এম এম আকাশ
প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৮ এএম
আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:২৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশেষ সাক্ষাৎকার

রাজনীতি ঠিক না হলে সব পদক্ষেপ ব্যর্থ হবে

রাজনীতি ঠিক না হলে সব পদক্ষেপ ব্যর্থ হবে

এম এম আকাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। তার মূল আগ্রহের বিষয় গ্রামীণ আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, দারিদ্র্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং একবিংশ শতকের সমাজতন্ত্র। ছিলেন মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির প্রথম পরিচালনা বোর্ডের সদস্য। বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের চেয়ারম্যান। বাংলা একাডেমি ও অর্থনীতি সমিতির আজীবন সদস্য। তার উল্লেখযোগ্য বই—ভাষা আন্দোলনের শ্রেণীভিত্তি ও রাজনৈতিক প্রবণতাসমূহ, বাংলাদেশের অর্থনীতি: অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং Poverty Reduction Strategies of the International Development Community: The scope for structural change. তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন—

কালবেলা: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। দেশের মানুষের মধ্যে জাগরণকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

এম এম আকাশ: ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের আগে তাদের কিছু সমস্যা, অভিযোগ এবং চাওয়া ছিল। একই সঙ্গে জনগণ, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা দিক থেকে প্রতারিত এবং ভুক্তভোগী হয়ে এক ধরনের ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। ছাত্র ও জনতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে এবারের গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যাপকভাবে মানুষ অংশগ্রহণ করেছে এবং তাদের ঠিকমতো সামলাতে পারেনি সরকার। শেষ পর্যন্ত জনগণ স্বৈরাচারকে বিদায় করে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। অনেকে এ গণঅভ্যুত্থানের পেছনে অনেক রকম ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা বলতে পারেন। যেমন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন দ্বীপ চেয়েছে। তাদের সেন্টমার্টিন দ্বীপ দিলে তারা আমাকে ক্ষমতায় রাখবে। শেখ হাসিনা এ কথাটি বলেছিলেন নির্বাচনের আগে। অবশ্য আমেরিকাকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ না দিয়েও নির্বাচনে তিনিই জয়লাভ করেছেন। কিন্তু এ জয় সাধারণ পন্থায় হয়নি। অন্য সব দল নির্বাচন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল এবং এর ফলে তিনি খোলা মাঠে গোল দিয়েছিলেন। নিজের দলের লোকদেরকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে বিরোধী দল বানিয়েছিলেন।

দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মনে এটি বড় প্রশ্ন ছিল—কীভাবে গণতন্ত্র আবার ফেরত আনা যায়। বিশেষ করে সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে এমন একটি নির্বাচন দেখতে চাইছিল মানুষ। মানুষ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে চেয়েছে। ভোটের মাধ্যমে যে জিতবে সেই ক্ষমতা গ্রহণ করবে। কিন্তু শেখ হাসিনা আবারও নির্বাচন জালিয়াতির মাধ্যমে জনগণের গণতন্ত্রের সেই প্রত্যাশা শেষ করে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু এরপর তার আমলে হওয়া পরপর তিনটি নির্বাচন ছিল অগণতান্ত্রিক।

শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে আয়োজিত তৃতীয় নির্বাচন অর্থাৎ ২০২৪ সালের নির্বাচনেও যখন জনগণের ভোট দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো না, তখন জনগণের ক্ষোভ ছাড়া আর কোনো আশা অবশিষ্ট থাকল না। ভোট দিতে না পারার এ ক্ষোভ জনগণকে শেখ হাসিনার সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতে তাড়িত করেছে। এমনকি গণঅভ্যুত্থানের পরেও আমরা সেই গণতন্ত্রের রেখা দিগন্তে দেখতে পাচ্ছি না। এই মুহূর্তে ক্ষমতায় থাকা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে, তারা কিছু মৌলিক সংস্কার করবে, তারপর পরিস্থিতি অনুকূল হলে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের আয়োজন করবে।

কালবেলা: মৌলিক সংস্কার বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?

এম এম আকাশ: মৌলিক সংস্কার বলতে কতটুকু সংস্কার বোঝানো হচ্ছে বা কী করলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য অনুকূল হবে, এটাই এখন বড় প্রশ্ন। সংস্কার প্রশ্নে এখানে দুটি দিক রয়েছে—একটি হলো মৌলিক সংস্কার; অন্যটি হলো রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা এবং দলগুলোকে নির্বাচনে নিয়ে আসা। যদি মৌলিক সংস্কার করতে হয় তাহলে কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু যেহেতু এ সরকার কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, তাই সংস্কারের জন্য বেশি সময় নিলে রাজনৈতিক দলগুলো অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে। এরই মধ্যে সেই অসহিষ্ণুতা আমরা দেখতে শুরু করেছি। প্রধানত এ অসহিষ্ণুতা দেখা যাচ্ছে বিএনপির দিক থেকে। বিএনপি মনে করছে, আওয়ামী লীগ একটি স্বৈরাচারী কায়দায় উৎখাত হওয়ায় এই মুহূর্তে মাঠ খালি। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হবে, তত তাড়াতাড়ি তারা নির্বাচনে জিতে অর্থাৎ খোলা মাঠে গোল দিয়ে ক্ষমতায় আসবে।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ভাবছে, এবার আমরা বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনে না গিয়ে আলাদাভাবে গেলে হয়তো বেশি লাভ। ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী হয়তো চাচ্ছে এ সরকারকে কিছুটা সময় দিতে। কিন্তু বিএনপি কোনোভাবেই সময় দিতে চাচ্ছে না। অন্যদিকে বামপন্থিরা বলছে, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি রোডম্যাপ দিক। এরপর এই রোডম্যাপ দেখে আমরা ঠিক করব সংস্কারের জন্য তাদের যৌক্তিক সময় কতটুকু লাগবে। তারা যৌক্তিক সময় দিতে রাজি কিন্তু এর বেশি সময় দিতে রাজি নয়। তাদের আরেকটি আশঙ্কার জায়গা হলো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি বেশি সময় পায় তাহলে এর মধ্যে আরেকটি তৃতীয় দল অর্থাৎ কিংস পার্টি তৈরি হতে পারে। এ ধরনের কিংস পার্টির নমুনা আমরা অতীতেও দেখেছি। এক অর্থে বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি এরকমই কিংস পার্টি ছিল।

কালবেলা: আন্দোলনে মূল শক্তি ছিল ছাত্র, বর্তমানে তাদের অবস্থা কী?

এম এম আকাশ: কোটা সংস্কার আন্দোলনের মূল যে ছাত্রশক্তি, তাদের আমরা দুই ভাগে ভাগ হতে দেখেছি। এক ভাগ বলেছে, আমরা রাজনীতি করব না, আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে থাকব এবং ক্ষমতার অংশীদার হব। তারা সেই লক্ষ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান বানিয়েছে এবং এ সরকারের মধ্যে দু-একটি পদও নিজেদের করে নিয়েছে। আর ছাত্রদের আরেকটি ভাগ রাজনৈতিক দল তৈরি করার কথা ভাবছে। কিন্তু এ ভাগটি আবার যখন বিভিন্ন জায়গায় মানুষের কাছে তাদের এজেন্ডা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, সেখানে বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে। ময়মনসিংহ এবং বগুড়ায় আমরা এরকমই ঘটনা দেখলাম। সব মিলে এখানে এক ধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতি বিরাজমান।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ প্রচার করছে, দেশে বিএনপি-জামায়াত-শিবির ক্ষমতায় আসবে এবং সাম্প্রদায়িকতা কায়েম হবে। তার লক্ষণ আপনারা দেখতে পাচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় বসার সঙ্গে সঙ্গে লুটপাটসহ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও তাদের সম্পত্তি দখল বেড়ে গেছে। সরকার পতনের প্রথম দিকে কিছুটা লুটপাট হয়েছে আমরা দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি লুট হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন অর্থাৎ গণভবন লুট হয়েছে। অনেকে এ লুটগুলোকে বলছেন বিক্ষোভের প্রতিফলন। কিন্তু আমার সেটা মনে হয় না। আমার মনে হয় এ লুটপাটের পেছনে সচেতন উদ্দেশ্য ছিল। সচেতন কিছু লোক মিলেই এটা করেছে।

কালবেলা: আইনশৃঙ্খলা স্থিতিশীল হচ্ছে না কেন?

এম এম আকাশ: আন্দোলনের সময় পুলিশ যেভাবে নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, তাতে পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ চরম আকারে পৌঁছে গিয়েছিল। এমনিতেই ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা কারণে মানুষ পুলিশের ওপর বিরক্ত ছিল। তার ওপর এই গণআন্দোলনে পুলিশের গুলি চালানো এবং শত শত মানুষের প্রাণহানি পুলিশের প্রতি মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেছে। হাসিনার পতনের পর মানুষ পুলিশের ওপর চড়াও হলে পুলিশ জান বাঁচাতে থানাগুলো থেকে পালিয়ে যায়। পুলিশ পালিয়ে যাওয়ার ফলে আইনশৃঙ্খলার আরও অবনতি ঘটে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পুলিশকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে কাজে ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

কালবেলা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন দিকে? মানুষের প্রত্যাশা কী?

এম এম আকাশ: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতির ভিত্তিতে আমরা যদি ভবিষ্যৎ দেখার চেষ্টা করি, তাহলে প্রথমেই কিছু মৌলিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখি। এমন কতগুলো সংস্কার করতে হবে যাতে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়। আমার ভোট আমি দেব এবং যাকে খুশি তাকে দেব—এ সুযোগ যেন মানুষ পায়। প্রাথমিক সংস্কার এমন হতে হবে যাতে মানুষের জরুরি প্রত্যাশাগুলো পূরণ হয়। সরকারকে মানুষের ন্যূনতম প্রত্যাশা বুঝতে হবে। এ জরুরি প্রত্যাশাগুলোর মধ্যে একটি হলো ব্যাংকের ঋণখেলাপি রাঘববোয়ালদের ধরা। বড় বড় দু-তিনজন ঋণখেলাপিকে ধরে শাস্তি প্রদান এবং তাদের হাতে থাকা অর্থ ব্যাংকে ফেরত আনা সম্ভব হলে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। অনেকে বলছে, এস আলমকে ধরতে হবে। তার কাছে থাকা ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা যদি নগদ অর্থে ফেরত না পাওয়া যায়, তাহলে দেশে এবং বিদেশে তার স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ব্যাংকের এ টাকা পূরণ করা হোক। বিদেশ থেকে আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় এসব পাচার হওয়া সম্পদ ফেরত আনা সম্ভব। এ ধরনের উদ্যোগ অন্তর্বর্তী সরকারের নিচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে। এ উদ্যোগ যদি কার্যকর হয়, তাহলে তা এ সরকারের জন্য একটি বড় সফলতা হবে।

বড় বড় ঋণখেলাপির থেকে ব্যাংকের পাওনা টাকা ফিরিয়ে আনতে পারলে দুটি দিকে লাভ হবে। প্রথমত ব্যাংকগুলো আবার দাঁড়িয়ে যাবে এবং দ্বিতীয়ত পাচার হয়ে যাওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আসবে। মানুষ প্রত্যাশা করে, খুব দ্রুত দ্রব্যমূল্য কমবে। এখন পর্যন্ত এটা সম্ভব হয়নি, সরকার দ্রব্যমূল্য কমানোর জন্য এখনো কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি। নতুন সরকার এখনো সেই পুরোনো পলিসিই অনুসরণ করছে। নীতি পরিবর্তন করে হোক বা আমদানি করে হোক, দ্রব্যমূল্য কমানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার।

সরকার এখনো এখানে সেখানে গাড়িতে করে টিসিবির পণ্য বিক্রি করছে। এটা কার্যকর কোনো পন্থা নয়। আমাদের মানতে হবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক দ্রব্যের জন্য আমরা ভারতের প্রতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই ভারতের সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় গিয়ে পণ্য আমদানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিকল্প আমদানির উৎসও খুঁজে বের করতে হবে। কতটুকু পণ্য আমদানি করতে হবে তার একটি পরিষ্কার চিত্র বা হিসাব থাকতে হবে। আমাদের দেশের উৎপাদন এবং চাহিদার মধ্যে বিদ্যমান ব্যবধান পূরণের জন্য একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দরকার। বাজারে যাতে সংকট তৈরি না হয়, সেজন্য কোন দ্রব্য কোন সময় কতটুকু আমদানি করতে হবে তার আগে থেকেই একটি পরিকল্পনা থাকতে হবে। বাজারে পণ্য সংকট এবং সমাধান এ ব্যাপারে ১৯৯০ সালে যখন টাস্কফোর্স তৈরি হয়েছিল, তখন ড. মাহবুব হোসেন সরকারকে পর্যাপ্ত পরিমাণ গুদাম তৈরির পরামর্শ দিয়েছিলেন। সরকারের সেই গুদামে চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্য সবসময় মোট চাহিদার অন্তত এক-তৃতীয়াংশ মজুত থাকতে হবে। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ থাকবে বাজারের হাতে। বাজারে সিন্ডিকেট তৈরি হলে সরকারের গুদাম থেকে পণ্য ভোক্তাদের হাতে ছাড়তে হবে।

তবে বর্তমান সরকারপ্রধানের ফিলোসফির সঙ্গে এ সূত্রটি মিলবে কি না, জানি না। কারণ ড. ইউনূস উন্মুক্ত বাজার এবং লিবারেলিজম ফিলোসফিতে বিশ্বাস করেন। যদিও এক-এগারোর পর তিনি যখন রাজনৈতিক দল তৈরি করেছিলেন তখন সোশ্যাল লিবারেলিজমের কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ তিনি লিবারেলিজমের পাশাপাশি সোশ্যাল অ্যাসপেক্টটাও দেখতে চাইছিলেন। যদি তিনি এখনো সেই ফিলোসফিতে বিশ্বাসী হয়ে থাকেন, তাহলে সরকার হয়তো মাহবুব হোসেনের সেই পরামর্শ গ্রহণ করবে। যেহেতু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রয়েছেন সালেহউদ্দিন আহমেদ, তাই আমি আশা করি এখানে বাজারে কিছুটা পাবলিক এবং প্রাইভেট নিয়ন্ত্রণের সংশ্লেষণ ঘটতে পারে। আর এটা হলে তা অবশ্যই দেশের মানুষের জন্য উপকারী হবে।

সরকারকে তৃতীয় সংস্কার করতে হবে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে। এ দুটি ক্ষেত্রে বিগত সরকারের আমলে যে অরাজকতা আমরা দেখেছি, তা একটি দেশের জন্য লজ্জাজনক। শিক্ষা খাতে এমনকি নতুন পাঠ্যক্রম নিয়েও রয়েছে তীব্র সমালোচনা। অন্তর্বর্তী সরকার পাঠ্যক্রমে সংস্কার আনতে চাইছে। স্বাস্থ্য খাতে লুটপাট এবং অরাজকতা আমরা দেখেছি। সরকারকে লক্ষ রাখতে হবে, যাতে এ খাতে এক দখলদারের পরিবর্তে আরেক দখলদার গেড়ে না বসে। ড. ইউনূস জাতির উদ্দেশে দুটি বক্তব্য দিয়েছেন। ওই বক্তৃতায় তিনি যেই পজিশন ব্যক্ত করেছেন, তা মোটামুটি ভালো। বিভিন্ন খাতের সংস্কারে যে লোকদের তিনি বেছে নিয়েছেন তারাও ভালো। সরকার যদি ড. ইউনূসের ঘোষিত অবস্থানের ভিত্তিতে অগ্রসর হয়, তাহলে একটা ভালো পরিবেশ সৃষ্টি হবে বলে আমরা আশা করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই সংস্কার টেকসই হবে কি না, তা নির্ভর করবে নির্বাচনে কোন শক্তি ক্ষমতায় আসবে তার ওপর। আমরা যদি এক দখলদারের পরিবর্তে আরেক দখলদার পাই, তাহলে সেটা কোনোভাবেই ভালো হবে না।

শেখ হাসিনা চীন, আমেরিকা, রাশিয়া এবং ভারতের সঙ্গে এক ধরনের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করেছিলেন। এখন যদি দেশের পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি আমেরিকা বা ভারতের দিকে চলে যায়, যদি চীন-রাশিয়ার বিরুদ্ধে চলে যায়; তাহলে তা জাতীয় স্বার্থের অনুকূল হবে না। আবার দেশ যদি পুরোপুরি ইসলামিক ভারসাম্যের দিকে চলে যায়, যদি ইসলামিক স্টেট তৈরি হয় বা ইনক্লুসিভনেসের নামে যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জঙ্গি সংগঠনকে উন্মুক্ত অধিকার দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে রাজনীতিতে আর সমাধান হবে না। রাজনীতি ঠিক না হলে সব অর্জন, সব ঘোষণা ও সব পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়ে যাবে।

কালবেলা: বাংলাদেশে অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজনীতিকে ব্যবহার করা হয়েছে। এ সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করা যেতে পারে?

এম এম আকাশ: প্রথমত, রাজনীতিতে যাতে অর্থের প্রভাব কমে তার জন্য ভোটের সিস্টেমকে পরিবর্তন করতে হবে। শুধু টাকা-পয়সা ও দুর্বৃত্তায়ন দিয়ে ১০০টির মধ্যে ৫১টি আসন জিতলেই ক্ষমতায় যেতে পারবে না। কে জিতবে, কে হারবে সেটা পরের কথা, আগে সামনে আসবে কোন নীতি জিতবে এবং কোন নীতি হারবে। অর্থাৎ নির্বাচনটি হতে হবে নীতির ভিত্তিতে। সরকার খুব সহজেই এটা করতে পারে যদি আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু করে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এ ব্যবস্থায় নির্বাচন হয়। আনুপাতিক হারে আসন বণ্টন হলে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সবকিছু দখল করার ঘটনা ঘটে না। ফলে ভোটে অংশগ্রহণকারী সবারই ক্ষমতায় অংশ থাকে। সারা দেশে একটি দল মোট কত শতাংশ ভোট পেল সেটা দেখা হবে। নির্বাচনের আগে দলগুলো জনগণের সামনে তাদের নির্বাচনী ম্যানুফেস্টো তুলে ধরবে এবং তার নীতি ব্যাখ্যা করবে। তাহলে নির্বাচনে টাকার প্রভাব কমে আসবে।

আমরা জানি আওয়ামী লীগ টাকার দ্বারা চলত। সুতরাং টাকাওয়ালা লোকদের নমিনেশন দিতে হতো। না হলে দলের কোষাগারে তারা টাকা দিত না। আর টাকা না দিলে তারা কীভাবে নির্বাচন করবে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব হলে টাকার জোরের বিষয়টি আর থাকবে না। কারণ টাকাটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো ভালো প্রার্থী। যোগ্য, পড়াশোনা জানা, ভালো কথা বলতে পারেন এরকম যোগ্য প্রার্থী নমিনেশন পাবেন। ড. ইউনূস এ আন্দোলনটি আগে শুরু করতে চেয়েছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, তিনি যোগ্য প্রার্থীর এ আন্দোলন করে সফল হতে পারছেন না। সফল না হওয়ার জন্য তিনি দুটি কারণ বলেছিলেন, তার একটি হলো—প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যোগ্য প্রার্থীর চেয়ে টাকাওয়ালা এবং ক্ষমতাবান প্রার্থীকে মনোনয়ন বেশি দিচ্ছে। এ পদ্ধতি চালু থাকলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে না।

কালবেলা: লুটপাটের ক্ষেত্রে আমলা, রাজনীতিক, ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের যোগসাজশ বিগত সময়ে দেখা গেছে। এটি কীভাবে ভাঙা যায়?

এম এম আকাশ: প্রথমত নির্বাচনের সিস্টেমটি পরিবর্তন করতে হবে। টাকার বদলে পলিসি ও বিতর্ককে প্রাধান্য দিতে হবে। দলগুলো বাধ্য হবে পলিসি ও বিতর্কে ভালোদের মনোনয়ন দিতে। এটা করতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। নির্বাচন কমিশনকে এ দায়িত্ব নিতে হবে। দলের ভেতরে আগে গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনের আগেই প্রত্যেক দলকে প্রার্থী তালিকা দিতে হবে। সেখানে একটি দল যদি সব ব্যবসায়ীর নাম তুলে দেয়, সেটা জনগণের কাছে পরিষ্কার হতে হবে। অন্যদিকে দলগুলো যদি তালিকায় ভালো অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী, শিক্ষাবিদকে রাখে, তাহলে মানুষ বুঝবে সে যে ভোটটি দিচ্ছে, সেটা কোথায় যাচ্ছে।

কালবেলা: রাষ্ট্র থেকে বৈষম্য দূর করার দাবি উঠছে। এটা কীভাবে করা যেতে পারে বলে মনে করেন?

এম এম আকাশ: রাষ্ট্র এবং সমাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে বৈষম্য দূর করা অনেক বড় একটি ব্যাপার। এটা এক ধরনের সামাজিক বিপ্লবের ব্যাপার। আংশিক সংস্কার করে বৈষম্য দূর করা যাবে না। সব বৈষম্যের মূলে রয়েছে সম্পদের বৈষম্য। আর সম্পদের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। দুভাবে এই বৈষম্য দূর করা যায়। এটি হলো, সম্পদের পুনঃবণ্টন করে, যা করতে গেলে সমাজের মালিকানা ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানা উচ্ছেদ করা, অধিগ্রহণ করা, সিলিং করার প্রয়োজন হতে পারে। যদিও আমাদের সংবিধানে রয়েছে যে, ব্যক্তিমালিকানা একটা সিলিংয়ের মধ্যে থাকতে হবে। জমি বা সম্পদের পরিমাণ নির্দিষ্ট সীমার ওপরে চলে গেলে সেটা রাষ্ট্র নিয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু কেউ কোনোদিন এটার প্রয়োগ করেনি। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হলো, সম্পদের বৈষম্য এবং আয়ের বৈষম্য থাকল কিন্তু যারা বেশি আয় করে তাদের আয়ের বড় একটি অংশ ট্যাক্স আরোপ করে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে পুনঃবণ্টন করা। আমাদের দেশে এটাও ঘটেনি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সকাল ৯টার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

নিজ গাড়িচাপায় প্রাণ হারালেন ট্রাকচালক

৮ দফা দাবিতে নতুন কর্মসূচি সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটের

‘সব আসনে এককভাবে প্রার্থী দেবে গণঅধিকার পরিষদ’

ঢাবির আওয়ামীপন্থি সিন্ডিকেট সদস্যদের পদত্যাগ দাবি

গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা জাতিসংঘে তুলে ধরবেন ড. ইউনূস

মিরপুরে ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের বিক্ষোভ

প্রকাশ পেল ইকরাম কবীরের ‘খুদে গল্পের বই’

সৈনিক থেকে শিল্পপতি হাবিবুর

‘নবীর দেখানো পথে রাষ্ট্র উপহার দিতে চায় জামায়াত’

১০

টাঙ্গাইলে বাস-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২

১১

১৬ বছর পর সাতক্ষীরায় জামায়াতের রুকন সম্মেলন

১২

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

১৩

ঢাবিতে হত্যাকাণ্ডে ৮ শিক্ষার্থীর সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি

১৪

দলের নির্দেশনা না মানলে কঠোর পরিণতির হুঁশিয়ারি নয়নের

১৫

মোংলায় নিলামে উঠছে ৪০ গাড়ি

১৬

শনিবার বিদ্যুৎ থাকবে না সিলেটের যেসব এলাকায়

১৭

একদিনে ৬ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করল চীন

১৮

বগুড়া জেলা ছাত্রদলের নতুন কমিটিকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল

১৯

নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে অর্থায়ন দাবিতে মোংলায় র‌্যালি

২০
X