বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একটি সুশিক্ষিত জাতি গঠনের মূল কারিগর। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে উপাচার্যের নিয়োগ প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় উপাচার্য নিয়োগ হয়ে থাকে। প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ, সংবেদনশীল এবং সবার গোচরে হলে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ থাকবে না। আর এ ধরনের গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া অবলম্বন করে যিনি এ পদে আসীন হবেন, তার অঙ্গীকারের জায়গাটি থাকবে অসীম। তাই বিতর্কিত হওয়ার মতো কাজ করার আশঙ্কা থাকে না বললেই চলে। আমাদের এখনই এ নিয়ে ভাবতে হবে এবং সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনার সরকারের পদত্যাগের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করে আসছে। দুজন তরুণ সমন্বয়কসহ দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত হয়েছেন অনেক অভিজ্ঞও, যাদের হাত ধরে চলছে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ। ছাত্র-জনতার দাবির মুখে রাষ্ট্র সংস্কারের সবার অগ্রভাগেই হয়তো থাকবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সংস্কারের প্রশ্ন। বর্তমানে নানান সমস্যায় জর্জরিত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তাই এখন আর শুধু আলোচনা নয়, মানুষ বাস্তবমুখী সংস্কার চায়, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠবে সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারিগর।
এ কথা সত্যি যে, একসময় উপাচার্যদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সমাজ এবং দেশের আপামর জনসাধারণ যেভাবে শ্রদ্ধা এবং সমীহ করতেন, এখন আর সেভাবে করেন না। আর এজন্য সরকার ও সরকারের আমলাতন্ত্র যেমন দায়ী, ঠিক একইভাবে পদলোভী শিক্ষকরাও দায়ী। আর এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা সরকারের আজ্ঞাবহ ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো কিছু ভাবার সুযোগ থাকে না। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগবাণিজ্য, ক্ষমতার অপব্যবহার ও আধিপত্য করতে গিয়ে শিক্ষকরা জড়ো হন দলীয় রাজনীতির পতাকাতলে। রাজনীতিতে নেতার পদলেহনের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যের পদলেহনে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাই সর্বত্র চলে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা। সমাজের সবচেয়ে উচ্চশিক্ষিতরা কি পেরেছে এর মর্যাদা ধরে রাখতে?
উপাচার্য পদটি কেন এত লোভনীয়? ইদানীংকালের নানান ঘটনাপ্রবাহ এবং উপাচার্যদের আমলনামা বিশ্লেষণে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, কেন শিক্ষকরা এসবের দিকে নজর দেন? নিকট অতীতে দুর্নীতির টাকা পাচারে খোদ প্রধানমন্ত্রীর অফিস পিয়নের শতকোটি টাকার সংশ্লিষ্টতার যুগে শিক্ষকরাও এসবে গা ভাসিয়ে উঠেপড়ে লেগে যান। আর তাই শিক্ষক নেতারা এ পদে আসার জন্য কোটি টাকা বিনিয়োগেও পিছপা হন না বলে বিভিন্ন জাতীয় মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। যে কারণে থানার ওসির মতো নিয়োগ পাওয়ার পর, হাজারগুণ মুনাফাসহ টাকা আমদানিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন এসব উপাচার্য। এ যেন আজব খেলা!
এখন ভাবার সময় এসেছে। ভালো একাডেমিক রেজাল্টের পাশাপাশি একজন উপাচার্যের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে কমপক্ষে ৬০-৭০টি গবেষণা আর্টিকেল প্রকাশিত থাকা উচিত। এ ছাড়া যিনি উপাচার্য হবেন, তিনি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সভা ও সেমিনারে বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপন করায় অভিজ্ঞ হবেন। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি নেটওয়ার্ক থাকবে তার। এ ছাড়া একজন উপাচার্যের সততা, বিচক্ষণতা, সাহসিকতা, কর্মদক্ষতা এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। তবে এরকম একজন অনন্য দক্ষতার উপাচার্যের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে হলে অবশ্যই উপাচার্যের বেতনকাঠামো, সুযোগ-সুবিধা, কাজ করার স্বাধীনতা বিশ্বের সফলতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে তুলনাযোগ্য করে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নির্ধারণ করতে হবে।
আবার নিয়োগের পর উপাচার্যদের জবাবদিহির আওতায় আনা ও জরুরি। যাতে উপাচার্যরা নির্দিষ্ট মেয়াদকাল বা চার বছরের সময়কালটি শুধু নিজের একক সিদ্ধান্তে সবকিছু অন্যের ওপর চাপিয়ে না দিতে পারেন। তাই প্রতি বছরই উপাচার্যদের কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। মূল্যায়নের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি স্বতন্ত্র উইং অথবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্ধারিত পর্ষদ তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে তা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে পারেন। কর্তৃপক্ষ এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় করণীয় নির্ধারণ করবে এবং পর্ষদের মূল্যায়ন উপাচার্যকেও অবহিত করবেন, যাতে তিনি ভবিষ্যতে আরও ভালো কিছু করার প্রত্যয় ব্যক্ত করতে পারেন। বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিং নিয়ে যদিও নানান প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্ন যাই থাকুক, যে কোনো মানদণ্ডেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে পিছিয়ে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। ২০২৪ সালের কিউএস র্যাঙ্কিংয়ে দেখা যায়, সেরা ৭০০-১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়)। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৬৯১ থেকে ৭০০ অবস্থানে, বুয়েট ৮০১ থেকে ৮৫০ অবস্থানে ও নর্থ সাউথ ৮৫১ থেকে ৯০০ অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিংয়ে কেন আমরা পিছিয়ে পড়ি, তা নিয়ে কিছু আলোচনা হয় ঠিকই কিন্তু এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, সেটি আর কেউ গ্রহণ করে না। কেন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, রেটিং প্রদান করা সংস্থাগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা সূচকে বেশি গুরুত্ব দেয়। কারণ পরিচালনায় যুক্ত থাকা ব্যক্তির কাজের প্রতিফলন দেখা যায় শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষার্থী ভর্তিতে। কিন্তু আমাদের এখানে মানদণ্ডগুলো অনুসরণ করা হয় না। নিয়োগ প্রক্রিয়াও স্বচ্ছ নয়। আর এ বিষয়গুলোর কারণে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকা এবং শিক্ষকদের বর্তমান বেতন কাঠামোকেও দায়ী করেছেন এ শিক্ষাবিদ। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেসিক বিষয় হচ্ছে পর্যাপ্ত বরাদ্দ। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বাজেট সংকট এখনো বড় সমস্যা। দেশের জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত, সেখানে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২ শতাংশের কম, যা বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে যাওয়ারও অন্তরায়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো উচিত। সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক বিদেশে ডিগ্রি নিতে গিয়ে আর দেশে ফেরেন না। আর খুব কমসংখ্যক শিক্ষকই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত বেতন ও সুযোগ-সুবিধা পান, যে কারণে শিক্ষকরা গবেষণা ও প্রকাশনাতে আগ্রহী হন না। যদিও ব্যক্তিগতভাবে এ বিষয়গুলোকে অভারকাম করে অনেক শিক্ষকই ভালো করছেন। অনেক হতাশার মধ্যেও তারা জাতিকে পথ দেখাচ্ছেন। আর তাই শিক্ষকদের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সংস্কারের ভাবনাটি এখনই সময়। সংস্কার করে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মূল্যায়িত করতে না পারলে এ জাতি আর কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।
লেখক: অধ্যাপক, কৃষি রসায়ন বিভাগ
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
ইমেইল: [email protected]