১৯৫১ ও পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ থেকে, যারা শুধু বাংলাদেশের একক নাগরিকত্ব নিয়ে এ রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবেন, তাদের হাতেই বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডের আইন প্রণয়ন ও শাসনভার ন্যস্ত থাকা কাম্য। অর্থাৎ বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করে সে দেশের নাগরিকত্ব নেওয়া ব্যক্তিরা পরামর্শক হতে পারেন, কিন্তু প্রণেতা বা শাসকের ভূমিকায় তাদের উপস্থিতি মোটেই কাম্য নয়। অথচ বহু বছর ধরে এর ব্যত্যয় ঘটে আসছে এবং তা ঘটছে সংবিধানপরিপন্থি নির্বাহী আদেশে সৃষ্ট দ্বৈত নাগরিকত্বের লেবাসে।
দ্বৈত নাগরিক ধারণার উদ্ভব এবং আমাদের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে এর যত্রতত্র অপব্যবহার সম্পর্কে আজ অনেকে জানেন। ধারণাটির বিকৃত ব্যবহার বা পরিকল্পিত উপায়ে সরকারি প্রজ্ঞাপনে সংযোজনের ইতিহাস এক বছর আগে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করেছিলাম, যা গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়, ‘নাগরিকত্ব আইনে দ্বৈত নাগরিক হওয়ার সুযোগ এলো কীভাবে?’ শিরোনামে।
সংবিধানের খসড়া লেখার কাজে যারা অংশ নেবেন তাদের নিবন্ধটি দেখতে বলব, যেখানে ধারা-উপধারার উল্লেখ রয়েছে। আজকের প্রেক্ষাপটে দ্বৈত নাগরিকত্বের ধোঁয়াশা ও তার নেতিবাচক প্রভাব থেকে রাষ্ট্র ও সমাজকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সংক্ষেপে কিছু তথ্য, যুক্তি ও প্রস্তাবনা উল্লেখ করব।
মোটা দাগে আমার ভাবনা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গঠন ও সরকারসহ সেসবের গঠন প্রক্রিয়া সংবিধানে স্থান পায়। তবে তার বাইরে, একটি সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ও তাদের তৈরি সংগঠনের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক এবং তাদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক নির্ধারণে সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করার জন্য নাগরিকত্ব নির্ণয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।
রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব তার নাগরিকের প্রতি, বিশেষত দেশের ভৌগোলিক সীমানার অভ্যন্তরে অবস্থিত নাগরিকদের প্রতি। তবে বাংলাদেশের অনেক নাগরিক বিদেশে কর্মরত রয়েছেন, যাদের আমরা অনিবাসী বাংলাদেশি বা এনআরবি নাম দিয়েছি। তাদের দেখভাল করার দায়িত্ব যেমন সেখানকার নিয়োগকারী ও সে দেশের সরকার-নিযুক্ত কর্তৃপক্ষের, তেমনি সেসব কর্মজীবীর নিরাপত্তা ও বিদেশের মাটিতে সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ওপরও বর্তায়। একইভাবে বাইরে পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী অথবা ভ্রমণকারীদের প্রতি সে জাতীয় দায়িত্ব রাষ্ট্রের রয়েছে।
কিন্তু ভিনদেশের নাগরিকত্ব যারা নিয়েছেন, তাদের জন্য কি রাষ্ট্রের একই দায়িত্ব রয়েছে? শেষোক্ত গোষ্ঠীর অনেকে মূলত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিক, যাদের ইংরেজিতে ফরেন সিটিজেনস অব বাংলাদেশি অরিজিন বলা যায়। আমি সংক্ষেপে তাদের এফসিবিও বলব।
লক্ষণীয় যে, এফসিবিওদের অনেকে জন্মভূমির উন্নয়নে এবং রাষ্ট্র-বিনির্মাণে অবদান রাখছেন এবং ভবিষ্যতেও রাখবেন। কিন্তু একই গোষ্ঠীর অনেকে দ্বৈত-নাগরিকের লেবাসে, এ দেশের সংসদ ও অর্থপ্রবাহের সংযোগ কেন্দ্রে বসে ক্ষমতার জোরে অর্থ লুট করেছে, অনেকে ব্যাংক লুটপাট করে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছে, অনেকে নির্বিচারে অর্থ পাচার করেছে ও করছে এবং অনেকে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে অন্য দেশের পাসপোর্ট হাতে সহজে পালিয়ে যেতে পেরেছে।
দ্বৈত-নাগরিকত্বের নাম করে অসাধু পথ নেওয়ার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যখন দেখি এফসিবিওদের কেউ কেউ এনআরবিদের কষ্টার্জিত আয় থেকে প্রেরিত রেমিট্যান্সের কৃতিত্ব নিজেদের বলে দখলি নিতে চায়, ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়াকে আইনি বৈধতা দিতে সচেষ্ট এবং একজন একক নাগরিকত্বধারী বাংলাদেশির সমতুল্য রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার। দুঃখের সঙ্গে ইদানীং লক্ষ করছি যে, ডায়াসপোরা—অর্থাৎ, প্রবাসী নামের অন্তরালে একই প্রক্রিয়া চলমান থাকার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
নাগরিকত্বকে জাতি-ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ না করে, একক ও একাধিক নাগরিকত্ব এবং নিবাসী ও অনিবাসীর ভিত্তিতে ভাবা প্রয়োজন। সেই বিচারে, আমাদের মধ্যে একক নাগরিকত্বের নিবাসী এবং অনিবাসী বাংলাদেশিদের মুখ্য জনগোষ্ঠী ভেবে সংবিধান রচনা হওয়া প্রয়োজন। সেই সংবিধানে নিঃসন্দেহে এফসিবিওদের ভিন্নভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন এবং চলাচল, সম্পদ-মালিকানায়, বিনিয়োগে ও কর প্রদানে তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা বিবেচনা প্রয়োজন। তবে তাদের কর্মসংস্থান, নিবন্ধন সাপেক্ষে, সুনির্দিষ্ট কিছু খাতে সীমিত রাখা যায়, যেমনটি আমরা পাশের দেশের সংবিধানে দেখি। অতীতের মতো আরও বলা যায়, যদি একজন এফসিবিও তার ভিনদেশের নাগরিকত্ব, সেই দেশের আইন অনুযায়ী পরিত্যাগ করে একক বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেন, তাকে নির্দিষ্ট নিবাসকাল শেষে, একক বাংলাদেশি নাগরিকত্বের মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে।
উল্লিখিত শ্রেণিগুলোর বাইরে আরও তিনটি জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব ভেবে দেখা প্রয়োজন, যাদের প্রতিটিই সীমান্তের ভেতরে ও বাইরে অবস্থান করে (ইংরেজিতে যাদের ট্রান্স-বর্ডার কমিউনিটি বলা হয়)। প্রথমটি হলো, ধর্মসূত্রে এখানকার জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যারা সম্পর্কিত, অথচ যাদের অনেকের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয়টিতে রয়েছে পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী, বিশেষত, সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় যারা বসবাস করে। তৃতীয় জনগোষ্ঠীতে রয়েছে বেশ কয়েকটি, জনসংখ্যা-বিবেচনায়, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, যাদের এক বা একাধিক ধারা বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার অভ্যন্তরে বাস করে এবং এ দেশেরই নাগরিক। তবে সেসব জাতিগোষ্ঠীর অনেকে সীমান্তের ওপারে বসবাস করে।
পরিশেষে বলব, সংবিধানের পথ বেয়ে নতুন ধাঁচের ঔপনিবেশিক শাসন যেন আইনি মোড়ক না পায়। সে ব্যাপারে আশা করব, নতুন প্রজন্ম সদাজাগ্রত থাকবে। সেইসঙ্গে নতুন বাংলাদেশ গড়ার যাত্রায় সবার প্রতি রইল আমার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ
[নিবন্ধের বক্তব্য লেখকের একান্তই নিজের, যা ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের অন্য সদস্যদের মত থেকে ভিন্ন হতে পারে]