ড. গোলাম ছারোয়ার
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৫৩ এএম
আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৪১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জনকল্যাণমুখীকরণে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার

জনকল্যাণমুখীকরণে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার

গত দেড় দশকের গ্লানিভরা স্বাস্থ্য খাত আজ নিভু নিভু করে চলছে। একটা জাতি কখনোই রুগণ অবস্থায় সম্ভাবনাময় স্বপ্ন দেখতে পারে না। পারে না শিরদাঁড়া সোজা করে চলতে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত একটি বৃহৎ খাত। এ সেক্টরে যেমন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রয়েছেন, তেমনি সাহায্যকারী স্টাফও রয়েছেন। সবাইকে নিয়ে স্বাস্থ্য খাত যদি সংস্কার না হয়, তাহলে একটি অসুস্থ জাতি গঠিত হবে। এখন প্রশ্ন হলো, স্বাস্থ্যের সংস্কার কোথায় কোথায় কীভাবে কত সময় ধরে প্রয়োজন। সংস্কার প্রক্রিয়া একটি সুনীতিগত চলমান প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত একটি অবহেলিত দুর্বৃত্তায়নের নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে এক দুষ্টচক্রের মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে। বিশেষ করে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে বিভিন্ন ধরনের সিন্ডিকেটের অশুভ লিপ্সায় চরম অবস্থায় নিপতিত। যার প্রতিফলন আমরা নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছি। সাধারণ জ্বর-কাশি হলেই দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য যেতে দেখা যায়। যদি একটি স্বয়ংক্রিয় জনকল্যাণমুখী টেকসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে এমন পরিস্থিতি দেখা যেত না। মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম হলো স্বাস্থ্য। এই স্বাস্থ্যকে সমুন্নত করতে হলে দুটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। একটি হলো জনস্বাস্থ্য এবং দ্বিতীয়টি সুচিকিৎসা।

কিন্তু অতি পরিতাপের বিষয়, প্রথমটি অর্থাৎ জনস্বাস্থ্য আমাদের দেশে চরমভাবে উপেক্ষিত। যার ভয়াবহ পরিণতি হিসেবে দ্বিতীয়টি অর্থাৎ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছে। দেশের সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে উপচেপড়া ভিড়। এমনকি বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতেও যে হারে রোগীর প্রেশার ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলছে, তা অবশ্যই অনাকাঙ্ক্ষিত। যদি উন্নত দেশগুলোর মতো জনস্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হতো, তাহলে চিকিৎসার জন্য নাগরিকের যে অর্থনৈতিক দেউলিয়া হওয়ার চরম বাস্তবতা, তা অনেকাংশে লাঘব হতো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত নেগলেকটেড ট্রপিক্যাল ডিজিজ (এনটিডি) থেকে তখনই রক্ষা পাওয়া সম্ভব, যখন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

একটি উদাহরণ দিলে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। ১৮৫৪ সালে যখন ইংল্যান্ডের লন্ডনে ব্রড স্ট্রিটে কলেরা নামক ভয়ানক রোগে ৬১৬ জন জীবন হারায়, তখন জন স্নো নামক প্রখ্যাত জনস্বাস্থ্যবিদ দেখলেন, অসুস্থ মানুষগুলো যে পানির উৎস থেকে পানি পান করেছিল, সেখান থেকেই এ ভয়ংকর জীবাণু পানির মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবাহিত হয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তিনি ওই পানির উৎসকে অকার্যকর করার মাধ্যমে কলেরা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন। হ্যাঁ, এখানেই জনস্বাস্থ্যের কৃতিত্ব। তাই জনস্বাস্থ্যকে জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই। বিগত কভিড-১৯-এর সময়ও মর্মে মর্মে আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব ও তাৎপর্য। যেখানে চিকিৎসাসেবা জনস্বাস্থ্যের অত্যন্ত সহায়ক ব্যবস্থাপনা হিসেবে কাজ করবে। নাগরিকের স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা ও তার প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরামর্শ প্রদান করাই আমাদের মতো জনস্বাস্থ্যবিদদের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা ও শিক্ষার মূল কাজ। এই কাজের গতি ত্বরান্বিত করার জন্যই প্রয়োজনীয় সংস্কার আশু প্রয়োজন। এ সংস্কারের মধ্যে রয়েছে গবেষণার পরিসর বৃদ্ধিকরণ। প্রতিটি জেলা, উপজেলা পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য ইউনিট চালু করা।

বর্তমানে এডিস মশার প্রজননকাল চলছে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৯ হাজার ৭৫ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১০৭ জন। একটি মৃত্যুও কাম্য নয়। ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার প্রজনন, আচরণ, ভাইরাস ছড়ানোর পদ্ধতি, লার্ভিসাইড ও অ্যাডাল্টিসাইডের প্রতি এডিস ইজিপ্টি ও এডিস অ্যালবোপিকটাসের প্রতিরোধ হয়ে ওঠার মাত্রা, ভাইরাসের ভিরুলেন্স হয়ে ওঠার মাত্রা প্রভৃতির গবেষণার জন্য উন্নতমানের গবেষণাগারের প্রতিষ্ঠা নিতান্ত প্রয়োজন, যা বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য বিষয়ে শীর্ষস্থানীয় পোস্টগ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, নিপসমে কীটতত্ত্ব বিভাগে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মিটিং মিনিটসের সিদ্ধান্ত রয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন বাস্তবায়ন। এই মলিকুলার ল্যাব প্রতিষ্ঠা হলে বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য তথা ভেকটর বোর্ন ডিজিজ নিয়ন্ত্রণে অভূতপূর্ব অগ্রগতির দ্বার উন্মোচিত হবে। একইভাবে সংক্রামক ও অসংক্রামক সব রোগের জন্য ডাটাবেজ বা জাতীয় তথ্যভান্ডার সংরক্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজন। নাগরিকের নিজস্ব খরচ স্বাস্থ্যের জন্য প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। এর নিয়ন্ত্রণের জন্য সংস্কার প্রয়োজন।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এবং ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের যৌথভাবে পরিচালিত এক গবেষণার তথ্যে দেখা যায়, ২০১৮ সালে তুলনায় গড় মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় ২০২৩ সালে তিনগুণ বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে, মাসিক ১ হাজার ৭০৪ টাকা। তবে এই বর্ধিত স্বাস্থ্যসেবায় খরচ সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে এক নয়। ধনী মানুষের মধ্যে এ ব্যয় ছয়গুণ এবং গরিবের মধ্যে তা দ্বিগুণ। গবেষণায় আরও দেখা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে অনেক ওষুধ কোম্পানি তাদের ওষুধের দাম বাড়িয়েছে অনেকগুণ। এ দামের পরিমাণ ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ওষুধ ও রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ এবং চিকিৎসক কর্তৃক নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের খরচ বিপর্যস্ত করেছে নাগরিক জীবনকে। সংস্কারের মাধ্যমে এই অতিরিক্ত অসহনীয় ব্যয় কমিয়ে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় ৪০-৫০ টাকায় নামিয়ে আনা সম্ভব। এর জন্য সব বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে সরকারকে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর রোগের বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য উপদেশকৃত প্রেসক্রিপশন যথার্থ নিরীক্ষার মধ্যে রাখতে হবে। ক্যাটাগরি অনুযায়ী শিশু ও মধ্যবয়সী, বৃদ্ধদের ডাটাবেজ তৈরি করে বারবার রোগের পরীক্ষা বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে অযাচিত পরীক্ষা ও ওষুধ লেখার প্রবণতা। ওষুধ কোম্পানিগুলোর দামি মোড়ক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে দামি উপহার প্রদানের অশুভ কালচার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যবহির্ভূত যেসব প্রভাবক আমাদের মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী, তার মধ্যে প্রধানতম হলো স্বাস্থ্য খাতে নাগরিকের ব্যয়। তাই স্বাস্থ্য অর্থনীতির সংস্কারের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সূচকের উন্নয়নই মূল লক্ষ্য। আমরা জানি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত প্রতি এক হাজারজন নাগরিকের জন্য চিকিৎসক মাত্র ০.৬৭ এবং নার্স ও মিডওয়াইফারি ০.৪৯ জন। তার ওপর ২৪ শতাংশ পদ শূন্য। সব মিলিয়ে WHO-এর নির্ধারিত মানদণ্ডের তুলনায় ৭৪ শতাংশ কম চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফারি নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে আমাদের স্বাস্থ্য খাত। এ খাতকে সংস্কারের জন্য প্রথমেই নজর দেওয়া দরকার জনবলের প্রতি। এরপর বিশেষায়িত চিকিৎসকদের ক্যাটাগরি অনুযায়ী পদায়িত নিশ্চিতকরণ। সুপরিকল্পিতভাবে চিকিৎসাসেবায় জনতুষ্টি আনতে হলে বিশেষায়িত চিকিৎসকের বিকল্প নেই। একই সঙ্গে গুরুত্ব সহকারে নজর দেওয়া প্রয়োজন হাসপাতালগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো এই বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের তীব্র সংকট নিয়েই চলছে। যার ফলে নবীন চিকিৎসকদের তীব্র সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

এক জরিপে দেখা যায়, দেশে ১০৭টি সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। সর্বমোট আসন সংখ্যা ১০ হাজার ৬৯৭টি। এর মধ্যে সরকারি ৩৭টি কলেজে রয়েছে ৪ হাজার ৩৫০ এবং ৭০টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে রয়েছে ৬ হাজার ৩৪৭টি আসন। এই বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো হাজারও অসংগতিতে পরিপূর্ণ। কিন্তু তারা সংকট কাটানোর সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও উদাসীন। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর অবকাঠামোর সঙ্গে সঙ্গে জনবলের বড়ই অপ্রতুলতা। এমন পরিস্থিতিতে কলেজগুলো হতে তৈরি ডাক্তারের কাছ থেকে প্রাপ্ত সেবায় নাগরিক তুষ্টি অনেক কষ্টসাধ্য। বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর মৃত্যু, রোগী ও তাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বাজে আচরণ, ভুতুড়ে চিকিৎসা খরচ স্বাস্থ্য খাতকে দিন দিন খারাপ থেকে খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

তাই এখনই সময় এ ভয়ানক পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হওয়ার। সংস্কার সব অংশেই প্রয়োজন। গত ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সুফল ঘরে তুলতে চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যবিদ, নার্স, মিডওয়াইফারি সবার সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার আশু প্রয়োজন।

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কী আছে আজ আপনার ভাগ্যে, জানুন রাশিফলে

ফুটবলারদের ধর্মঘটের চিন্তা: সঠিক পদক্ষেপ কী?

দুই বছরের মধ্যে বিলীন হবে ইসরায়েলের অস্তিত্ব : ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তার মরদেহ উদ্ধার

তাপপ্রবাহ কত দিন থাকবে, জানাল আবহাওয়া অধিদপ্তর

চাঁদপুরে বিএনপির দুপক্ষের ব্যাপক সংঘর্ষ, আহত অর্ধশতাধিক

আজকের নামাজের সময়সূচি

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

সিলেটে মাছধরা নিয়ে সংঘর্ষ, আহত ১০

১০

চাঁদপুরে উপজেলা ও পৌর বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত

১১

সিলেটের সড়কে চিনির বস্তা ছিনতাই, আটক ৪

১২

চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের কমিটি বিলুপ্ত, বহিষ্কার ২ নেতা

১৩

৭ দিনের রিমান্ডে অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর রহমান

১৪

বগুড়ায় যুবদলের সাবেক নেতাকে কুপিয়ে জখম

১৫

শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিএনপির ৩ নেতা বহিষ্কার

১৬

শাহবাগ থানা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গ্রেপ্তার

১৭

ঢাবি-জাবির ঘটনায় সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে জবিতে মশাল মিছিল

১৮

তোফাজ্জল হত্যায় ঢাবির ছয় শিক্ষার্থীর জবানবন্দি

১৯

পাহাড়ে সংঘর্ষের ঘটনায় ফখরুলের বিবৃতি

২০
X