ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়েছিলেন। এরপর স্বাভাবিকভাবেই তিনি সেখান থেকে টেলিফোনে তার দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এসব ফোনালাপের দুটি ফাঁস হয়েছে। অনেকেই বলছেন, রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে এ দুটি ফোনালাপ ফাঁস করা হয়েছে। ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর থেকেই পতিত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার বক্তব্যের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে জোর আলোচনা। কেননা, একটি ফোনালাপে শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেননি। কাজেই তার পদত্যাগ হয়নি। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী তিনিই এখনো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তিনি দেশের খুব কাছাকাছি আছেন, যাতে চট করে যে কোনো সময় দেশের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারেন।
কয়েক দিন আগে শেখ হাসিনাকে তার মেয়ের সঙ্গে দিল্লির লোদি গার্ডেনে ঘুরতে দেখা গেছে। আর মাত্র দুদিন আগে তিনি গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমানসেনা ঘাঁটিতে একটি শপিং সেন্টারে নিজের এবং বোনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে গিয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমানসেনা ঘাঁটির একটি সেফ হাউসে বসবাস করছেন বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে। অর্থাৎ দেশের খুব কাছাকাছি আছেন, চট করে যে কোনো সময় দেশের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারেন; এমন অবস্থায় তিনি নেই। টেলিফোনে তিনি সত্য বলেননি। আবার পদত্যাগ-সংক্রান্ত যেসব কথা বলেছেন, এগুলোর যে কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই এটা শেখ হাসিনাও খুব ভালোভাবেই জানেন এবং বোঝেন। কেননা তিনি ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর রাষ্ট্রপতি বলেছেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র তিনি পেয়েছেন। অতএব এ নিয়ে শেখ হাসিনা এখন যাই বলুন না কেন, এর কোনো মূল্য নেই। আরও একটি কারণে শেখ হাসিনা এখন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী দাবি করতে পারেন না। কারণ প্রধানমন্ত্রী থাকার অন্যতম শর্ত হলো তার সংসদ সদস্যপদ বহাল থাকা। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। ফলে দেশে এখন কোনো সংসদ নেই এবং কারও সংসদ সদস্যপদ বহাল নেই, অর্থাৎ শেখ হাসিনারও নেই। আবার শেখ হাসিনা এখন যে দেশে পালিয়ে আছেন, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী খোদ নরেন্দ্র মোদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, এত কিছু সত্ত্বেও শেখ হাসিনা কেন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন। বাস্তবিক, ফ্যাসিস্টদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে শেখ হাসিনার এ বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তার এ বক্তব্যের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি না থাকলেও এর মনস্তাত্ত্বিক দিকটি অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। এই ফোনালাপের মাধ্যমে আমাদের বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা একজন নৃশংস স্বৈরাচারীর মনস্তত্ত্ব উপলব্ধি করার এক বিরল সৌভাগ্য হলো। আমরা বুঝতে পারলাম দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা কোনো স্বৈরাচারী শাসক যদি ক্ষমতা থেকে উৎখাত হন, এমনকি যদি দেশ থেকেও বিতাড়িত হন, তবুও তিনি নিজেকে সরকারপ্রধান ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন না। তিনি যে ক্ষমতাচ্যুত এবং দেশ থেকে বিতাড়িত, এ বিষয়টি তিনি বিবেচনার মধ্যেই নিতে পারেন না। তার মধ্যে সবসময় এই বোধ কাজ করে যে, তিনিই দল, তিনিই সরকার এবং তিনিই রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। ক্ষমতা না হয় মৃত্যু—এ দুয়ের মাঝামাঝি কোনো অবস্থান নিকৃষ্ট স্বৈরাচারীদের বোধের মধ্যেই থাকে না। এটা শুধু শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। বিশ্বের সব দেশের স্বৈরশাসকের স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ, চিন্তা-চেতনা, মনন ও কথাবার্তার ধরন এক এবং অভিন্ন। এ ক্ষেত্রে তিনি সবুজ শ্যামল বাংলাদেশের স্বৈরাচারীই হোন, অথবা ধূসর তিউনিশিয়ার পতিত স্বৈরাচারী জাইন আল-আবিদিন বেন আলিই হোন—তারা যেন এক বৃন্তে দুটি শাসক, দুটি স্বৈরাচার।
আরব বসন্ত শুরু হয়েছিল উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিশিয়া থেকে। দেশটির একজন ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ বোয়াজিজি সেনাবাহিনী ও পুলিশের নারকীয় অত্যাচারের প্রতিবাদে ২০১০ সালের ১৮ ডিসেম্বর গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। উত্তর আফ্রিকা ও আরবজুড়ে ওঠে গণবিপ্লবের এক ভয়াবহ ঝড়, যা ‘আরব বসন্ত’ নামে পরিচিত। এই আরব বসন্তের প্রভাবে তছনছ হয়ে যায় তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, মিশর, মরক্কো, সোমালিয়া, সুদান, জর্ডান, লিবিয়া, কুয়েত, ওমান, ইরাক, ইরান ও ইয়েমেন।
২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলি দেশ থেকে পালিয়ে সৌদি আরবে অবস্থান নেন। দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগে বেন আলি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন এবং একজন সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদকের সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনা করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দুজন মন্ত্রীর সঙ্গেও ফোনে কথা বলেছিলেন। এসব ফোনালাপ পরবর্তীকালে ফাঁস হয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। শেখ হাসিনা ও বেন আলির ফাঁস হওয়া ফোনালাপ এবং তাদের দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পূর্বাপর কয়েকটি ঘটনা যদি আমরা আলোচনা করি, তাহলে ফ্যাসিবাদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া আমাদের জন্য সহজ হবে। আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারব দীর্ঘদিন ফ্যাসিবাদী শাসনের ফলে কীভাবে লেখক, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীরাও স্বৈরাচারের দোসরে পরিণত হয়। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার কয়েক দিন আগে দেশের সম্পাদকদের সঙ্গে কথা বলেন। ওই মতবিনিময় সভায় একটি জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক বলেন, ‘মানুষের বিশ্বাস এবং আস্থা আপনার প্রতি। যে কোনো সংকটে যে কোনো সমস্যায় সবাই মনে করেন যে, সংকট ও সমস্যা থেকে উত্তরণে আপনার কাছে যেতে হবে এবং তার উপায় আপনি দেবেন।’
আরেকজন সিনিয়র সাংবাদিক বলেন, ‘মানুষের মধ্যে একটি অস্বস্তি ছিল, আপনি যখন অফিস খুলে দিয়েছেন আমি পথে ছিলাম; মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ছিল, আমি মানুষের মধ্যে উল্লাস দেখেছি, তারা কাজ করতে চায়, অফিসে যেতে চায়। কী অবস্থায় আমি মনে করি সারা দেশেই কর্মমুখী করার ব্যবস্থা আপনি নেবেন। আস্থা ফেরানোর জন্য যা যা ব্যবস্থা নেওয়ার আপনি নেবেন।’
আরেক প্রবীণ সাংবাদিক এবং কলামিস্ট বলেন, ‘আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আছি, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করি; তাদের সবার উচিত পুরো পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা।’
অন্যদিকে বেন আলি দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার দুদিন আগে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। এ ভাষণের পরই তিনি মিডিয়া মালিক তারাফ বিন আম্মারকে ফোন করেন। তারাফ বিন আম্মার তাকে বলেন, ‘আপনি দুর্দান্ত বলেছেন। এই সেই বেন আলি। যার জন্য আমরা অপেক্ষা করছিলাম। জনগণের সন্তান।’
জবাবে বেন আলি বলেন, ‘আমার বক্তব্য ভালো হয়নি।’ তারাফ বিন আম্মার বলেন, ‘একদমই না। এমন কথা আর বলবেন না। দেখুন, আল আরাবিয়া এবং ফ্রান্স ২৪ আপনার বক্তব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। এটি একটি ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন। আপনি জনগণের মানুষ, আপনি তাদের ভাষায় কথা বলেন।’
পরদিন হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে। বিক্ষোভকারীরা বেন আলির পদত্যাগ দাবি করে। ফলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। ওইদিন বেন আলিকে তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিমানবন্দরের দিকে যেতে দেখা যায়। তারপর তিনি এবং তার স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে বিমানে চড়ে বসেন। বিমানে বেন আলিকে একজন ফোন করেন। সবার ধারণা তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী রিধা গ্ৰিরা। ফোন রিসিভ করেই বেন আলি বলেন, ‘আমি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেশে ফিরব।’
জবাবে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রিধা গ্ৰিরা বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট, আপনি যখন ফিরে আসবেন আপনাকে স্বাগত জানানো হবে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সেনাবাহিনী আপনার সঙ্গে থাকবে।’
বিমানে বসেই বেন আলি আরেকজনকে কল করেন। তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল রাচিদ আম্বার। তাকে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি কি আমার নিয়ন্ত্রণে আছে?’ সেনাপ্রধান জেনারেল রাচিদ আম্বার বলেন, ‘সবকিছু ঠিক আছে।’ বেন আলি বলেন, ‘আমার কথা শুনুন রাচিদ। আপনি কি আমাকে এখন ফিরে আসার পরামর্শ দেবেন, নাকি পরে?’ সেনাপ্রধান আম্বার বলেন, ‘আমার মনে হয় আপনি একটু অপেক্ষা করলে ভালো হয়।’
মধ্যরাতের পর বেন আলির বিমান সৌদি আরবের জেদ্দায় অবতরণ করে। সকালে তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে ফোন করেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাকে বলেন, ‘রাজপথের মানুষ এমনভাবে বিক্ষোভ করছে, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আপনি যাতে বলতে না পারেন যে আমি আপনাকে বিভ্রান্ত করছি এবং সিদ্ধান্ত আপনার।’
বেন আলি বলেন, ‘কিন্তু পরিস্থিতি কি শান্ত হয়ে আসছে তাই মনে হচ্ছে। এটা আগের অবস্থা ছিল এখন ফেসবুকে ঘোষণা করা হচ্ছে এবং আমরা ধারণা করছি সামনের দিনগুলোতে বড় ধরনের কিছু হতে পারে।’
প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাকে বলেন, ‘না! একদমই না, আমি আপনাকে বলছি এবং সিদ্ধান্ত আপনার। আমি আপনাকে প্রাসাদেই সুরক্ষা দিতে পারি। কিন্তু রাস্তায় বিক্ষোভের খবর আমি জানি না।’
এরপর কেটে যায় প্রায় একটি দশক। বেন আলি আর তিউনিশিয়ায় ফিরে আসতে পারেননি। ২০১৯ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি সৌদি আরবে নির্বাসিত ছিলেন...
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক