বলা হয়ে থাকে, কোনো ব্যক্তি যদি একবার দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, তখন তার কাছে নীতিনৈতিকতা ও আত্মসম্মানবোধের বালাই থাকে না। সুযোগ থাকলে সে দুর্নীতি করবেই। কথাটি যে কতটা সত্য, তার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে আমাদের দেশে। আবার দুর্নীতিতে কে বেশি পারদর্শী—রাজনীতিক, আমলা নাকি অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী—এ বিষয়ে সমাধানে আসা অসম্ভব কর্ম বইকি! কেননা দুর্নীতির অঙ্গনের যে একটি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই বা চরম প্রতিযোগিতা চলে, তা আমরা জানতে পারি প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে অনিয়ম-দুর্নীতির খবর প্রকাশের মাধ্যমে। তবে এসব অপকর্ম করতে যে, দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিকে নিজের জন্মদাতা-জন্মধাত্রীর নামকেও ব্যবহার করতে বা তাদের নামে অপকর্মটি করতে কিঞ্চিৎ পরিমাণও বিবেকে নাড়া দেয় না—সেসব খবরও নেহাত কম নয়। দুর্নীতি কি এমনই সর্বগ্রাসী!
সোমবার দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন সচিবের দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি বলছে, মো. খায়রুল আলম সেখ নামে এ সচিব মায়ের নামে মাদ্রাসা-এতিমখানা এবং বাবার নামে ফাউন্ডেশন গড়ে তুলে বিভিন্নভাবে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। আর এসব অপকর্ম করতে যত ধরনের অনিয়মের পথ অবলম্বন করা দরকার, তিনি প্রায় সবই করেছেন। খবরে প্রকাশ, তিনি মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগ পান গত বছর অক্টোবরে। সচিব হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই নিজ গ্রাম ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘পশ্চিম চরবর্ণী নরীরন্নেসা এতিমখানা ও মাদ্রাসা’। মাদ্রাসাটির সরকারি অনুমোদন পায় চলতি বছর মে মাসে। অথচ নিজের প্রভাব খাটিয়ে প্রতিষ্ঠার পরপরই অর্থাৎ জানুয়ারি থেকেই অর্থ বরাদ্দ নেন সচিব! এমনকি ওই সময় একজন এতিমও সেখানে পড়াশোনা করত না। তা সত্ত্বেও ৮০ জন এতিমের পড়াশোনা এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা বাবদ সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় এক ব্যক্তি রসিকতা করে বলেছেন, ‘এখানে একজনও এতিম নেই। ওই ৮০ জন মনে হয় ভূত।’ নিয়ম অনুসারে নিবন্ধন নেওয়ার পরও কিছুদিন অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠান দেখভালের পর সন্তোষজনক মনে হলে ওই প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে অর্থ সহায়তা দেয়। তবে এ ক্ষেত্রে মানা হয়নি কোনো নিয়মনীতি। শুধু এতিমখানায়ই নয়, সচিব হওয়ার দুই মাসের মধ্যেই বাবার নামে ‘আয়েন উদ্দিন সেখ মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন’-এর নিবন্ধন নেন খায়রুল আলম। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে যার নিবন্ধনও মেলে প্রতিষ্ঠার পরপরই। সেখানেও বরাদ্দ দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর থেকে। এ ছাড়া এই সচিবের বিরুদ্ধে রয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয় থেকে ভুয়া অসুস্থতা দেখিয়ে আত্মীয়স্বজনকে টাকার সুবিধা দেওয়া, বদলি-পদায়নে তার একাধিপত্যসহ নানা অভিযোগ। বদলি-পদায়নে তার যথেচ্ছাচারে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে, যার ফলে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তার অপসারণ চেয়ে আন্দোলনও করছেন কর্মকর্তারা।
দিন কয়েক আগে খবর বের হয়েছিল, গত সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের আত্মীয়স্বজন সবাই দুস্থ! তার মানে দরিদ্র মানুষকে ঠকিয়ে মন্ত্রী তার মেয়ে, জামাতা, স্ত্রীর ভাতিজারাসহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজনকে দিয়েছেন গরিবের সরকারি বরাদ্দের অর্থ সহায়তা। এমন হাজারও উদাহরণ হাজির করা সম্ভব। জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি সচিব এবং জনগণের একজন প্রতিনিধি, মন্ত্রী—উভয়েরই এই যে নৈতিক অধঃপতন বা দেশপ্রেমের অভাব অথবা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়হীন প্রবণতা, এ মানসিকতাকেই বিস্তর অর্থে দুর্নীতির প্রতীক হিসেবে যদি ধরা যায়, সেটা কি অত্যুক্তি হবে? আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে রাষ্ট্রের সর্বত্র সুশাসন ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হবে। দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত যত বড় ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, সে বিচার ও জবাবদিহির আওতায় আসবে।