পেঁয়াজের দাম যখন নাগালের বাইরে চলে যায়, তখন বিপাকে পড়েন ভোক্তারা। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে তখন চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। পেঁয়াজ নিয়ে সবচেয়ে বড় হৈচৈ ঘটে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় ভারত হঠাৎ করে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। পাগলা ঘোড়ার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে পেঁয়াজের দাম ৬০ থেকে ৩০০ টাকা কেজিতে ওঠে। আর এ বছর মৌসুমের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অস্থিরতা বিরজমান। কারণ দেশীয় উৎপাদনের ৭০ ভাগ পেঁয়াজ কৃষক ঘরে তোলে মার্চ-এপ্রিল মাসে। এ বছর ওই সময়ও পেঁয়াজের দাম বেশি ছিল। দাম বেশি থাকায় আগেভাগেই উত্তোলন করে বিক্রি করেছিলেন চাষিরা। এতে তারা লাভবান হলেও সার্বিকভাবে দেশের মোট উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে। আবার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার। এমতাবস্থায়, নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে পেঁয়াজের দাম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সাধারণ ভোক্তাদের কাছে এটিই এখন সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয়। যদি সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে দাম আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে পেঁয়াজের বাজারমূল্য সহনশীল পর্যায়ে আনার লক্ষ্যে গত ৬ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখনো শুল্ক কমানোর সুফল দেখা যায়নি বাজারে। আগের মতো চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে পণ্যটি। বর্তমানে ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তান, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করছেন আমদানিকারকরা। বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহেও কোনো ঘাটতি নেই। খুচরা বাজারে বুধবার রাজধানীতে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ১১০ থেকে ১১৫ ও আমদানি হওয়া পেঁয়াজ ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এদিকে পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপের চার মাস পর তা কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে ভারত। ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে এ হার কার্যকর হয়েছে বলে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে জানানো হয়েছে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, আমরা কেন পেঁয়াজে স্বনির্ভর হতে পারছি না। অথচ পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সুযোগ কিন্তু আমাদের রয়েছে। যেহেতু শীতকালের চাষকৃত পেঁয়াজ দিয়েই আমাদের ৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয়ে যায় আর দরকার মাত্র ৩০ শতাংশ, তাই একটা নির্দিষ্ট জোন বা এলাকায় চাষ করলেই চলে। এ ক্ষেত্রে মৌসুমভিত্তিক পেঁয়াজের পাশাপাশি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনে তৎপর হতে হবে। কোন কোন এলাকা চাষ করা হবে আর কীভাবে কৃষকদের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে আগ্রহী করে তুলতে হবে, সেটার জন্য পথ খুঁজে বের করতে হবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র হতে বারি পেঁয়াজ-২, বারি পেঁয়াজ-৩ ও বারি পেঁয়াজ-৫ এবং বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বিনা পেঁয়াজ-১ ও বিনা পেঁয়াজ-২ নামে পাঁচটি গ্রীষ্মকালীন জাত নিবন্ধিত হয়েছে। গ্রীষ্মকালীন চারা মাঠে লাগানোর ৮০-৯০ দিনের ভেতর পেঁয়াজ সংগ্রহ করার উপযোগী হয়ে যায়। ফলে জুলাই-আগস্ট মাসের ভেতর সংগ্রহ করে ফেলা সম্ভব, যা শীতকালীন পেঁয়াজ সংগ্রহ করার চার মাস আগেই পাওয়া যায়। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ বর্ষাকালেও চাষ করা যায়। বর্ষাকালে লাগালে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ জাতগুলো ৫০-৫৫ দিন পরেই সংগ্রহ করা যায়। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ কৃষক বা প্রাতিষ্ঠানিক উৎপাদন না থাকায় এর বীজ বাজারে পাওয়া যায় না।
প্রণোদনা হিসেবে কৃষকদের বিনামূল্যে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ সরবরাহ করা হলে এ পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়বে এবং ঘাটতি কমে আসবে। দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনকারী প্রধান এলাকা পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মাগুরা, বগুড়া ও লালমনিরহাট। এসব এলাকায় কৃষকদের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে বেশি উৎসাহ দিতে হবে। সঠিক নিয়ম অনুযায়ী গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করা গেলে ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা শূন্য শতাংশে নেমে আসবে। সেইসঙ্গে আমরা পেঁয়াজ উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করব।
একসময় আমাদের চালের খুবই সংকট ছিল। ভারত, ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করতে হতো। এখন আমাদের সংকট তেমন নেই। গরু নিয়ে ভারত আমাদের সঙ্গে কত কাহিনি করেছিল। ভারত গরু রপ্তানি বন্ধ করে ভেবেছিল আমরা গরু খাওয়াই ছেড়ে দেব। এখন দেশে পর্যাপ্ত গরু উৎপাদন হচ্ছে। দেশের চাহিদা পূরণে আর গরু আমদানির প্রয়োজন নেই। আমাদের গরুর চাহিদা আমাদের খামারিরাই মিটিয়ে দিচ্ছে। ইলিশের অভাব ছিল। এখন সংকট নেই। অন্যান্য মাছের চাহিদাও চাষের মাধ্যমে পূরণ হচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, পেঁয়াজ কেন এখনো ভোগাচ্ছে! আমাদের আমদানি করতে হচ্ছে? আমার মতে চাল, গরু, মাছ সমস্যা আমরা যেভাবে করেছি, সেভাবে পরিকল্পনা করলে শতভাগ পেঁয়াজ দেশে উৎপাদন সম্ভব।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ২৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯৯৪ টন। পক্ষান্তরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সারণি থেকে দেখা যায়, একই অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৫০০ টন। ফলে পেঁয়াজের উৎপাদন নিয়ে ডিএইর তুলনায় বিবিএসের তথ্যে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে ৯ লাখ ৯ হাজার ৫০৬ টন। সরকারের দুটি সংস্থা মধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনের তফাত দেখা যাচ্ছে ৯ লাখ ৯ হাজার ৫০৬ টন, যা মোট চাহিদার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। আসলে উৎপাদন ও চাহিদার হযবরল তথ্য দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন, চাহিদা ও ঘাটতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। এটি একটি বড় সমস্যা। প্রতি বছর দাম বাড়লে বিষয়টি সামনে আসে, কিন্তু এখনো তা স্পষ্ট হয়নি। বলা বাহুল্য, এ তথ্যবিভ্রাট পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা তৈরির পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে।
সবচেয়ে মজার তথ্য হলো, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে বার্ষিক মাথাপিছু পেঁয়াজের ব্যবহার দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। অর্থাৎ আগের তুলনায় আমরা এখন অনেক বেশি পেঁয়াজ খাচ্ছি। তাহলে একটা কাজ করলে কেমন হয়? পেঁয়াজ আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হোক। দাম কিছুটা বেড়ে গেলে পরের বছর কৃষকরা উৎসাহ পেয়ে একটু বেশি উৎপাদন করে বাজারে একধরনের ভারসাম্য নিয়ে আসবে। আমাদেরও ভারত কখন নিষেধাজ্ঞা দেবে, সেই আতঙ্কে দিন কাটাতে হবে না। শুধু সিন্ডিকেটের ওপর খানিকটা নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে সরকারকে, যা খুব সহজ নয়।
পেঁয়াজের বর্তমান উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি প্রায় ৩০ টাকা। খামারপ্রান্তে এর বিক্রয় মূল্য ৩৫ থেকে ৩৭ টাকা। বিপণন, পরিবহন, সংরক্ষণ ও ব্যবসায়ীদের লাভ যোগ করে পেঁয়াজের মূল্য ভোক্তা পর্যায়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। মৌসুম শেষে তা সর্বোচ্চ ৭০-৮০ টাকা পর্যন্ত উঠতে পারে। কোনোক্রমেই তা তিন অঙ্ক ছাড়াতে পারে না। পেঁয়াজের দাম ১০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত ওঠা খুবই অস্বাভাবিক। অন্যদিকে এক কেজি চাল উৎপাদন খরচ এবং বিক্রয় মূল্য যদি হিসাব করা হয়, সে ক্ষেত্রে এরকম অস্বাভাবিক দাম কখনো দেখা যায় না।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ইকোনমিক ক্রাইম ইউনিট পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করেছে। তাদের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি ও দেশীয় জোগান কম থাকায় নয়, কারসাজি করেই পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে। কখনো কখনো আমদানি মূল্যের দ্বিগুণ দামে ভোক্তারা পেঁয়াজ কিনতে বাধ্য হয়েছেন। কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী একশ্রেণির ব্যবসায়ী পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মজুতও গড়ে তোলেন। মাঝখানে কয়েকটি স্তরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
পেঁয়াজের বর্তমান সংকট সমাধানের জন্য উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। কৃষক যাতে দাম ভালো পান, সেজন্য উৎপাদন মৌসুমে আমদানি বন্ধ রাখতে হবে। আর পেঁয়াজ সংরক্ষণের দিকে মনোযোগী হতে হবে, যাতে সারা বছরই পণ্যটির সরবরাহ অব্যাহত রাখা যায়। এ ছাড়া অনাবাদি ও চরের জমি পেঁয়াজ চাষে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ভালো বীজ সহজলভ্য করতে হবে এবং উচ্চফলনশীল জাতগুলোর চাষ বাড়াতে হবে। পেঁয়াজচাষিদের একটি নির্ভরযোগ্য স্থিতিশীল বাজারের নিশ্চয়তা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, পেঁয়াজ রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ হলেও অত্যাবশ্যক নয়। এর ব্যবহার কমিয়ে দিলেও কোনো ক্ষতি হবে না।
লেখক: কৃষিবিদ, উপপরিচালক
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়