নামাজ আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার সেতুবন্ধ। এর মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্ত হয় এবং আল্লাহর কাছ থেকে অর্জন করে যাবতীয় চাওয়া-পাওয়া। নামাজের মাধ্যমে মুসলমানরা প্রতিদিন আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। তাই নামাজে আল্লাহর ধ্যান-খেয়াল ও পূর্ণ আন্তরিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছে, ‘নামাজি ব্যক্তি যতক্ষণ নামাজের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা নামাজির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন। আর নামাজি নামাজ থেকে অন্যদিকে ভ্রুক্ষেপ করলে আল্লাহও তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন।’ (আবু দাউদ)। মনোযোগবিহীন নামাজ নিষ্প্রাণ দেহের মতো। আল্লাহর কাছে এমন নামাজের মূল্য নেই। বরং এ ধরনের নামাজ নামাজির চেহারায় ছুড়ে মারা হয়। নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে, ধীরস্থিরভাবে নামাজে দাঁড়ায়, রুকু-সেজদা শান্তভাবে আদায় করে, একাগ্রতার সঙ্গে নামাজ পড়ে সে নামাজ উজ্জ্বল ও আলোকিত হয়ে ওপরে চলে যায় এবং নামাজির জন্য এভাবে দোয়া করে—আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করুন, যেভাবে তুমি আমাকে হেফাজত করেছ। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মন্দভাবে নামাজ আদায় করে, তার নামাজ কালো কুৎসিত হয়ে যায়। আর নামাজিকে এভাবে বদদোয়া দেয়—আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুন, যেভাবে তুমি আমাকে ধ্বংস করেছ। তারপর (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সে নামাজকে পুরোনো কাপড়ে পেঁচিয়ে (নামাজির) চেহারায় নিক্ষেপ করা হয়।’ (তাবরানি)
নামাজের আবেদন নষ্ট করে তিন কাজ—
নামাজে উদাসীন থাকা: যেসব নামাজি উদাসমনে বা অলসতা করে নামাজ পড়ে, তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠোর উক্তি করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘দুর্ভোগ ওইসব মুসল্লির জন্য, যারা তাদের নামাজ সম্পর্কে উদাসীন।’ (সুরা মাউন: ৪-৫)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ লিখেছেন, তারা হলো সেইসব লোক, যারা নামাজ থেকে উদাসীন ও খেল-তামাশায় ব্যস্ত। উদাসীন লোকদের মধ্যে একদল এমন আছে, যারা রুকু-সিজদা, ওঠা-বসা যথাযথভাবে করে না। কেরাত, দোয়া ও তাসবিহ যথাযথভাবে পাঠ করে না। কোনো কিছুর অর্থ বোঝে না বা বোঝার চেষ্টাও করে না। আজান শোনার পরও যারা অলসতাবশে এবং নামাজে দাঁড়িয়ে অমনোযোগী থাকে।
নামাজে তাড়াহুড়ো করা: যারা দায়সারাভাবে নামাজ পড়ে এবং নামাজের বিধিবিধানগুলো যথাযথভাবে পালন করে না। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) মসজিদে প্রবেশ করেন। তখন জনৈক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে নামাজ আদায় শেষে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সালাম দিল। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বলেন, তুমি যাও, পুনরায় নামাজ আদায় করো। কেননা তুমি নামাজ আদায় করোনি। এভাবে লোকটি তিনবার নামাজ আদায় করল। রাসুল (সা.) তাকে তিনবারই ফিরিয়ে দিলেন। তখন লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, তার কসম করে বলছি, এর চাইতে সুন্দরভাবে আমি নামাজ আদায় করতে জানি না। অতএব আমাকে নামাজ শিখিয়ে দিন! অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন তুমি নামাজে দাঁড়াবে তখন তাকবির দেবে। তারপর কোরআন থেকে যা পাঠ করা তোমার কাছে সহজ মনে হয়, তা পাঠ করবে। তারপর ধীরস্থিরভাবে রুকু করবে। অতঃপর সোজা হয়ে দাঁড়াবে। তারপর ধীরস্থিরভাবে সিজদা করবে। অতঃপর মাথা উঠিয়ে সোজা হয়ে বসবে। আর প্রত্যক নামাজ এভাবে আদায় করবে।’ (বোখারি: ৭৫৭)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় চোর ওই ব্যক্তি যে তার নামাজ চুরি করে। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! সে কীভাবে নামাজ চুরি করে? তিনি বলেন, সে নামাজে রুকু ও সিজদা পূর্ণ করে না।’ (মুসনাদে আহমাদ: ২২৬৯৫)।
নামাজে রিয়া অবলম্বন: যারা মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য নামাজে সৌন্দর্য ও বিনয় অবলম্বন করে, তাদের রিয়া অবলম্বনকারী বলা হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘...যারা লোকদেখানোর জন্য নামাজ পড়ে।’ (সুরা মাউন: ৬)। মুনাফিকরা মানুষকে দেখানোর জন্য নামাজ পড়ত। আল্লাহতায়ালা অন্য আয়াতে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোঁকা দেয় আর তিনিও তাদের ধোঁকায় ফেলেন। যখন ওরা নামাজে দাঁড়ায়, তখন অলসভাবে দাঁড়ায়, লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে। আর তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে।’ (সুরা নিসা: ১৪২)। আল্লাহতায়ালা লোকদেখানো ইবাদতকারীকে তার আমলসহ প্রত্যাখ্যান করেন। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি উপাসনায় অংশ নির্ধারণে সব অংশীদারের তুলনায় মুখাপেক্ষীহীন। যে ব্যক্তি কোনো আমল করে এবং তাতে অন্যকে আমার সঙ্গে শরিক করে, আমি তাকে ও তার আমলকে বর্জন করি।’ (মুসলিম: ২৯৮৫)।
আল্লাহ সবাইকে নামাজে এসব দোষ-ত্রুটি থেকে বেঁচে থাকার এবং নামাজের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার নৈকট্য অবলম্বনের তওফিক দান করুন।
লেখক: ইমাম ও খতিব