এসব খোয়াব পূরণে নিশ্চয়ই অনন্তকাল অপেক্ষা করবে না। পরকাল আরাধ্য হলেও ইহকাল নিশ্চিতে নিজেদের মতো করেই যৌক্তিক সময় বেঁধে দেবে। কেউ কেউ বলছেন, আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের মধ্যেই প্রয়োজনীয় সংস্কার সেরে নির্বাচন দিয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এত সময় লাগছে কেন? তারা হয়তো ভুলে গেছেন ফ্যাসিস্ট সরকারের কথা। টানা ১৫ বছরে রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করা হয়েছিল। কর্তৃত্বপরায়ণ শাসক শেখ হাসিনা সবার কর্মক্ষমতা নষ্ট করে দিয়ে গেছে। রান্নার রেসিপি থেকে রকেট সায়েন্সে পারদর্শী(!) বঙ্গবন্ধুকন্যার জিহ্বার আঘাতে সক্ষমতা হারিয়েছে অনেক ডাকসাইটে আমলা। পদপদবির লোভে খাসির মতো সুস্বাদু সৌন্দর্য বিলিয়েছে বাকশালী ইচ্ছার কাছে। পরিণামে বলি হয়েছে তিলে তিলে গড়া বাংলাদেশি আমলাতন্ত্র। মৃগনাভি কস্তুরীর মতো স্থবির প্রশাসনকে জনকল্যাণে মনোযোগী করে গড়ে তুলতে অন্যবারের চেয়ে বাড়তি সময় লাগতে পারে। গত ১৫ বছরে দলীয় আমলারা ব্রিটিশ শাসনামলের মজা উপভোগ করেছেন। অনৈতিক সরকারের সহযোগী হওয়ায় তৃণমূল পর্যায়ের কর্মকর্তাও জমিদারি শাসন চালিয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের উপজেলা চেয়ারম্যান বরখাস্ত হয়েছেন উচ্চাভিলাষী ইউএনওর ইন্ধনে।
রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ঝেঁটিয়ে বিদায় করা দুরূহ কাজ। তার ওপর থেমে নেই সুবিধাভোগীদের নানান দৌড়ঝাঁপ। বুড়া ও গুড়া উপদেষ্টা পরিষদের উদ্যম এবং ত্যক্ত-বিরক্ত জাতির প্রত্যাশার মাঝেও বিস্তর ফারাক। এর মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিবেশীর সঙ্গে পতিতদের যোগাযোগ আর বঞ্চিতদের প্রতিনিয়ত অনুযোগ তো রয়েছেই। তবু, দোয়া ইউনূস পড়তে পড়তে পাড়ি দিতে হবে এ উত্তাল সমুদ্র। দড়িয়াপাড়ের ছেলে হিসেবে সেটা হয়তো পারবেনও। কিন্তু, প্রতিমুহূর্তে হিসাবে গরমিল দেখাতে তৎপর রয়েছে বেহিসেবি দেশদ্রোহীরা। বুঝতে যদি অসুবিধা হয়; তবে, সুতরাং বলে দেশপ্রেমিকের মোড়কে নেমে পড়বে তারা। কেননা, চার স্তরের বিকল্প সাজিয়ে পালিয়েছেন বিকল্পহীনা। শরতের কাশফুলের নরম ছোঁয়ায় শুধু দুর্গতিনাশিনী আসেন না। পায়ের তলায় থেকেও দাঁত খিঁচে অসুর!!
লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা