আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার চোখ-চশমায় গত কদিনে বাংলাদেশের অবস্থান আগের চেয়ে অনেক দৃঢ়। বাংলাদেশে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০৪ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। দেশের ইতিহাসে বিদেশি ঋণের এটাই সর্বোচ্চ রেকর্ড। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, চলতি বছর জুন শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০৩ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন তথা ১০ হাজার ৩৭৯ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। টাকার অঙ্কে তা ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৪৭৮ কোটি। ২০০৯ সালের জুন শেষে সরকারের বিদেশি ঋণ ছিল ৫০ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। ১৫ বছর ৮ মাসের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
অর্থনীতির মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অর্থনৈতিক কূটনীতি একটু ভিন্ন কিছিমের হওয়ারই কথা। তার বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা, গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমর্যাদা বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে একটা ভিন্ন উচ্চতায় নেবে, সেটা তার বিরোধিতাকারীদেরও জানা। এরই মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের মূল্যমানে স্থিতিশীলতা আসছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি ১৫০ কোটি, বিশ্বব্যাংক ১০০ কোটি এবং যুক্তরাষ্ট্র ২০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। গত দুই দশকের মধ্যে এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ও অর্থ বিভাগের প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে গেছে। তারা বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনর্গঠন, আর্থিক খাতের সংস্কার এবং বিচার বিভাগ ও পুলিশ প্রশাসনের সংস্কারসহ নানা খাতে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে গেছে। দিয়েছে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও।
দেশের অর্থনীতিতে বাতি জ্বালাতে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে উপদেষ্টা পরিষদে নেওয়ার মধ্যেও একটা বার্তা ছিল। এ রসায়নের গুণে ধরা দিয়েছে কঠিন এ সময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার প্রাপ্তির খবরটি। ডলার সংকটসহ বিভিন্ন কারণে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ক্রমেই নিম্নগামী। প্রায় দুই বছর আগে থেকেই দেশে ডলার সংকট তীব্র থেকে তীব্র। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়সহ বিভিন্ন সূচকে স্বস্তি না থাকায় অর্থনীতি শুধু খাদের দিকেই যেতে থাকে। সেই জায়গায় উন্নয়ন সহযোগীদের আশ্বাস অনুযায়ী সহায়তা মিললে অর্থনীতি নতুন এক অভিযাত্রায় যাওয়ার আলামত স্পষ্ট।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জন্য ঋণ সহায়তা বাড়াবে। চলতি অর্থবছরে সংস্থাটি বাংলাদেশের জন্য ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের নতুন অর্থায়ন করতে পারবে। এ অর্থ অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন, বন্যা মোকাবিলা, দূষণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বায়ুর মান বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে সহায়তা করা হবে। বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রধান এটিও জনিয়েছেন যে, অতিরিক্ত ঋণ প্রদানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক এবারের অর্থবছরে বাংলাদেশকে সহজ শর্তে ঋণ এবং মঞ্জুরি মিলিয়ে প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার প্রদান করবে, যার মাধ্যমে বিদ্যমান প্রকল্পগুলোর তহবিল পুনর্বিন্যাসও করা হবে।
ওদিকে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক পরিচালক ম্যাথিউ এ ভারগিসের নেতৃত্বে একটি মিশন ঢাকা সফর করছে। বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে চলমান ঋণের পাশাপাশি বাড়তি কিছু অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রস্তাব চূড়ান্ত হয়েছে। এর মধ্যে পলিসি বেইজড লোন হিসেবে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার এবং ইনভেস্টমেন্ট লোন ও গ্যারান্টি ফ্যাসিলিটি হিসেবে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা দেওয়া হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের বোর্ডে এ ঋণের অনুমোদন হওয়ার কথা রয়েছে। বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে চলমান ঋণের পাশাপাশি বাড়তি কিছু অর্থায়ন চাওয়া হয়েছে।
যাবতীয় নমুনা বুঝে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা স্থগিত করা সরকারের আরেক কৌশল। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেক সবশেষ সভায় নেওয়া এমন সিদ্ধান্তের কথা আগে কারও ধারণায়ও আসেনি। এ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘এটি একধরনের রাজনৈতিক দলিল। রাজনৈতিক সরকার তাদের মতো করে পরিকল্পনা করবে, নীতিনির্ধারণ করবে। অন্তর্বর্তী সরকার বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবে না। তা রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসে নেবে। অতীতে দেখা গেছে, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা যা করার কথা ছিল, সেই অনুসারে বরাদ্দ বা বাজেট করা হয়নি। ফলে এসব পরিকল্পনার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে। ইউনূস সরকারও আর তা হতে দিতে চায় না।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দু-চারজন সালমান এফ রহমান বা এস আলমই বাংলাদেশের অর্থনীতি নয়। তবে, অর্থনীতিতে তারা অনন্য দানব হয়ে ওঠে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। এ সুযোগে তারা গোটা অর্থনীতিকে ফোকলা করে ছেড়েছে। তা সামলানোর ভার এখন ড. ইউনূস সরকারের ওপর। এ দায়িত্ব তিনি উতরানোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। ফল মিলতেও শুরু করেছে। অর্থনীতির রকমফের বুঝতে অর্থনীতিবিদদের কাছে বড় বড় ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের সোজাসিধা চোখ পণ্যমূল্যের দিকে। এর বিপরীতে অর্থনীতির ঝানু ব্যক্তিদের চোখ ঘোরে রপ্তানি, প্রবাসী আয়, বিদেশি সাহায্য আর বিদেশি বিনিয়োগের দিকে। বর্তমানে এগুলোর জন্য ‘ইউনূস গুডউইল’ ব্যবহারের বেশ রিহার্সেল চলমান। এর জেরে বাংলাদেশের দিকে যুক্তরাষ্ট্র, এডিবি, বিশ্বব্যাংকসহ বিশ্বসেরা মহলের চশমা-ঘড়ি তাক করা।
আগে বিভিন্ন প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় করাও যায়নি। এখন আর ওইসব প্রকল্পের প্রাসঙ্গিকতাও নেই। এমন প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এসব প্রকল্পে প্রায় ১০০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল। এখন বিশ্বব্যাংক বাজেট সহায়তা হিসেবে এসব অর্থ দিতে চায়। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এই অর্থ পাওয়া যাবে। পাইপলাইনে বিপুল পরিমাণ অর্থ পড়ে আছে। তাই বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে মনোযোগ দিয়েছে সরকার। এখন আর আগের মতো প্রকল্প পাস করিয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর মৌজমাস্তির সুযোগ থাকছে না। তাই বেছে বেছে সেদিনের একনেক সভায় চারটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে বাখরাবাদ-মেঘনাঘাট হরিপুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ (প্রথম সংশোধিত); দুটি মূল্যায়ন ও উন্নয়ন কূপ (সুন্দলপুর-৪ ও শ্রীকাইল-৫) ও দুটি অনুসন্ধান কূপ (সুন্দলপুর সাউথ-১ ও জামালপুর-১) খনন; ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন (দ্বিতীয় সংশোধিত) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান (দ্বিতীয় পর্যায়)। এসব প্রকল্পে খরচ হবে ১ হাজার ২২২ কোটি টাকা।
যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি ফিরে পাওয়া, না পাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় ঘটনা। ড. ইউনূস ব্যান্ডিংয়ে এ নিয়ে আশাবাদ ঘুরছে। এটি পেলে মার্কিন মল্লুকে পণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা আসবে। এর চেইন রিঅ্যাকশনে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরবে। রাজনৈতিক-কূটনৈতিক কারণে এতদিন তা বন্ধ ছিল। আবার কারখানাগুলোতে শ্রম অধিকার যথাযথভাবে না থাকা আরেকটি কারণ। আরও কিছু কমপ্লায়েন্স ইস্যুও ছিল। আর এর সুযোগ নিয়েছে বহিরাগত কিছু সুযোগসন্ধানী। এখন দেশের স্টিয়ারিংয়ে মার্কিনিদের প্রিয়ভাজন ড. ইউনূস। তার মাধ্যমে এই জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই আশাবাদী। সে ক্ষেত্রে এখন মালিক-শ্রমিক সব পক্ষের সংযত আচরণ প্রত্যাশিত।
অনেক জায়গায় শ্রমিকদের তাৎক্ষণিক বা নতুন নতুন দাবি ও বায়না সরকারকে নাস্তানাবুদ করে ফেলছে। প্রথাগত ব্যবসাকে হঠাৎ সামাজিক ব্যবসায় রূপান্তর সম্ভব না হলেও সম্ভাবনার রাস্তা তৈরি হয়েছে। আশির দশকের গোড়ার দিকে স্বল্পপরিসরে একটি অপ্রচলিত রপ্তানি খাত হিসেবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। সময়ের পরিক্রমায় দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে তৈরি পোশাকশিল্প খাত। এ খাতের হাত ধরেই দেশের অর্থনীতিতে এসেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। মাত্র ১২ হাজার ডলার রপ্তানি আয় দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই আসছে এ খাত থেকে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখছে। অন্তত ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, যার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই নারী। এ ছাড়া ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিঙ্কেজ মিলিয়ে শিল্প খাতটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে দেশের প্রায় পাঁচ কোটি লোক জীবন-জীবিকার জন্য এ শিল্পের ওপর কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল।
এ খাত অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারায় লিপ্তদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা সরকারের অন্যতম ফরজ কাজ। একই ধরনের প্রক্রিয়া কার্যকর করতে হবে ওষুধ, খাদ্যসহ অন্যান্য শিল্প খাতেও। এমনকি কিছু কিছু ব্যবসার কর্তাব্যক্তিদের নামে অভিযোগ থাকলেও, বিকল্প উপায়ে ব্যবসা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ বের করতে হবে। আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে প্রতিটি ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প ও ব্যবসা খাতে। এখানে সামান্যতম ছাড় দিলেই ভজঘট বাধবে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন