অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। তারা মনে করেছন, সরকার যে রূপরেখা দিয়েছে, তা সময়োপযোগী। এখন সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা বাঞ্ছনীয়।
ছাত্র-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার তিন দিন পর শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বুধবার দ্বিতীয়বারের মতো তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। এর আগে গত ২৫ আগস্ট প্রথমবারের মতো তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। স্বাধীনতার পর এ দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সব মানুষ একটি পরিবারের মতো বসবাস করবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরে নিশ্চিত হবে জনপ্রতিনিধিদের শাসন। মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা এখন পর্যন্ত একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দূরে থাক, সুষ্ঠু নির্বাচনী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারিনি। উল্টো মুক্তিযুদ্ধের ধ্বজাধারীরা দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে। লুট করেছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এসব লুটের অর্থ তারা বিদেশে পাচার করেছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মাধ্যমে এমন লুটপাটের ইতিহাস আধুনিক বিশ্বে বিরল। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশটা একটা মগের মুল্লুকে পরিণত করেছিলেন। ছাত্র-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের কারণে আমাদের কাছে আবার নতুন করে রাষ্ট্র বিনির্মাণের সুযোগ এসেছে। সেই সংস্কারের রূপরেখাই ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণে তুলে ধরেছেন। তিনি জানিয়েছেন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কারের জন্য ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিকের নেতৃত্বে ছয়টি কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কারের জন্য এসব কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে এ কমিশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে ড. শাহদীন মালিক দায়িত্ব পালন করবেন।
আমরা মনে করি, এই সংস্কারের মূল উদ্দেশ দেশের প্রতিটি স্তরে যে অনিয়ম ও দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে, তা ভেঙে ফেলা এবং এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসা। দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করা এবং এগুলো আর যাতে দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত না হয়ে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে, সেই ব্যবস্থা করা। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা। দ্বিধাবিভক্ত জাতিকে একটি পরিবারে পরিণত করে জাতীয় ঐক্য ফিরিয়ে আনা। এসবের মাধ্যমে একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের কাজটি এগিয়ে নেওয়া। তবে এগুলোকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা জরুরি। কেননা, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।