ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বিগত ১৬ বছরের শাসনামলের জঞ্জাল অপসারণ করে লাইনচ্যুত রাষ্ট্রযন্ত্রের ট্রেনকে সচল করে চালাতে শুরু করেছে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। রাষ্ট্র কাঠামোর সর্বস্তরে সংস্কারের জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। এ পর্যায়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ছয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেশের অভিজ্ঞ ছয়জন নাগরিকের নেতৃত্বে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে সরকার। এর মধ্যে গণতন্ত্রের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা। কিন্তু বিগত কয়েকটি নির্বাচনে জনগণের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। এজন্য নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের একটি কমিশন করা হয়েছে। অন্যদিকে পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন এবং সংবিধান সংস্কারের জন্য পৃথক পৃথক কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। সরকার গঠনের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ ঘোষণা দেন।
এ সরকারের সবসময় প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা। সংবিধান থেকে শুরু করে প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের কাজ করতে হবে। আন্দোলনের ফলে গঠিত নতুন সরকার নিজেরা গত মাসে অনেক আন্দোলনের মুখোমুখি হয়েছে। সংখ্যালঘু নিরাপত্তা আন্দোলন, এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল, আনসারদের আন্দোলন, পোশাক শ্রমিক আন্দোলন, রিকশাওয়ালাদের ও ডাক্তার, নার্সরা নানা দাবিতে নেমেছিল আন্দোলনে। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় সেগুলো সুরাহা হয়। তবে বেগতিক দিকে মোড় নেয় আনসার আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি হয়ে সে আন্দোলন প্রতিহত করে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে এর আগে বলেছেন, ‘ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার যে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু হয়েছে, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমরা এর থেকে বেরিয়ে যেও না।’ তিনি এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছাত্রদের সার্বক্ষণিক কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান।
অন্যদিকে দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের জন্য বিষফোড়া ‘খেলাপি ঋণের’ ব্যাপারে কার্যকর অ্যাকশন নেওয়া জরুরি। সেই লক্ষ্যে এরই মধ্যে সমস্যা চিহ্নিত করতে তা সমাধানে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি, পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে ফেরত আনা, খেলাপি ঋণ দ্রুত আদায় করার পাশাপাশি যেসব ব্যাংকে সমস্যা আছে, সেগুলো পুনর্গঠন করার পরামর্শ দেবে। এরই মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক পুনর্গঠন, পর্ষদ ভেঙে নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়েছে। তারল্য সংকট সমাধান করা হচ্ছে। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য একটা টাস্কফোর্স গঠন করার প্রক্রিয়া চলছে। ব্যাংকগুলোর সংস্কারের ব্যাপারে কাজ চলছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, সংস্কারের জন্য যে ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেগুলো আগামী তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে পারবে বলে আশা করছে সরকার। এরপর তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে যাবে সরকার। ওই সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক মতৈক্য গড়ে সংস্কার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সংশোধনী এনে তারপর নির্বাচনের কথা ভাবছে সরকার। এজন্য প্রথম থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়েছে। এর পর সংলাপ হবে। রাজনৈতিক দলগুলোই স্পষ্ট করেছে আগে সংস্কার, পরে তারা নির্বাচনে যেতে চায়। কাজেই আজকের দিনে বাস্তবতা ও প্রেক্ষিতও ভিন্ন। সামনে সংবিধান সংস্কারসহ বেশ কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে এ সরকারের সামনে। রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি। সরকার এরই মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে শহীদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা ও আহত শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করার দায়িত্ব নিয়েছে। আহতদের দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা এবং শহীদদের পরিবারের দেখাশোনার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এ তালিকা হালনাগাদ হতে থাকবে। শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে সরকার তার যাত্রালগ্নে ‘জুলাই গণহত্যা স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ফাউন্ডেশন গঠন করেছে। সব শহীদ পরিবার এবং আহতদের সর্বোত্তম চিকিৎসাসহ তাদের পরিবারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব এ ফাউন্ডেশন গ্রহণ করছে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যাংকিং কমিশনও গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট সাপোর্ট চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে অতিরিক্ত ৩ বিলিয়ন, বিশ্বব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ১ বিলিয়ন, জাইকা থেকে অতিরিক্ত ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদানের অনুরোধ জানানো হয়েছে। পাইপলাইনে থাকা ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মেগা প্রকল্পের নামে লুটপাট বন্ধের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পেঁয়াজ, আলুর দাম আরও কমাতে শুল্কহার হ্রাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জনআকাঙ্ক্ষার বহুল প্রত্যাশিত সংস্কারে গৃহীত কর্মসূচি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হবে এবং তা আলোর মুখ দেখবে—এটাই সবার চাওয়া।
লেখক: সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম