কিছুদিন আগের কথা। একদিকে সমুদ্র আর অন্যদিকে পাহাড়ঘেরা এক রাজ্য ছিল। নজিরবিহীন সৌন্দর্যের সেই রাজ্যের নাম ছিল ‘বেনজির নগর’। হঠাৎ করে সেই রাজ্যের ক্ষমতাধর অধিপতির মাথায় এক দরবেশ ঢুকিয়ে দিল যে, ‘ন’ অক্ষর দিয়ে ভালো শব্দ খুব কমই হয়। যেমন নকল, নক্ষদন্তহীন, নাগ-নাগিনী, নগ্নতা, নটঘট, নটী, নড়বড়ে, নতজানু, নিষ্ক্রিয়, নিমকহারাম, নিঃস্ব, নাদান, নপুংসক, নফর, নরক, নরপিশাচ, নাজেহাল, নিন্দা, নেশা, ন্যাংটা, নিরক্ষর, নেকা ইত্যাদি। ওই দরবেশ আরও শব্দ বলতে চাইলেন। কিন্তু রাজ্য অধিপতি এতটুকু শুনেই তাকে থামিয়ে দিলেন। আদেশ দিলেন আজ থেকে ‘ন’ অক্ষরটি আর অভিধানে থাকবে না। আর কেউ কোনোদিন ‘ন’ অক্ষর ব্যবহার করতে পারবে না। চাটুকারদের দল বরাবরের মতোই রাজ্য অধিপতির বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। কিন্তু কিঞ্চিৎ বেঁকে গেলেন রাজ্য অধিপতির ছোট বোন। ‘ন’ অক্ষর তুলে দিলে আমাদের স্বর্গীয় বাবার গড়া দেশের নামই যে বদলে যাবে। ‘বেনজির নগর’ হয়ে যাবে ‘বেজির গর’। রাজ্য অধিপতি আবার এক কথার মানুষ ছিলেন। তিনি তো রাজ্য প্রতিষ্ঠাতার সন্তান। তিনি দিতে জানেন, ফিরিয়ে নিতে জানেন না। সুতরাং তিনি যা বলবেন, তার কোনো হেরফের হবে না। কোনো অবস্থাতেই না। শতসহস্র জীবন গেলেও একচুল নড়বেন না তার কথা থেকে। সুতরাং ‘বেনজির নগর’ হয়ে গেল ‘বেজির গর’। রাজ্য অধিপতির এমন তুঘলকি কাণ্ড দেখে দেশান্তরী পণ্ডিতরা তাকে ‘বাজিগর’ তকমা ধরিয়ে দিলেন। এরপর বাজিগরের ভেলকিতে ‘বেজির গর’ রাজ্যে সবাই শুধু উন্নয়নই দেখত। মহাকাশ থেকে সমুদ্র তলদেশে। নদীর নিচে কিংবা ওপরে, সড়কে কিংবা উড়াল সড়কে শুধুই উন্নয়ন। বাজিগরের ছিল বিশেষ ডুগডুগি বাহিনী। তারা শুধুই ডুগডুগি বাজাত আর সবাই গাইত ‘আহা কী উন্নয়ন আকাশে বাতাসে’।
‘পায়রাবন্দ’ নামের এক গ্রাম ছিল সেই রাজ্যে। ‘ন’ অক্ষর বাজেয়াপ্ত হওয়ায় গ্রামের নতুন নাম হলো ‘পায়রাবদ’। এ গ্রামেরই বদর আলীর পুত্র পেয়ার আলী। তার খুব শখ হলো সে রাজ্যের পেয়াদা হবে। কার কাছে যেন শুনেছে ‘বেজির ঘর পেয়াদা বাহিনী’তে একবার নাম লেখাতে পারলেই হলো! সারা জীবনের চিন্তা শেষ। আস্ত গ্রাম, মহল্লা কিংবা শহর এলাকায় হালি ধরে ফ্ল্যাট আর ডজন ধরে মার্কেটে দোকান কেনা কোনো ব্যাপারই না! পেয়াদা বাহিনীর একজন সাহেব কিংবা মিয়ার এমনকি তাদের আত্মীয়স্বজন বা নফরদের কত সম্পত্তি, তারা নিজেরাও তা বলতে পারেন না। আর অতটুকু না হলেও তাদের নামের বরকতে সাধারণ পাইক-পেয়াদারা যা কামায়, তাতেই তিন পুরুষের দিব্যি আরাম-আয়েশ নিশ্চিত করা সম্ভব। সব শুনে পেয়ার আলী পেয়াদা বাহিনীতে যোগ দিতে মরিয়া হয়ে উঠল।
কিন্তু বিপত্তি বাধল অন্য জায়গায়। ওই যে ‘ন’ অক্ষর উঠে যাওয়ায় নির্বাসিত হয়েছিল ন্যায়, নীতি, নির্বাচন—সবই। তদুপরি ‘ন’ অক্ষর নেই এমন অঞ্চলের মানুষ আর বিশেষ রাজভক্তদের জন্য নির্দিষ্ট কোটা সংরক্ষিত থাকায় পেয়ার আলীদের পক্ষে পেয়াদা হওয়া ছিল বড় কঠিন বিষয়। তবে রাস্তা একটা ছিল, এক রাতে যা বাতলে দিলেন এক দরবেশ বাবা। আড়ালে ডেকে নিয়ে দরবেশ বাবা বুদ্ধি দিলেন, টাকা হলে এ রাজ্যে সবই সম্ভব বাছা। তুমি যেই অঞ্চলেরই হও, অতীতে তোমার বাপ-দাদা কিংবা তুমি যে দলই করে থাকো না কেন; রাজ্য প্রতিষ্ঠায় তোমার চৌদ্দ পুরুষের যতই বিরোধিতার ইতিহাস থাকুক না কেন, টাকা আছে তো সব ঠিক। পেয়াদা বাহিনীতে যোগ দিতে তোমার কোনো বাধাই থাকবে না, যদি তোমার টাকা থাকে। কিন্তু দরবেশ বাবার চাওয়া টাকার অঙ্ক শুনে পিতা বদর আলী আর পুত্র পেয়ার আলীর মাথায় হাত! সব ভেবেচিন্তে একমাত্র পুত্রের হাউস আর ভবিষ্যতের কথা ভেবে বদর আলী সবেধন নীলমণি একখণ্ড জমি বিক্রি করে দিলেন। সময়মতোই যথাস্থানে দরবেশ বাবার মাধ্যমে টাকা পৌঁছে গেল। এবার পেয়াদা বাহিনীর এক মিয়া সাহেব সামনে এগিয়ে আসলেন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে মর্মে একটি গোলাপ ফুল নিলেন পেয়ার আলীর হাত থেকে। সবাই ধন্য ধন্য ধ্বনি তুললেন আর পায়রার দল বাক-বাকম বাক-বাকম শব্দে পেয়াদা বাহিনীর মিয়া সাহেবের সততার খবর ছড়িয়ে দিল। বছর শেষে রাজ্যের ‘শুদ্ধাচার’ পদকও পেলেন মিয়া সাহেব।
পেয়ার আলী বিশাল নদীর তীরে অবস্থিত পেয়াদা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চলে গেল নিবিড় প্রশিক্ষণের জন্য। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যাওয়ার পরপরই পেয়ার আলী যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। উঠতে, বসতে, চলতে, ফিরতে এমনকি চোখ তুলে তাকাতেও যেন টাকা গুনতে হয়। প্রশিক্ষণের নামে পরীক্ষা আর পরীক্ষা। আর প্রতিটি পরীক্ষা পাসের জন্যই গুনতে হবে টাকা আর টাকা। তবে সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, ঘোড়া চালানো প্রশিক্ষণের সময় ঘোড়ার সামনেও পেয়ারা আলীকে ধরতে হলো ১০০ ডলারের নোট। এই ঘোড়াও নাকি শুধু ১০০ ডলারের নোট চেনে। এর চেয়ে ছোট বা অন্য রাজ্যের নোট দিলে তার পিঠে চড়ামাত্র তাকে ফেলে দেয়। ফলে ঘোড়দৌড় প্রশিক্ষণে নির্ঘাত অকৃতকার্য হওয়ার হুমকি। অসহায় পেয়ার আলী ভাবে, হায়রে মানুষ না হয়ে পেয়াদা বাহিনীর ঘোড়া হওয়াই তো ভালো ছিল। বন্ধুবান্ধব আর পাড়া-পড়শির কাছ থেকে চেয়ে কোনোরকমে এগিয়ে গেল পেয়ার আলীর প্রশিক্ষণ।
এবার চূড়ান্ত পরীক্ষা। পরীক্ষার আগে আরেক মিয়া সাহেব হাজির। সরাসরি বলেই ফেললেন, টাকা জমা করো অন্যথায় চূড়ান্ত পরীক্ষায় পাসের কোনো সম্ভাবনা নেই। পেয়ার আলী বিগত দিনগুলোতে এত টাকা প্রসঙ্গটি বলার আগেই মিয়া সাহেব বলে ফেললেন, আগে যা দিয়েছ তার হিসাব অন্যদিকে রাখো আর এ পরীক্ষা শেষ হলেই তো তুমি সুদে আসলে সব ফেরত পাবে; এত না ভেবে তাড়াতাড়ি টাকা জমা করো।
অসহায় পেয়ার আলী বিভিন্ন কথা বলে এ-জন সে-জন থেকে অনেক টাকা এনে এ পর্যন্ত এসেছে। কিন্তু এবার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে পেয়ার আলীর। কী করবে এ ভাবনায় যখন পেয়ার আলীর দিশেহারা অবস্থা, তখনই হঠাৎ তার মা স্বপ্নে দেখলেন পেয়ার আলী কাঁদছে। ঘুম ভাঙতেই মা তার ছোট ভাইকে পাঠালেন পেয়ার আলীর কাছে। ভাগ্নের মুখে সব শুনে ছোট ভাই ফেরত গেল গ্রামে। আর পেয়ার আলীর মায়ের কাছে সব খুলে বলল। মায়ের মন আর কিছুতেই সায় দিল না। তাৎক্ষণিক নিজের নাকের নোলক, কানের দুল আর নিজের মায়ের দেওয়া গলার হার তুলে দিলেন ছোট ভাইয়ের হাতে। সব গহনা বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া গেল, তার বিনিময়ে পেয়ার আলীর পরীক্ষাও হয়ে গেল। সব বিষয়ে পাস। শুধু ফল প্রকাশ আর রাজকীয় কুচকাওয়াজের অপেক্ষা। আর শপথ নেওয়ার আবশ্যিকতা—‘প্রজাদের সেবা করব, তাদের জানমালের হেফাজত করব, রাজ্যের খেদমত করব’ কত কি! এমন শপথ না নিলে নাকি আদর্শ পেয়াদা হওয়া যায় না।
এমন সময় রাজধানী থেকে তশরিফ আনলেন নতুন এক মিয়া সাহেব। পেয়ার আলীর কোথায় পোস্টিং হবে এ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা। পেয়ার আলী বরাবরই স্বপ্ন দেখেছিল রাজধানীর পেয়াদা হবে। তাই সরাসরি বলল, আমি রাজ্যের রাজধানীতে যেতে চাই। মিয়া সাহেব তাকে এক লম্বা ফিরিস্তি দিলেন। বললেন, রাজধানীতে অনেক রকম পেয়াদা থাকে। কেউ ধরপাকড় করে, কেউ তদন্ত করে, কেউ গোয়েন্দাগিরি করে, কেউ পর্যটকদের সেবা দেয়, কেউ বন্দি পাহারা দেয়, কেউ অন্য রাজ্যে প্রজাদের আসা-যাওয়ার হিসাব রাখে, কেউ কালো পোশাক পরে বিশেষ বাহিনীতে কাজ করে, কেউ আবার বিদেশি রাজ্যের প্রতিনিধিদের কাচারি আর ঘরবাড়ি পাহারা দেয়, কেউ যানবাহন সামলে ইত্যাদি। একেক জায়গায় যাওয়ার জন্য একেক রকম খরচ। বলো তুমি কোথায় যেতে চাও। পেয়ার আলী ফ্যান ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কী বলবে কিছুই বুঝতে পারে না।
এমন বোকাসোকা মানুষ হয়তো মিয়া সাহেব জীবনেও দেখেননি। তাই বুঝিয়ে বলতে শুরু করলেন। ধরো তুমি পোশাক পরে ধরপাকড় করার পেয়াদা হবে, তাহলে তোমার একরকম খরচ। আর যেমন খুশি তেমন সেজে যাকে ইচ্ছা তাকে ধরে যতদিন ইচ্ছা ততদিন গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে রেখে তিলে তিলে তার কাছ থেকে এবং তার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে যত ইচ্ছা তত আদায় করে নেবে, সে ক্ষেত্রে অন্যরকম খরচ। অন্য রাজ্যে যাওয়া-আসা করা প্রজাদের হিসাব যারা রাখে, তাদের সঙ্গে মিলতে এক খরচ, আর বন্দি পাহারার কাজ করতে খরচ।
বিস্ময় কাটে না পেয়ার আলীর। মিয়া সাহেব বিরতি দিয়ে আবার শুরু করলেন। যেমন ধরো তুমি যদি কোনো রাজ্যের প্রতিনিধিদের পাহারা দাও, তাহলে একরকম খরচ। তবে হ্যাঁ, এখানে আবার দুই ভাগ। যারা আলখেল্লা পরা প্রতিনিধি অর্থাৎ ঈদে চাঁদে তোফা দেয়, সেই রাজ্যে লোক পাঠায়, তাদের পাহারা দিতে এক খরচ আর যারা তোফা দেয় না বা লোক পাঠায় না, তাদের পাহারা দিতে আরেক খরচ।
তবে সবচেয়ে বেশি বিভাজন যানবাহন তদারকির কাজে। পেয়ার আলীর জিজ্ঞাসা—সেটা আবার কী রকম? মিয়া সাহেব বলে চললেন, যে রাস্তায় বাস-ট্রাক ঢোকে, সে রাস্তায় ডিউটি করতে এক খরচ আর যে রাস্তায় ঢোকে না সে রাস্তায় আরেক খরচ। কাছে ডেকে কানে কানে বললেন, যে রাস্তা দিয়ে মাদক, অস্ত্র আর চোরাচালানের মাল ঢোকে, সেখানে ডিউটি পেতে এক খরচ আর গোরস্তানের সামনের রাস্তায় আরেক খরচ। রাত দশটার আগে এক খরচ আর দশটার পর আরেক খরচ। আবার যেই পয়েন্ট দিয়ে সব লাইসেন্সবিহীন, বহু পুরাতন ও বিপজ্জনক ইট-বালু টানা শত শত গাড়ি রাজধানীতে ঢোকে, সেই পয়েন্টে ডিউটি করতে গেলে একরকম খরচ।
সব যেন মাথার ওপর দিয়ে যায় পেয়ার আলীর। কিছুই বুঝে না, কিছুই বলে না। রাজধানী থেকে আসা মিয়া সাহেব বড়ই বিরক্ত হলেন। কিছু বলার জন্য তাগাদাও দিলেন। একে একে সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। আগের অভিজ্ঞতায় দেখছেন এসবই জানে নতুন পেয়াদারা। বলার আগেই জানিয়ে দেয় কোথায় পোস্টিং আর সে মতোই দেওয়া-নেওয়া চলে। কিন্তু পেয়ার আলীর মতো গর্ধবের পাল্লায় এবারই প্রথম। তাই একটা ধমক না দিয়ে পারলেন না। ধমক খেয়ে কেঁদেই দিল পেয়ার আলী। বলল, মায়ের নাকের নোলকও বেচা শেষ, এবার আমি টাকা পাব কোথায়? গালি দিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন মিয়া সাহেব।
এক বুক কষ্ট নিয়ে পেয়ার আলী শুয়ে শুয়ে ভাবছে কী করা যায়। অনেক রাতে ঘুম এলো। পেয়ার আলী স্বপ্নে দেখল তার পোস্টিং পয়গাম এসেছে। রাজ্যের রাজধানীতে পেয়াদাদের থাকার বড় ব্যারাকের নাম ‘রাজারবাগ’। সেই রাজারবাগে ক্লিনিং সুপারভাইজার হিসেবে পোস্টিং হয়েছে ‘পায়রাবদের’ পেয়াদা পেয়ার আলীর।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট