পৃথিবীতে মানবসভ্যতার জন্য এক অনুপম আদর্শের দৃষ্টান্ত প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হিজরি ক্যালেন্ডারের তৃতীয় মাসকে বলা হয় ‘রবিউল আউয়াল’, যার অর্থ প্রথম বসন্ত। এই প্রথম বসন্ত অর্থাৎ রবিউল আউয়াল মাসেই পৃথিবীকে আলোকিত করেছিলেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। বসন্তের আগমনে প্রকৃতিতে যেমন সাজ সাজ রব পড়ে যায়, তেমনি এ মাসে বিশ্বনবীর আগমনেও মুসলমানদের হৃদয়ে প্রবাহিত হয় আনন্দের ধারা। তবে একই সঙ্গে মাসটি বিশ্ব মুসলিমের জন্য বিষাদেরও; কারণ পৃথিবী থেকে মহানবীর বিদায় নেওয়ারও মাস এটি। আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে রবিউল আউয়াল মাসের কোনো এক সোমবার তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আর ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে একই মাস ও দিনে তথা রবিউল আউয়াল মাসের সোমবারে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তবে নবীজি (সা.)-এর জন্মতারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কারও মতে, রবিউল আউয়াল মাসের ২ তারিখ, কারও মতে ৮ তারিখ, কারও মতে ১০ তারিখ, কারও মতে ১২ তারিখ, আবার কারও মতে ১৭ তারিখে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার মৃত্যুর তারিখ নিয়েও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কারও মতে, রবিউল আউয়ালের ১ তারিখ, কারও মতে ২ তারিখ। আর অধিকাংশের মতে, ১২ রবিউল আউয়াল মাসে তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। তবে নবীজি (সা.)-এর জন্ম ও মৃত্যু যে রবিউল আউয়াল মাসের কোনো এক সোমবার হয়েছে—এ ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদ উলামায়ে কেরাম একমত রয়েছেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ২/২৮২)।
এ আলোচনার ভিত্তিতে বোঝা যায়, মুসলিম উম্মাহর জন্য রবিউল আউয়াল মাস একই সঙ্গে আনন্দ ও বেদনার। এ মাসের আগমন আমাদের হৃদয় ও মননে নবীজির প্রতি প্রেম-ভালোবাসা ও মহব্বত অন্য সময়ের চেয়ে আরও দৃঢ় করে।
কিন্তু এর মানে এই নয়, শুধু এ মাসে নবীজি (সা.)-এর প্রতি মহব্বত দেখাব, অন্য সময় তাকে ভুলে যাব। বরং আজকের দিন থেকে আমাদের প্রতিজ্ঞা হবে—‘জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নবীজি (সা.)-এর প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা হৃদয় থেকে রাখব। তার পথ ও আদর্শ অনুসরণ করে চলব। কারণ, তার আদর্শ অনুসরণ ও অনুকরণেই আমাদের মুক্তি নিহিত।’ নবীজির অসাধারণ চারিত্রিক মাধুর্য ও অনুপম ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব: ২১)। তিনি অবিস্মরণীয় ক্ষমা, মহানুভবতা, বিনয়-নম্রতা, সত্যনিষ্ঠতা প্রভৃতি বিরল চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে বর্বর আরব জাতির আস্থা অর্জন করেছিলেন। ফলে সবাই তাকে ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বস্ত উপাধিতে ভূষিত করেছিল। পৃথিবীর মানুষকে তিনি অর্থ বা প্রভাব-প্রতিপত্তির বলে বশীভূত করেননি; বরং স্বভাবজাত উদার ব্যবহার দিয়ে বশীভূত করেছিলেন। তাই তো তার চারিত্রিক গুণাবলি সম্পর্কে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সুরা কলম: ৪)
মানবজাতির ইতিহাসের শুরু থেকে আজ অবধি রাসুল (সা.)-এর মতো মানবদরদি আর নেই। মানবসভ্যতার প্রতিটি পরতে-পর্বে মিশে আছেন তিনি। নবুয়াত-পরবর্তী মাত্র ২৩ বছরের অল্প সময়ে পৃথিবীজুড়ে যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার দৃষ্টান্ত বিরল। তার ছিল না অর্থ-ঐশ্বর্যের ছড়াছড়ি, ছিল না ক্ষমতার দাপট। পৃথিবী তখন নিকষ আঁধারে নিমজ্জিত। জাহেলিয়াতের অন্ধকারে মানুষ জ্ঞানশূন্য। যারা পশুর চেয়েও নিচে নেমে গিয়েছিল। মানুষ আর পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। মানবতার সেই কঠিন সংকটপূর্ণ মুহূর্তে মাত্র গুটিকয়েক অনুসারী নিয়ে আরবের ক্ষুধা-অনাহারে জর্জরিত, বর্বরতা ও মূর্খতার অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতিকে সুখ-সমৃদ্ধি, মর্যাদা ও গৌরবের সোনালি মানুষে রূপান্তর করেছেন। তিনি ছিলেন অন্তরের স্বচ্ছতা, আত্মার মহত্ত্ব, ধৈর্য, সহনশীলতা, সততা, বিনম্রতা, বদান্যতা, বিশ্বস্ততা, সুরুচিপূর্ণ মনোভাব, ন্যায়পরায়ণতা ও উদারতাসহ সর্বোত্তম চরিত্রের প্রবাদপুরুষ। তিনি ছিলেন একাধারে স্বামী হিসেবে প্রেমময়, পিতা হিসেবে স্নেহশীল, ছিলেন বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী, দূরদর্শী সমাজ সংস্কারক, সাহসী যোদ্ধা, ন্যায়বিচারক, যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক এবং সফল ধর্মপ্রচারক। মোট কথা, কল্যাণকর প্রতিটি কাজেই রাসুল (সা.) ছিলেন সর্বোত্তম আদর্শ ও পথিকৃৎ। তার অসাধারণ চারিত্রিক মাধুর্য ও অনুপম ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব: ২১)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সমগ্র মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। তিনি ছিলেন সর্বগুণে গুণান্বিত। তার অনুপম গুণাবলির কারণে জাহেলি যুগের নিকৃষ্ট মানুষরাও তাকে ভালোবাসত এবং তার ওপর আস্থা পোষণ করত। তার প্রতি তাদের ভালোবাসা ও আস্থার নিদর্শনস্বরূপ তাকে ‘আল-আমিন’ উপাধি দিয়েছিল। সাহাবিরা নিজেদের প্রাণের চেয়েও রাসুলুল্লাহকে (সা.) অনেক বেশি ভালোবাসতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি তাদের ভালোবাসা এত বেশি ছিল যে, তার নির্দেশে তারা নিজেদের পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন ও বাড়িঘর ছেড়ে হাবশা ও মদিনায় হিজরত করেন। অনেক জুলুম-নির্যাতন সত্ত্বেও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ হতে তারা এক চুল পরিমাণ বিচ্যুত হননি। তার প্রতিটি নির্দেশ তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশে জিহাদের ময়দানে অসংখ্য সাহাবি হাসিমুখে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। উহুদ যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন রক্ষার জন্য বেশ কয়েকজন সাহাবি নিজেদের শরীরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তীর থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে হেফাজত করার জন্য তারা হাসিমুখে শাহাদাতবরণ করেন। সিরাত ও ইতিহাসের কিতাবে নবীজি (সা.)-এর প্রতি সাহাবিদের ভালোবাসার এরকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার ব্যাপারে ইসলামে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। তার প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা ইমানের দাবি। সবার চেয়ে তাকে বেশি ভালোবাসা প্রত্যেক মুমিনের ইমানি দায়িত্ব। এ ছাড়া কোনো মুমিনের ইমান পরিপূর্ণ হতে পারে না। হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার হাতে আমার প্রাণ তার কসম করে বলছি, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের পিতা, সন্তান এবং সমস্ত মানুষের চেয়ে আমি তোমাদের কাছে বেশি প্রিয় না হই।’ (বোখারি: ১৫)। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা শুধু মুখে দাবি করলেই হয় না। তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য শরিয়তসম্মত বিভিন্ন উপায় আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নতগুলো মেনে চলা। সুন্নতের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া কেউ রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ভালোবাসার দাবি করতে পারে না। কেননা সুন্নতের প্রতি ভালোবাসা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার নামান্তর। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে জীবিত করল, সে যেন আমাকেই ভালোবাসল। আর যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসল, সে জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে।’ (তিরমিজি: ২৬৭৮)
নবীজি (সা.)-এর প্রকৃত প্রেমিকরা তার সঙ্গে জান্নাতে থাকবেন। হজরত আনাস (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবী করিমকে (সা.) জিজ্ঞেস করল, কেয়ামত কখন হবে? তিনি বলেন, তুমি কেয়ামতের জন্য কী জোগাড় করেছ? সে বলল, কোনো কিছু জোগাড় করতে পারিনি, তবে আমি আল্লাহ ও তার রাসুলকে ভালোবাসি। তখন তিনি বলেন, ‘তুমি তাদের সঙ্গেই থাকবে, যাদের তুমি ভালোবাসো। আনাস (রা.) বলেন, নবীজি (সা.)-এর কথার দ্বারা আমরা এত আনন্দিত হয়েছি যে, অন্য কোনো কথায় এত আনন্দিত হইনি। আনাস (রা.) বলেন, আমি নবী করিমকে (সা.) ভালোবাসি এবং আবু বকর, ওমরকেও (রা.)। আশা করি তাদের আমার ভালোবাসার কারণে তাদের সঙ্গে জান্নাতে বসবাস করতে পারব, যদিও তাদের আমলের মতো আমল আমি করতে পারিনি।’ (বোখারি: ৩৬৮৮)
আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর প্রতি আমাদের ভালোবাসা কেমন হওয়া উচিত, তা তিনি নিজেই হাদিসে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ইমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার কাছে মা-বাবা, সন্তানাদি ও সবার চেয়ে আমি বেশি প্রিয় না হব।’ (বোখারি: ১৫)। তার মানে ইমানের পরিপূর্ণতার জন্য বুনিয়াদি শর্ত হলো—আল্লাহর রাসুলকে মহব্বত করা। নামেমাত্র মহব্বত নয়; একজন মানুষের সবচেয়ে আপন হয় তার মা-বাবা, তারপর সন্তানাদি, তারপর অন্য কোনো মানুষ, তাদের সবার চেয়ে আল্লাহর রাসুলের প্রতি বেশি মহব্বত হতে হবে এবং সেটা আবার মুমিন হওয়ার পূর্বশর্ত। পবিত্র কোরআনেও একই নির্দেশনা আছে, মুমিনের জন্য ভালোবাসার মূল কেন্দ্র স্বয়ং আল্লাহ, তারপর হজরত মুহাম্মদ (সা.)। আর বাকি দুনিয়ার যত প্রেমময় মানুষ আছে, যত রকমের ভালো লাগার জিনিস আছে—সবকিছুর অবস্থান দ্বিতীয়তে। এ থেকে বোঝা যায়, আল্লাহর রাসুলকে ভালোবাসা আমাদের প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক। কেননা দুনিয়াতে ভালোবাসার যত কিছু আছে, সবই তার কারণে প্রেমময়। মহানবীর আগমন ও বিদায়ের মাস রবিউল আউয়াল হোক আমাদের আত্মপ্রত্যয়ের মাস। পৃথিবী ও পরকাল—দুই জগতে যদি সুখে-শান্তিতে জীবনযাপনের প্রত্যাশা করি, তাহলে নবীর ভালোবাসা অন্তরে ধারণ করে যাপিত জীবনেও যেন তার আদর্শ প্রতিফলিত করি। মহান আল্লাহ সবাইকে তওফিক দিন।
লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ