পৃথিবীর সব মানুষ এক অভিন্ন পরিবারের উত্তরসূরি। আল্লাহতায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এক সত্তা থেকে। পৃথিবীর সব মানুষের শিকড় আদি-পিতা হজরত আদম (আ.) এবং তার স্ত্রী হাওয়া (আ.)। তবে মানুষ কালের গতিপ্রবাহে এই বন্ধন ও সম্পর্কে ফাটল ধরিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বিভিন্ন জাতি, বংশ, গোত্র ও বর্ণের ভিত্তিতে। অথচ মানবতার দাবি হচ্ছে বিশ্বজোড়া প্রেম-ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করা। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মানদণ্ড হচ্ছে তাওহিদ ও একত্ববাদের বিশ্বাস। এক মুসলিম অন্য মুসলিমের প্রতি সহানুভূতি ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে; সে যে দেশের হোক, যে ভাষারই হোক। কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমাদের ওপর রহম করা হয়।’ (সুরা হুজুরাত: ১০)
একতা ও সংঘবদ্ধতার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য সুন্দর একটি উদাহরণ দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সম্প্রীতি ও সহানুভূতির ক্ষেত্রে মুমিনদের দৃষ্টান্ত একটি দেহের মতো। যার একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে গোটা দেহ জ্বর ও অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়।’ (বোখারি: ৬০১১; মুসলিম: ২৫৮৬)। অন্য হাদিসে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন মুমিনের জন্য আয়নাস্বরূপ, মুমিন মুমিনের ভাই। সে তার জমি সংরক্ষণ করে ও তার অনুপস্থিতিতে তাকে হেফাজত করে।’ (আবু দাউদ: ৪৯৪৮)। নবীজি আরও ইরশাদ করেন, ‘মুমিনগণ পরস্পর একটি ইমারতস্বরূপ। যার এক অংশ অন্য অংশকে মজবুত করে রাখে।’ এ সময় তিনি উভয় হাতের আঙুলগুলো জড়িয়ে দেখিয়েছিলেন। (বোখারি: ৫৬৮০)
সমাজ জীবনে মানুষ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই পারস্পরিক সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ব, সমঝোতা প্রভৃতি সদাচরণ সমাজে অন্যায় ও জুলুমের অবসান ঘটায় এবং ক্রমান্বয়ে মানবসভ্যতাকে গতিশীল করে তোলে। তাই দেখা যায়, মানুষ যখন পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে অখণ্ড সমাজ গঠন করেছে, তখন তারা অগ্রগতি ও শান্তির উচ্চতর মার্গে পৌঁছে গেছে। আর যখনই বিভেদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখনই পতন হয়েছে অনিবার্য পরিণতি। ইতিহাসের পাতায় এরূপ ঘটনা অসংখ্য।
কোরআন-হাদিসের উপর্যুক্ত নির্দেশনা যখন সব গ্রাম-শহরের বাস্তবায়িত হবে, তখন সব ভূখণ্ড একত্রিত একটি সমাজের রূপ নেবে, যে সমাজের চোখ ব্যথা হলে পুরো দেহ ব্যথিত হয়; যেমনটা নবীজি (সা.) বলেছেন। তখন কোনো অঞ্চল দুর্যোগ দুর্বিপাকে পড়লে অমনি অন্যান্য অঞ্চল বিপদের মোকাবিলায় ছুটে আসবে।
ইসলামের আগমনের আগে আরববাসীদের মধ্যে অনৈক্য বিরাজমান ছিল। গোত্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত-শত্রুতা, কথায় কথায় লড়াই-ঝগড়া এবং দিনরাত খুনাখুনি ও রক্তপাত লেগেই ছিল। এর পরিণামে গোটা আরবজাতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এ নিশ্চিত ধ্বংস ও কঠিন অবস্থা থেকে তাদের ইসলাম রক্ষা করেছিল। ইসলামে মানুষের বিভেদ ভুলে একতার আহ্বান জানিয়েছে আল্লাহর ঐশীবাণীর ভিত্তিতে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো। পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো। তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু। তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন। ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে গেলে। তোমরা আগুনের কিনারায় ছিলে, আল্লাহ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য তার নিদর্শন স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা সৎপথ পেতে পারো।’ (সুরা আলে ইমরান: ১০৩)। আল্লাহর রজ্জু বা রশি অর্থ আল্লাহর কোরআন ও দ্বীন। এর ভিত্তিতে সবাইকে একতাবদ্ধ থাকতে হবে।
তবে কোরআনের শিক্ষা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাওয়ায় আজ সর্বত্র বিভেদ বাড়ছে, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ছে। কারও ক্ষেত্রে ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি এতটাই হ্রাস হয়ে গেছে যে, কোনো অঙ্গে ব্যথা পেলে মোটেই টের পায় না! যাকে প্যারালাইসিস আক্রান্ত হওয়া বলা চলে। ফলস্বরূপ মুসলিমরা পরাজিত হচ্ছে। অবক্ষয় নেমে আসছে ব্যক্তিজীবনেও। এ অবস্থা থেকে নিস্তার পেতে কোরআনের আলোয় রাঙাতে হবে নিজেকে এবং বিভেদ ভুলে ঐক্যের আহ্বানে সাড়া দিতে সদা প্রস্তুতি থাকতে হবে।
মাওলানা মিজানুর রহমান, ইমাম ও খতিব