অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্বনেতাদের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের ভূয়সী প্রশংসা করে তাদের জীবন উৎসর্গ ও অদম্য নেতৃত্বের কথা তুলে ধরেছেন। চব্বিশের এ আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা শুধু বাংলাদেশেরই নয়, গোটা পৃথিবীর জন্যই একটা বার্তা হিসেবে উল্লেখ করেন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। একই সঙ্গে আন্দোলনে ছাত্রদের ওই অবিস্মরণীয় সাফল্য গোটা বিশ্বের তরুণদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা, তাও ঘোষণা দেন দ্ব্যর্থহীনচিত্তে। তারুণ্যের শক্তির কাছে হাসিনার মতো দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ফ্যাসিবাদী শক্তিও যে কিছুই নয়, সেটাই মূলত ছাত্রদের প্রশংসার ছলে বিশ্বমোড়ল আমেরিকাবাসীর সামনে তুলে ধরেন এ নোবেলজয়ী। এজন্য তিনি রংপুরে পুলিশের গুলির সামনে নির্ভীক তরুণ আবু সাঈদের সেই বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর অবিস্মরণীয় ঘটনা বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দেন আবেগাপ্লুত হয়ে। ছাত্রদের প্রশংসা করার একপর্যায়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের সঙ্গে ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা বোঝাতে আবু সাঈদের অনুকরণে ড. ইউনূস যখন দুই হাত ও বুক চিতিয়ে স্টেজে দাঁড়ান, বিল ক্লিনটনের ওই অনুষ্ঠানের হলভর্তি দর্শক তখন বিপুল করতালিতে ফেটে পড়েন। তার ওই প্রশংসার সমান অংশীদার কিন্তু আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও। আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যদি মাথা হয়, তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিল এর মেরুদণ্ড। তারা সব ভয়-ডর উপেক্ষা করে আবাবিল পাখির মতো অসম্ভব ক্ষিপ্রতা নিয়ে রাস্তায় নামলে, আন্দোলনের কারিগররা অসম্ভবকে সম্ভব করার মানসিক দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। একপর্যায়ে স্কুল-কলেজের ছোট ছোট শিক্ষার্থী পর্যন্ত ভয়কে জয় করে মাঠে নামে দলে দলে। এমন সময় বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাবের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ, সশরীরে উপস্থিতি ও তার ওপর সরকারের জেল-জুলুম-নির্যাতনের ঘটনা শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। এ ছাড়া সরকারকে ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়ে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ ইউল্যাবের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খানের সাহসী বক্তব্য ছাত্র-জনতাকে আরও বেশি সাহসী করে তোলে।
তদুপরি আন্দোলন স্তিমিত করতে ১৬ জুলাই সারা দেশে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নারকীয় হামলায় রংপুরে আবু সাঈদসহ ছয়জন শহীদ হওয়া, একই দিন রাতে ইউজিসি কর্তৃক সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার অজুহাতে তাদের হল ত্যাগের নির্দেশনা প্রদান এবং পরদিন ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে শহীদদের গায়েবানা জানাজায় ভয়াবহ হামলা ও নির্বিচারে গুলির পরিপ্রেক্ষিতে অনেককেই আন্দোলনের পরিণতি নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হতে দেখেছি। এ অবস্থায় আন্দোলনের মোড় ঘোরাতে ১৮ জুলাই রাজধানীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে ভূমিকা রাখে, তা ইতিহাস হয়ে থাকবে অনন্তকাল। গণমাধ্যমের খবরে পরে জানা যায়, ওইদিন অন্তত সারা দেশে ২৭ জন মানুষ নিহত এবং আহত হন অনেকে।
আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত, ওইদিনের শহীদদের তালিকায় সেই মানারাত ইউনিভার্সিটির ছাত্র শাকিল হোসেনও ছিল। রাতে লাল-সবুজের পতাকায় ঢেকে শাকিলের লাশ যখন জানাজার জন্য আশুলিয়া ক্যাম্পাসে নিয়ে আসা হলো, তখন শোকে বিহ্বল পুরো ক্যাম্পাস। শাকিলের সহপাঠী ও আন্দোলনে মানারাতের সমন্বয়ক সাদ, আনিস, তাহেরদের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকার ও এর দোসরদের পরাজিত না করে ঘরে ফেরার দৃপ্ত শপথই শেখ হাসিনার বেলা ফুরিয়ে আসার জানান দিচ্ছিল। ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়েই ঘরে ফেরে বাংলার দামাল ছেলেরা। কিন্তু এজন্য শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরই ৩০ জনের বেশি ছাত্রকে জীবন উৎসর্গ করতে হয়। সব মিলে সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১ হাজার ৫৮১ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৩১ হাজারের বেশি মানুষ। এবার উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান নিয়ে আলোচনায় ফেরা যাক। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কোনো আলোচনা করতে গেলে সর্বাগ্রে জুলাইয়ের আন্দোলনে এখানকার শিক্ষার্থীদের অবদান স্মরণ না করা বেমানান এমন ধারণা থেকেই বর্তমান ভূমিকার অবতারণা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় আসন ও তদুপরি জাতীয় বাজেটে উচ্চশিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় অর্থের বরাদ্দ না থাকার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। গেল ৩৩ বছরের ব্যবধানে দেশে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসির ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৫৫টি সরকারি ও ১১৫টি অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে (১০৯টি) বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ওয়েবসাইটে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, (২০২২) ৩ লাখ ১০ হাজার ১০৭ জন ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত। সামগ্রিকভাবে প্রতি বছর এ বিশালসংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ প্রদানের পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখে চলেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
তবে গেল পতিত সরকার ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় যাওয়ার পর ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন করে। এ আইন অনুযায়ী ট্রাস্ট পরিচালিত ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো মন্ত্রী, এমপি ও ব্যবসায়ী তখন টাকা কামানোর মেশিন হিসেবে অনুমোদন নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খুলে বসেন। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টে নিজেদের পরিবারের একাধিক সদস্যকে ঢুকিয়ে নানান কৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা হাতিয়ে নিতেন। এর বাইরে সনদ-বাণিজ্য করে অর্থ কামানোর অভিযোগও ওঠে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অন্তর্বর্তী সরকার ও ইউজিসির নজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি। তা সত্ত্বেও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে নাম লিখিয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি পড়াশোনার মানের দিক থেকে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। বিদেশি শিক্ষার্থীরাও আসছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও ভূমিকা রাখছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরুর আগে মাত্র নয়টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু ছিল দেশে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংকটের কারণে সে সময় বছরে ৫০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাত উচ্চশিক্ষা নিতে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলে এখন বছরে অন্তত তিন লাখ শিক্ষার্থীর দেশেই উচ্চশিক্ষা নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। তারা আধুনিক ও যুগোপযোগী বিষয়ে পড়ার পাশাপাশি ও বিষয়সংশ্লিষ্ট পেশায়ই নিজের ভবিষ্যৎও গড়ছে। এ ছাড়া ভালো ফল করার জন্য সহায়ক উপকরণ ও পদ্ধতি যেমন—সেশনজট ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশ, চার বছরের কোর্স ঠিক চার বছরেই শেষ হওয়া, ক্রেডিট ট্রান্সফার, মানোন্নয়ন, রিটেক সুবিধা, দরিদ্র ও মেধাবীদের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের মেধাবৃত্তি, ওয়ান স্টপ সার্ভিস, নিজ বিশ্ববিদ্যালয়েই খণ্ডকালীন চাকরির সুবিধা, সহজ কিস্তিতে টিউশন ফি পরিশোধ, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রাধান্য, প্রয়োজনে শিক্ষকের কাছে ছাত্রের অভিগম্যতার সুযোগ, উন্নত ব্যবস্থাপনার কারণে বিভিন্ন সফট স্কিল যেমন—প্রেজেন্টেশন, কমিউনিকেশন, ডিবেটিংয়ে সহজে দক্ষতা বাড়ানো, নারী শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চতর নিরাপত্তা, এসবের কারণেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে শিক্ষার্থীদের।
সুতরাং বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন বাংলাদেশে শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয়ের কারণে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রেই আর কোনো বৈষম্য নয় বরং সর্বত্র মেধাকে প্রাধান্য দিয়ে সবাই মিলে সাম্যের ও ঐক্যের দেশ গড়ব—এটাই হোক আমাদের প্রত্যয়।
লেখক: মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহকারী পরিচালক, জনসংযোগ ও ছাত্রবিষয়ক বিভাগ।
ইমেইল: [email protected]