ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস এবং তার স্ত্রী ইমেলদা অনেকটা শেখ হাসিনার মতোই কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারা হাসিনা-রেহানার মতোই রাষ্ট্রের সব সম্পদ ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে মনে করতেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতো ব্যবহার করতেন। রাষ্ট্রের ৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের জমি লিখে নিয়েছিলেন নিজেদের নামে।
পতিত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আরও একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। এর আগে ফাঁস হয়েছে দুটি। সেই বিবেচনায় এটা তৃতীয়। এই ফোনালাপটি ফাঁস হলো শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ঠিক দুই মাস পর। ইতোপূর্বে যে দুটি ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে, সেই দুটিকে শেখ হাসিনার পলায়ন-পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে করা হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছেন। তৃতীয়টিও যে সেই একই প্রক্রিয়ার অংশ, এ কথা বলাবাহুল্য। ফাঁস হওয়া তৃতীয় ফোনালাপে শেখ হাসিনা যার সঙ্গে কথা বলেছেন, তিনি নিজেকে গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এই ফোনালাপটি রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক উভয়ই দিক দিয়েই বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক দিক হলো, শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাপচারিতার সময় ফোনদাতা গোপালগঞ্জ নিবাসী ছাত্রলীগ নেতাকে বলতে শোনা গেল তারা বাড়িতে থাকতে পারছেন না, তাদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তারা ভীষণ অসহায় অবস্থার মধ্যে আছেন। কথাটি যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য বিষয়টি লজ্জাজনক বৈকি!
পৃথিবীতে বেশ কয়েকজন নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদী শাসকের পতনের খবর আমরা জানি। জার্মানির হিটলার, ইতালির মুসোলিনি, ফিলিপাইনের ফার্দিনান্দ মার্কোস, আর্জেনটিনার ইসাবেল পেরন প্রমুখ পতনের পরও নিজ নিজ এলাকায় বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। এমনকি পাকিস্তানের সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররকেও তার নিজ এলাকার মানুষ ভীষণ ভালোবাসতেন। এটা সাধারণ নিয়ম। একজন শাসক যত নিকৃষ্টই হোন না কেন, নিজ এলাকায় তার বিশেষ কোনো প্রতিপক্ষ থাকে না। বিশ্বের অন্যান্য দেশের কথা না হয় বাদই দিলাম, পতিত সামরিক স্বৈরাচারী হুমেইন মুহাম্মদ এরশাদই এর উৎকৃষ্ট উদাহরন। নব্বইয়ের গণআন্দোলনে পতনের পর তিনি ’৯১-এর সাধারণ নির্বাচনে জেলে থেকে রংপুরের পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং সবকটিতেই বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। রংপুরের জাতীয় পার্টির নেতারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন—এমন খবর ওই সময় আমরা শুনিনি। অথচ ফাঁস হওয়া ফোনালাপের মাধ্যমে আমরা জানলাম শেখ হাসিনার পতনের পর খোদ গোপালগঞ্জে তার জন্মদিন উদযাপন করা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে, এই ফোনালাপটির মাধ্যমে আবারও প্রকাশ হয়েছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী মনস্তত্ত্ব। এই ফোনালাপের সময় তিনি গোপালগঞ্জে এখন দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের তালিকা প্রণয়ন করতে বলেছেন। তাদের কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না বলে তিনি হুমকিও দিয়েছেন। দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরও শেখ হাসিনার স্বভাব, চরিত্র, আচার, আচরণ এবং কথাবার্তায় এতটুকু পরিবর্তন নেই। তিনি যে চিন্তায়, চেতনায়, মেধায়, মনন এবং মগজে একজন বিরল প্রজাতির ফ্যাসিস্ট, তা এই ফোনালাপের মাধ্যমে আবারও অত্যন্ত নগ্নভাবে প্রকাশিত হলো। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে প্রাইভেট বাহিনীর মতো ব্যবহার করেছেন। আর ক্ষমতার বাইরে তিনি তাদের প্রতিপক্ষ মনে করেন এবং তাদের হত্যার হুমকি পর্যন্ত দিয়ে থাকেন। এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। ১৯৮৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে এক জনসভায় দেওয়া ভাষণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের পরিবার-পরিজনকে পাকিস্তানে রেখে এসেছিল। কিন্তু আজকের পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনীর আত্মীয়-স্বজন বাংলার গ্রামেগঞ্জে বাস করে। তাদের আত্মীয়-স্বজনের ঠিকানা খুঁজে বের করুন, সতর্ক করে দিন। হুঁশিয়ার করে দিন, আর যদি এদেশের মানুষের বুকের ওপর গুলি চালানো হয়, আর যদি এদেশের মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, আপনাদের প্রতি আমার আহ্বান, প্রতিশোধ নেবেন। অনেক রক্ত দিয়েছি, আর রক্ত দিতে চাই না। লাশের পরিবর্তে লাশ চাই।’ জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জা ও দুঃখজনক বিষয় এই যে, শেখ হাসিনার এই আত্মঘাতী ও রাষ্ট্রদ্রোহী বক্তব্য তার নিজের লেখা ‘সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র’ শীর্ষক বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে।
বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী শাসকরা এমনই হয়। আর তাদের পতন ও নিয়তিও প্রায় একই রকম। আশির দশকে ফিলিপাইনের স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোসের কথা অনেকেরই মনে আছে। জনতার অভ্যুত্থান দমনে মার্কোসের ট্যাঙ্কবহর যখন দানবের মতো গর্জন করতে করতে রাস্তায় নেমে আসে, তখন শত শত বৌদ্ধ ভিক্ষু ট্যাঙ্কের সামনে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে জপমালা জপতে শুরু করেন। বৃদ্ধ নারীরা বন্ধুকধারী নৌ সেনাদের মাতৃস্নেহে আলিঙ্গন করে তাদের জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে নিবৃত্ত করেন। আর ছোট শিশুরা তাদের ফুলের তোড়া উপহার দেয়। এই অবস্থা দেখার পর মার্কোসের হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক দল ত্যাগ করেন এবং অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর মার্কোস বিমানযোগে দেশ থেকে পালিয়ে যান। হাওয়াইয়ের একটি বিমান তাকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করে। মুহূর্তেই মার্কোসের ‘মানাকানাঙ’ প্রাসাদ একটি পরিত্যক্ত জনশূন্য বিষণ্ন নাট্যমঞ্চে পরিণত হয়, যা এক দিন আগেও ছিল হাজার হাজার মানুষের পদভারে সরব। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে তখন বিশ্ববাসী বুঝতে পারে, এটা শুধু গণঅভ্যুত্থান নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু।
বাংলাদেশের মতো ফিলিপাইনেও গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের আশা ছিল কল্পনাতীত। মার্কোসকে উৎখাত করে কোরাজন একুইনো নারীদের প্রতি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেন। প্রমাণ করেন রাজনীতি হলো অসম্ভবকে সম্ভব করার একটি শিল্প। যে ভদ্র এবং নম্রভাবে কথা বলতে পারে, একটি ছোট লাঠি বহন করতে পারে, যার বিশ্বাস আফিমের নেশার মতো নয়, কিন্তু তিনি জনগণকে উজ্জীবিত করতে পারেন, তিনি নারী হোক আর পুরুষ হোক, বিজয় তার অনিবার্য। কোরাজনের বিজয় দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ চিলি, এশিয়ার দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও পাকিস্তান, এমনকি বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল। জনগণের শক্তির সামনে যে কোনো স্বৈরশাসক টিকে থাকতে পারে না—এই সত্য আরও দৃঢ় হয়েছিল। কোরাজনের নির্মল হাসির ছবিটা সারা বিশ্বের স্বৈরশাসকদের কাছে একটি মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছিল। ওই সময় এই ছবি দেখার পর কোনো স্বৈরশাসক সহজে ঘুমাতে পারত না।
প্রায় সাত হাজার দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত ফিলিপাইনে ওই সময় জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি। দেশটিতে প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস এবং তার স্ত্রী ইমেলদা অনেকটা শেখ হাসিনার মতোই কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারা হাসিনা-রেহানার মতোই রাষ্ট্রের সব সম্পদ ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে মনে করতেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতো ব্যবহার করতেন। রাষ্ট্রের ৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের জমি লিখে নিয়েছিলেন নিজেদের নামে। মার্কোসের শাসনামলে দেশে দারিদ্র্য ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। তবুও ইমেলদা মার্কোস নির্দ্বিধায় বলেছিলেন, ‘আমরা একটি স্বর্গে বাস করি। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশে কোনো দরিদ্র মানুষ নেই।’ ইমেলদা মার্কোস এ কথা যখন বলেন, তখন ফিলিপাইনের প্রতি দশজনের মধ্যে সাতজনই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। হঠাৎ এসব হতদরিদ্র মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে যখন মার্কোস আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং তিনি আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেন। মার্কোস ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট। তিনি আশা করেছিলেন, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান প্রশাসনকে খুশি করতে পারবেন। কিন্তু তার এ পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ে মাত্র দুই মাস আগে রাজনীতিতে আসা পাঁচ সন্তানের জননী কোরাজন একুইনোর কাছে।
শেখ হাসিনার মতোই মার্কোসের শাসনকাল ছিল বিরোধীদের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি এবং দারিদ্র্যের মধ্যেও ক্ষমতাসীনের বিলাসী জীবনযাপনের অভিযোগে ভরা। ফার্দিনান্দ মার্কোসের বিরুদ্ধে প্রবল গণবিক্ষোভ সৃষ্টি হলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান মার্কোসকে পদত্যাগ করে হাওয়াইতে নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। হাওয়াইতেই ফার্দিনান্দ মার্কোস মারা যান ১৯৮৯ সালে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক