বিভিন্ন বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে দেশের পুনর্গঠন ও মানুষের দাবির প্রতি সাড়া জাগানোর এক বিশেষ মূহূর্তে আবির্ভূত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। গণতান্ত্রিক মূলনীতি ও মানবাধিকার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা স্বৈরাচারী ও বৈষম্যমূলক রীতিনীতিগুলো ভেঙে ফেলে একটি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার কাজ এখন অধিক গুরুত্বপূর্ণ। নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তরুণরা এবার প্রাণ দিয়েছেন, যে বাংলাদেশে তাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা অসহ্য হয়ে উঠেছিল। এ কারণে যখন ছাত্রদের প্রাণ ঝরে পড়ছিল, তখন দলমতের ঊর্ধ্বে এসে সারা দেশের মানুষ তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এবার ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ বিনির্মাণে ও সংস্কার বাস্তবায়নে সবার গুরুত্ব দিতে হবে।
বিশৃঙ্খলা অগ্রগতির বড় শত্রু। নতুন সরকারকে বাংলাদেশের এ ক্রান্তিকালে নিঃসন্দেহে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এ চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো—তরুণদের মাদকের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা। বিগত সরকারে সময়ে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার, মাদকের বিস্তৃতি ও মাদকাসক্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। যার জন্য আমারা বারবার এ বিষয়টি নিয়ে তদানীন্তন সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলে আসছিলাম। সরকারের ভেতর-বাইরে তখন মাদকের কারবার ও অপব্যবহার দৃশ্যমান ছিল। তা ছাড়া সীমান্তবর্তী স্থানগুলোতেও এর সহজলভ্যতা ও বেচাকেনা বৃদ্ধি পেয়েছিল। যার ফলে তরুণ-যুবসমাজ মাদকের করাল গ্রাসে ক্রমেই নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।
আমি ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক ও মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেই যাচ্ছি। একটা সময় বিষয়গুলোকে পাত্তা দেওয়া হতো না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাবনা পাল্টে গেছে। দেশে তামাক উন্নয়ন বোর্ড থেকে ‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল’ এবং ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর’ গঠন হয়েছে। কিন্তু ধূমপান, মাদকের বিস্তার ও সহজলভ্যতা দূর করা যাচ্ছে না।
নতুন সমাজ গঠনে আমাদের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও আবেগ আমরা লক্ষ করছি, তাতে মনে হয় এ মাদকের অভিশাপ থেকেও তারাই জাতিকে মুক্ত করতে পারবে। নতুন সমাজ গঠনে মাদকের আগ্রাসন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে বর্তমান তরুণরাই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কারণ ফ্যাসিবাদের ভ্রুকুটির কাছে জিম্মি হয়েছিল রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান। সরকারের মাধ্যমে জাতি সেই কালো অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে পারবে এমনটাই প্রত্যাশিত। এ তরুণরাই অতীতে বড় বড় ঘটনা ঘটিয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তারাই ছিল সংগঠক, এমনকি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্ররা সামনে না এলে সফলতা আসত না। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তরুণরাই ছিল প্রধান। এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও সেটা তারা প্রমাণ করেছে। বিগত সরকারের পতনও তরুণদের শুরু করা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ঘটল।
সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধে, দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও তরুণদের সঠিকভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ধূমপান, মাদকাসক্তি একটি বিরাট অন্তরায়। সুতরাং রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে নতুনভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার, ধূমপানসহ ক্ষতিকর নেশা প্রতিরোধে বিশেষ নজর দিতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী এবং তাদের মধ্যে ৬০ ভাগ বিভিন্ন অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। যারা মাদকদ্রব্য সেবন করে তারা প্রথমে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়, তারপর মাদকদ্রব্য সেবন শুরু করে থাকে। পরবর্তীকালে তারা গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, সিসা, হেরোইন, কোকেনসহ বিভিন্ন মরণ নেশায় আসক্ত হয়। বর্তমানে কিশোর-তরুণরা বন্ধুদের প্ররোচনায় ধূমপান শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে এর একটি বিরাট অংশ মাদক সেবন ও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়ায়। বৈশ্বিকভাবেও বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত যে, তরুণ বয়সেই বেশিরভাগ তরুণ ছেলেমেয়ে কৌতূহলবশত বা পারিপার্শ্বিক প্ররোচনায় ভয়াবহ মাদক ও ধূমপানের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। হয়তোবা তার উপলক্ষ থাকে কোনো একটি বিশেষ দিন বা বিশেষ অনুষ্ঠান।
আগামীর বাংলাদেশ এগিয়ে নিতে যোগ্য নেতৃত্বের শঙ্কা যেন না থাকে, সেদিকটাতে আশু সুনজর দেওয়া অপরিহার্য। এজন্য শিশু-কিশোরদের মেধা ও সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক মনন বিকাশে পরিবার, সমাজ সরকারি সব পদক্ষেপের সঙ্গে আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। নতুবা এর পরিণাম থেকে আমরা কেউ মুক্ত থাকতে পারব না। তাই কিশোর-তরুণ প্রজন্মের সর্বোচ্চ সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে তামাক ও মাদকের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
মাদক এমনই ক্ষতিকর একটি নেশা, যেটা বারবার নিতে ইচ্ছে করে। কৌতূহলবশত কিংবা প্ররোচনায় যে তরুণটি মাদকের জালে জড়িয়ে পড়ছে তাদের ফেরানো কঠিন। এমনিতেই তামাক ও মাদকের আগ্রাসনে তরুণরা বিপথগামী হয়ে পড়ছে। উপরন্তু নাটক, সিনেমাতেও তরুণদের আইডল ও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা নায়ক-নায়িকাদের দ্বারা ধূমপানে, মাদকে উৎসাহিত করে এমন দৃশ্য অহরহ প্রচার করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিগারেট কোম্পানিগুলোর বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে। যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে, সেটা রীতিমতো উদ্বেগজনক! সুতরাং, বসে থাকার সময় নেই। তরুণদের রক্ষায় কাজ করতে হবে।
বর্তমানে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিসাধন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তেমনি মাদকদ্রব্যের অবৈধ পাচার রোধেও সজাগ হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীতে এখনো নানাবিধ সংকট রয়েছে। আন্দোলনের সময় মাদকবিরোধী আন্দোলনে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে যৌথ বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের দিকেও সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তর, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবিশেষের সক্রিয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি আমাদের কিছু বিষয়ে করণীয় হলো—কেউ আসক্ত হলে গোপন না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া; মাদকাসক্ততে ঘৃণা না করে ভালোবাসা দেওয়া; কেউ আসক্ত হলে স্বজন, বন্ধু, ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করা; আসক্তির লক্ষণ দেখা দিলেই নিরাময়কেন্দ্রে যোগাযোগ করা এবং আসক্তকে ভালোবেসে তাকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন। এখানে পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গত ৫ আগস্ট থেকে দেশে যে পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন এক রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছে এ দেশের মানুষ। অর্থাৎ এমন একটি সংস্কৃতি মানুষ প্রত্যাশা করে; যা সত্যিকারই অর্থবহ হবে। বস্তুত, উন্নয়নশীল বিশ্বের শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, দুঃশাসন, অপশাসনের বিরুদ্ধে যখন জনতা সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, তখন জনমত গঠনের মাধ্যমে শাসনক্ষমতার পরিবর্তন আসে। তরুণ-যুবসমাজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অনতিবিলম্বে তামাক, মাদক নির্মূলে সর্বাত্মক প্রয়াস নেওয়া হবে—এটাই আজকের দিনের প্রত্যাশা।
লেখক: অধ্যাপক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা (একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক)