ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকির
প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৪ এএম
আপডেট : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত

স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত

দীর্ঘ ১৬ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের অবসান হলে এ বছরের ৮ আগস্ট নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এই নতুন সরকারের কাছে জনগণের চাওয়া-পাওয়া অনেক। তারা চায়, এ সরকার এমন এক বাংলাদেশ নির্মাণ করবে, যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না, যেখানে মানুষ সুখে-শান্তিতে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারবে। মানুষের চাওয়া-পাওয়ার কথা চিন্তা করে এ সরকার রাষ্ট্রের সংস্কার সাধনের জন্য কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সরকার সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন বিভাগ, পুলিশ বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশন—এ ছয়টি বিভাগ সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে। সে লক্ষ্যে ছয়টি সংস্কার সহায়ক কমিশন গঠন করেছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণ থেকে স্পষ্ট হয়েছে। সংস্কারের উদ্দেশ্যে গৃহীত পদক্ষেপ থেকে সরকারের রাষ্ট্র সংস্কার সম্পর্কিত নীতি স্পষ্ট হয়েছে। সরকারের এ রাষ্ট্র সংস্কার নীতি থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, সরকার শুধু রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন কিছু প্রতিষ্ঠানকে সংস্কারে আগ্রহী। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে আসা খবরাখবর থেকে জানা যাচ্ছে যে, সরকার আর্থিক খাতকে ব্যাপক সংস্কারে আগ্রহী। কিন্তু জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে, এমন কোনো খাতকে সংস্কারের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

জনগণ বিশেষ করে মধ্য ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হতে পারে এমন খাত হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ধর্ম ও সংস্কৃতি ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, সম্পদের উৎপাদন, বণ্টন ও বিতরণকে ঘিরে প্রতিষ্ঠিত জটিল রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ওপর নির্ভর করে সমাজ নামক সৌধ গড়ে ওঠে। কাজেই সমাজ অত্যন্ত জটিল। এ জটিল সমাজকে ৬৭টি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানকে সংস্কারের মাধ্যমে মেরামত করা সম্ভব নয়। কাজেই জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কার করা এ সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত। উল্লেখ্য, উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষজন বাদে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জনগণের চাওয়া-পাওয়া সীমিত। তাদের চাওয়া-পাওয়া অতি সামান্য। তাদের চাওয়া-পাওয়া হলো অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান ও স্বাস্থ্যসেবা; কিন্তু দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা খুবই নাজুক।

বস্তুত একটি দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা যদি সুস্থ না থাকে, তাহলে সুস্থ সমাজ ও সুস্থ জাতি গড়ে উঠতে পারে না। বাংলাদেশে কাগজে-কলমে সরকারের অগ্রাধিকার খাত হলো স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা। দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা পরিচালনায় জন্য প্রতি বছর প্রচুর বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। চলতি বছর এই খাতে বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ ৩৮ হাজার কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেটের শতকরা ৫.১৯ ভাগ। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় অব্যবস্থাপনা এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রশাসন, চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর কর্তব্য কর্মে অবহেলা ও দুর্নীতির কারণে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা যথাযথভাবে পরিচালিত হয় না। সেজন্য দেশের মানুষ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পায় না। যে কারণে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কার করা প্রয়োজন।

এ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সংস্কার পরিকল্পনায় যেসব বিষয় লক্ষ্য হিসেবে নেওয়া প্রয়োজন, তার মধ্যে অন্যতম হলো বেসরকারি উদ্যোগে গৃহীত স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পে সহজ শর্তে ঋণদান, স্বাস্থ্যসেবা প্রশাসনকে জবাবদিহির আওতায় আনয়ন এবং রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের রাষ্ট্র পরিচালিত হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণে বাধ্যবাধকতা আরোপ। দেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য বেসরকারি খাতে বৃহদাকার হাসপাতাল (২০০০ বা তদূর্ধ্ব শয্যাযুক্ত) স্থাপনে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। সেজন্য রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ১০০টি হাসপাতাল স্থাপন করা প্রয়োজন। বৃহদাকার হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগটি সফল করতে, হাসপাতাল স্থাপনে আগ্রহী উদ্যোক্তা ব্যক্তি বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে সহজ শর্তে বড় অঙ্কের মূলধন সরবরাহ করা প্রয়োজন। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত হাসপাতালগুলোয় জনগণকে প্রদেয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে, প্রশাসনকে জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন। এ হাসপাতালগুলোর তদারকি সশস্ত্র বাহিনী বোর্ডের কাছে ন্যস্ত করার মাধ্যমে এ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে। অন্যদিকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হাসপাতালগুলোর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গণমুখী করতে রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারী-কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধি ও তাদের পরিবারবর্গকে রাষ্ট্র পরিচালিত হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও তাদের পরিবারবর্গকে রাষ্ট্র পরিচালিত হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হলে, রাষ্ট্র পরিচালিত এসব হাসপাতালের উন্নয়নে তাদের ভেতর একটি তাগিদ কাজ করবে। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা উন্নয়নে তাদের এ তাগিদের একটি প্রতিফলন দেখা যাবে। ফলে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন সাধিত হবে। এতে দেশের মানুষ সুষ্ঠু স্বাস্থ্যসেবা লাভের সুযোগ পাবে।

দেশের বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নাজুক বিধায় এ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা দিন দিন কমে এসেছে। সেজন্য মানুষ চিকিৎসা গ্রহণের উদ্দেশ্যে নানা দেশে চিকিৎসা ভ্রমণে গিয়ে থাকে। বিত্তশালীরা চিকিৎসা গ্রহণের উদ্দেশ্যে সিঙ্গাপুর, লন্ডন বা ব্যাংকক যাচ্ছেন। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারতের বিভিন্ন শহরে যাচ্ছেন। কিন্তু যারা নিম্নবিত্ত তারা বাধ্য হয়ে দেশের এ অসুস্থ হাসপাতালগুলো থেকে অপচিকিৎসা গ্রহণে বাধ্য হচ্ছেন। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার অসুস্থতার কারণে দেশের মানুষ চিকিৎসা গ্রহণের জন্য মানুষের বিদেশমুখী হওয়ায় একদিকে দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা উন্নয়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কাজেই দেশে এমন একটি সুষ্ঠু স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেন দেশের মানুষের দেশীয় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরে আসে। এভাবে যদি চিকিৎসার জন্য মানুষের বিদেশমুখিনতা কমে আসে, তাহলে বিদেশে অর্থ পাচার রোধ হবে এবং দেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।

স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কিত ওই আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সংস্কার করা প্রয়োজন। কাজেই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগ্রাধিকার সম্পন্ন সংস্কার উদ্যোগের একটি হওয়া উচিত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সংস্কার। এ সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে একটি স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার কমিশন গঠন করা প্রয়োজন, যেন এ কমিশন বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ত্রুটি মূল্যায়ন করে, একটি সংস্কার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে পারে।

লেখক: অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের সুপারিশ সংবিধান সংস্কার কমিশনের

পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলেন মোখলেছুর রহমান

শেখ পরিবার সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ : দুদু 

শীতে বাড়ছে ডায়রিয়া, ৮৫ শতাংশ রোগীই শিশু

এসএমসি’র ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে লোগো উন্মোচন 

৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে ফের ভোটগ্রহণের প্রস্তাব

‘একদম চুপ, কান ফাটাইয়া ফেলমু’, অধ্যক্ষকে জামায়াত কর্মী

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন

বগুড়ায় নাশকতা মামলায় যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

বিয়েতে অস্বীকৃতি, বাবার গুলিতে মেয়ে নিহত

১০

সাত কৃষককে ধরে নিয়ে গেল সন্ত্রাসীরা, মুক্তিপণ দাবি

১১

ছাগলকাণ্ড : সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রিমান্ডে

১২

চীন যাচ্ছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, হবে যেসব আলোচনা

১৩

শৈশবের বন্ধুদের প্রিয় কবিতা শোনালেন মির্জা ফখরুল

১৪

পুতুল-টিউলিপসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু

১৫

পুতুলকে ‘হু’ থেকে অপসারণে অনলাইনে চলছে গণস্বাক্ষর, ব্যাপক সাড়া

১৬

চটপটির দোকানে ২৩৪ কোটি টাকা ঋণ, অনুসন্ধান করবে দুদক

১৭

ভুয়া আসামি দাঁড় করিয়ে জামিন, ৪ জনের নামে মামলার নির্দেশ আদালতের

১৮

অত্যাধুনিক গোয়েন্দা জাহাজ নামাল ইরান

১৯

সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বৈঠক / বাংলাদেশের সঙ্গে শক্তিশালী সামরিক সম্পর্ক গড়তে চায় পাকিস্তান

২০
X