কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৮ এএম
আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:২৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অন্তর্বর্তী শিক্ষা কমিশন কেন দরকার

মো. মুজিবুর রহমান
অন্তর্বর্তী শিক্ষা কমিশন কেন দরকার

রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার উদ্দেশ্যে কয়েক দিন আগে সুনির্দিষ্ট ছয়টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যে ছয়টি ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠনের ঘোষণা এসেছে সেগুলো হলো—নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এবং সংবিধান সংস্কার কমিশন। ঘোষিত ছয়টি কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে কমিশনের প্রধান হিসেবে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিকের নামও প্রকাশিত হয়েছে। আমরা আশা করি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কমিশন উপযুক্ত সুপারিশমালা প্রণয়ন করে সরকারের কাছে পেশ করবে।

কিন্তু শিক্ষা দেশের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদার একটি হলেও এ নিয়ে কোনো কমিশন গঠনের ঘোষণা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। হয়তো পরবর্তীকালে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে কোনো কমিশন বা কমিটি গঠন করা হলে হতেও পারে। তবে শিক্ষা সচেতন নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষা কমিশন গঠন নিয়ে যথেষ্ট ঔৎসুক্য বিরাজ করছে। কারণ, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিটি রাষ্ট্রে যত রকমের উন্নয়ন ঘটে, তার সবই ভিত্তি হিসেবে কাজ করে একটি কার্যকর ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাকে বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়ন কার্যক্রমের কথা চিন্তাও করা যায় না। এ কারণে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার বা উন্নয়ন করা অনেক জরুরি।

বর্তমানে দেশের প্রায় সব স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা একরকম ভেঙে পড়েছে। নিচের স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ব্যাপকহারে অনুপস্থিতির ফলে শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে পরিচালনা করা যাচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা দিন দিন কোচিংমুখী হয়ে পড়ছে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে বর্তমানে নবম শ্রেণিপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। তারা দশম শ্রেণিতে উঠে কী পড়বে, কীভাবে তাদের মূল্যায়ন হবে, এসব নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা আসেনি।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণোদ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে। তবে কোথাও কোথাও অনলাইনে ক্লাস চালু করা হয়েছে। আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদ শূন্য রয়েছে। ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় গুরুতর বিঘ্ন ঘটছে। এ পরিস্থিতি থেকে দ্রুত উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে।

শিক্ষাক্ষেত্রে আরও যেসব সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে প্রধান হলো—মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম আধুনিকায়ন করা সংক্রান্ত। মাধ্যমিক স্তরের জন্য ২০২১ সালে একটি শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছিল। পরে এটি ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। এর আগের শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছিল ২০১২ সালে। প্রায় ৯ বছর পর একটি নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হলেও, শুরু থেকেই এটি নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে নানারকমের আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে। অভিভাবকদের অনেকেই এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এমনকি তারা নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবি জানিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন। শিক্ষকদের এক বিরাট অংশও এ নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আপত্তি তুলে ধরেছেন। এ শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্ধারণগত জটিলতা বিরাজ করছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে। বেশিরভাগ শিক্ষক নতুন শিক্ষাক্রমে বর্ণিত মূল্যায়ন পদ্ধতি বুঝতে পারেননি। তা ছাড়া শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে এনসিটিবি থেকে প্রদত্ত নির্দেশনা ঘন ঘন পরিবর্তন করার কারণে শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্তিতে পড়েছে। পাঠ্যপুস্তকেও রয়েছে নানা ধরনের সমস্যা ও অসংগতি। পরীক্ষার ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রচলিত গ্রেডিং সিস্টেমকেও উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে সন্তানের ভবিষ্যৎ উচ্চশিক্ষা নিয়ে অভিভাবকরা দুর্ভাবনায় পড়েছেন।

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নতুন শিক্ষাক্রম পরিবর্তন ও সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, এ বছরের শেষে মাধ্যমিক স্তরে যে পরীক্ষা হওয়ার কথা রয়েছে, তা হবে তিন ঘণ্টার। এর আগে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে পাঁচ ঘণ্টা ও ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চার ঘণ্টার মূল্যায়নের কথা ছিল। তবে মূল্যায়ন ব্যবস্থা নিয়ে এনসিটিবি চূড়ান্ত নির্দেশনা দেবে বলে জানা গেছে। কিন্তু নির্দেশনা যাই আসুক না কেন, বর্তমান শিক্ষাক্রমের পুরোটাই পরিমার্জন বা সংস্কার করতে হবে। প্রয়োজনে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম থেকে অভিজ্ঞতা নিতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষাক্রম প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক নিচের শ্রেণি থেকে পরবর্তী ওপরের শ্রেণির বিষয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং একইভাবে একই শ্রেণির প্রতিটি বিষয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে। একটি ভালো ও বাস্তবভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়নের জন্য নির্দিষ্ট প্রবাহ থাকতে হবে। এটি শুধু পাঠদানের বিষয়বস্তুর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক নয়, বরং অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে একটি আন্তঃসম্পর্ক থাকতে হবে। এই লক্ষ্যে শিক্ষাক্রম প্রণয়নের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন, শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শনাক্তকরণ, পাঠের বিষয়বস্তু ও পাঠদান পদ্ধতি নির্ধারণ, শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন এবং শিক্ষাক্রম মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এসব ধাপের কোনোটা উপেক্ষা করে ভালো শিক্ষাক্রম তৈরি করা যায় না।

বর্তমান শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করে নতুন করে করতে গেলে যে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিশ্চিত করা দরকার তা হলো, যারা এ শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে বিগত দিনে জড়িত ছিলেন, তাদের পুনরায় এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন করে নতুন আঙ্গিকে নতুন ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিতে হবে। বিশেষভাবে লক্ষ রাখা দরকার শিক্ষাক্রম বিষয়ে যাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে, অর্থাৎ যারা সত্যিকারভাবেই শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, তাদের হাতেই এর দায়িত্ব তুলে দিতে হবে। এর কারণ, শিক্ষা ক্যাডারে কর্মকর্তাদের বিভিন্ন বিশেষায়িত পদে পদায়নের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও দক্ষতা দেখার তেমন কোনো রেওয়াজ নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে (নায়েম) প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ নামে কিছু পদ আছে। এসব পদে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারাই পদায়ন পেয়ে থাকেন। কিন্তু পদায়নের ক্ষেত্রে পদের নিজস্ব যোগ্যতা বিবেচনা না করে শুধু ক্যাডার কর্মকর্তা হলেই পদায়ন হয়ে যায়! অনেক সময় তদবির বেশি কাজ করে। অথচ শিক্ষা ক্যাডারে প্রশিক্ষণে ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব নেই।

একইভাবে এনসিটিবিতে কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ নামে যেসব পদ রয়েছে, সেসব পদে শিক্ষা ক্যাডার থেকে পদায়ন হলেও ওই বিশেষায়িত পদে পদায়িত অনেকেরই কারিকুলাম বিষয়ে কোনো ডিগ্রি বা প্রশিক্ষণ তো থাকেই না, এমনকি কারিকুলাম সম্পর্কে সাধারণ ধারণাও থাকে না। ফলে এসব কর্মকর্তার কেউ কেউ কারিকুলাম প্রণয়ন করতে গিয়ে শিখনফল, শিখন অভিজ্ঞতা, শিখন দক্ষতা, পাঠদান পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে একপ্রকার তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। অথচ কারিকুলামে পিএইচডি করা শিক্ষকও আমাদের শিক্ষা ক্যাডারে আছেন। এনসিটিবিতে যারা সম্পাদক, প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান, তাদের সবারই সম্পাদনার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার। যদি এমনটি করা হয়, তাহলে আর এনসিটিবি প্রকাশিত বইয়ে এত ভুল থাকার কথা নয়। অনেক সময় শুধু সম্পাদনার ভুলের কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা যায়!

আলোচ্য সমস্যার বাইরে আরও নানামুখী সমস্যায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা একপ্রকার জর্জরিত। এসব সমস্যা যেমন এক দিনে দূর করা সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি সরকারি সাধারণ আদেশ, পরিপত্র, প্রজ্ঞাপন জারি করে এগুলো নিরসন করা যাবে না। এর জন্য দরকার একটি উপযুক্ত শিক্ষা কমিশন। যেহেতু এখন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালনা করছে, তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা আশা করি, প্রায় ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরে সংস্কারের জন্য অতি দ্রুত একটি উপযুক্ত অন্তর্বর্তী শিক্ষা কমিশন গঠন করা হবে।

লেখক: অধ্যাপক (শিক্ষা) ও প্রাক্তন অধ্যক্ষ

সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (মহিলা), ময়মনসিংহ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাবির আওয়ামীপন্থি সিন্ডিকেট সদস্যদের পদত্যাগ দাবি

গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা জাতিসংঘে তুলে ধরবেন ড. ইউনূস

মিরপুরে ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের বিক্ষোভ

প্রকাশ পেল ইকরাম কবীরের ‘খুদে গল্পের বই’

সৈনিক থেকে শিল্পপতি হাবিবুর

‘নবীর দেখানো পথে রাষ্ট্র উপহার দিতে চায় জামায়াত’

টাঙ্গাইলে বাস-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২

১৬ বছর পর সাতক্ষীরায় জামায়াতের রুকন সম্মেলন

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

ঢাবিতে হত্যাকাণ্ডে ৮ শিক্ষার্থীর সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি

১০

দলের নির্দেশনা না মানলে কঠোর পরিণতির হুঁশিয়ারি নয়নের

১১

মোংলায় নিলামে উঠছে ৪০ গাড়ি

১২

শনিবার বিদ্যুৎ থাকবে না সিলেটের যেসব এলাকায়

১৩

একদিনে ৬ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করল চীন

১৪

বগুড়া জেলা ছাত্রদলের নতুন কমিটিকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল

১৫

নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে অর্থায়ন দাবিতে মোংলায় র‌্যালি

১৬

হত্যাকাণ্ড নিয়ে অপপ্রচারের প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্রদল

১৭

‘হাসিনা লুকিয়ে থেকে তার প্রেতাত্মাদের উসকে দিচ্ছে’

১৮

পিটিয়ে মানুষ হত্যা ও ঢাবিতে রাজনীতি বন্ধে ইউট্যাবের উদ্বেগ

১৯

নাশকতার মামলায় আসামি হলেন ৫ সাংবাদিক

২০
X