ইসাবেলের অন্যতম বড় সমস্যা ছিল তার দলের প্রবীণ নেতা ও ব্যক্তিগত সচিব হোর্হে লোপেজ রিগা। দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। দেশবাসীর কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘জ্যোতিষী’ হিসেবে। আর শেখ হাসিনার অন্যতম বড় সমস্যা ছিল, তার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা, প্রবীণ ব্যবসায়ী নেতা সালমান এফ রহমান। তিনিও দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। দেশবাসীর কাছে তিনি ‘দরবেশ’ হিসেবে পরিচিত
ইসাবেল পেরন ও শেখ হাসিনার শৈশব খুব একটা সুখকর ছিল না। তারা দুজনই বেড়ে উঠেছিলেন নানারকম দুঃখ-কষ্ট ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই শাসক হিসেবে তাদের হওয়া উচিত ছিল গণতান্ত্রিক ও মানবিক। কিন্তু সেই পথে তারা পা বাড়াননি। ক্ষমতার মোহে তারা হয়ে উঠেছিলেন মায়াবী ঘাতক। এক সময়ের মজলুম পরিণত হয়েছিলেন অত্যাচারী শাসকে। এ যেন নিজের সঙ্গেই প্রতারণা।
ছাত্র-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর তার পরিবারের সদস্য ও সাঙ্গোপাঙ্গদের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, লুটপাট ও টাকা পাচারের বিষয়টি এখন বেশ খোলামেলাভাবেই আলোচিত হচ্ছে। শেখ হাসিনা তার শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম এবং আয়নাঘরের মাধ্যমে নিরপরাধ মানুষকে পৈশাচিক নির্যাতনের নির্দেশনা দেওয়ায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাকে উল্লেখ করা হচ্ছে ‘নটোরিয়াস ডিক্টেটর’ বা ‘নৃশংস স্বৈরশাসক’ হিসেবে। এর আগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেশ কয়েকজন নারী সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই কমবেশি কর্তৃত্ববাদের অভিযোগ আছে। কিন্তু শেখ হাসিনার মতো এমন সর্বগ্রাসী দুর্নীতিপরায়ণ এবং অনুভূতিহীন দানবীয় শাসক মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিরল। আধুনিক বিশ্বে তার সঙ্গে শুধু আর্জেন্টিনার পতিত স্বৈরশাসক ইসাবেল পেরনকেই তুলনা করা যায়। ইসাবেল কর্মজীবন শুরু করেছিলেন নাইট ক্লাবের একজন নর্তকী হিসেবে। অনেকটা নাটকীয়ভাবে তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ইসাবেল সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি আধুনিক বিশ্বের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। তার নির্দেশে সেনাবাহিনী বিরোধী দলের অনেক নেতাকর্মীকে হত্যা ও গুম করে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পেরনপন্থি সরকার অন্তত ৫০০ জনকে গুম এবং ৬০০ জনকে হত্যা করেছে। আর শেখ হাসিনা শুধু চলতি বছর জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে হত্যা করেছেন অন্তত ৮০০ জনকে, গুরুতর আহত হয়েছেন আরও অন্তত দুই হাজারজন। শেখ হাসিনার আমলে গুমের শিকার হয়েছেন অন্তত ৭০০ জন। আর আয়নাঘরের মাধ্যমে যে কতজন নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এর প্রকৃত হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি।
গুম-খুনের মতো নৃশংসতার সঙ্গে যুক্ত থাকা ছাড়াও হাসিনা ও ইসাবেলের মধ্যে আরও কয়েকটি বিষয়ে অদ্ভুত মিল আছে। এই যেমন ধরুন, রাজনীতির প্রতি তাদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। ইসাবেল বলতেন, রাজনীতি তার ভালো লাগে না। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে তিনি ভালোবাসেন। আবার শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন, তখন তিনি ছিলেন একজন গৃহবধূ। এর আগে তার কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না—এমন কথা বলা যাবে না। কেননা একটি রাজনৈতিক পরিবারে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ছাত্ররাজনীতিও করেছেন; কিন্তু ভারতের জওহরলাল নেহরু যেমন তার কন্যা ইন্দিরাকে রাজনৈতিক তালিম দিয়েছিলেন, তেমন তালিম শেখ হাসিনাকে তার পিতা শেখ মুজিব দেননি। মেয়েকে তিনি রাজনীতিতে দেখতে চাইলে অত শিগগির বিয়েশাদি দিয়ে ঘর-সংসারী হতে দিতেন না। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের এক ঘোর দুঃসময়ে শেখ হাসিনা দলের হাল ধরেন। আশির দশকের শুরুতে বিবিসির সাংবাদিক জন রেনারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, রাজনীতি তার ভালো লাগে না। রাজনীতিকে তিনি ঘৃণা করেন। তিনি তার পিতা-মাতা এবং ভাইদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে চান। বিবিসির সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের লেখা ‘এক জীবন এক ইতিহাস’ বইয়ের ২২৮ পৃষ্ঠায় এসব কথা উল্লেখ আছে।
বাস্তবিক রাজনীতির প্রতি ইসাবেল এবং শেখ হাসিনার যেমন বিশেষ আগ্রহ ছিল না, তেমনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাও তারা খোঁজেননি। সত্তরের দশকে দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদীদের মদদে যে হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি সক্রিয় ছিল, সেই রক্তাক্ত রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি হিসেবে ‘ক্ষমতা’ তাদের খুঁজে নিয়েছিল। আর ক্ষমতা হাতে পেয়েই তারাও সর্বগ্রাসী আধিপত্য বিস্তারে যথারীতি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। নিজ নিজ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তারা রাজনৈতিক হত্যা এবং গুমের মতো মানবতাবিরোধী কাজের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর চেয়ে মর্মান্তিক বিষয় এই যে, হত্যা ও গুমের মতো মানবতাবিরোধী কাজকে তারা কোনো অন্যায় বলে মনে করেননি। এসব তারা বৈধতা ও মান্যতা দিয়েছেন।
ইসাবেল এবং হাসিনা—এ দুই নৃশংস স্বৈরশাসকের জীবন অতি নাটকীয়তায় পূর্ণ। শেখ হাসিনার শৈশব ও বেড়ে ওঠার বিষয়ে আমরা কমবেশি জানি। তাই তার প্রসঙ্গে না গিয়ে ইসাবেল সম্পর্কে কিছু কথা বলি। ইসাবেলের জন্ম আর্জেন্টিনার দরিদ্র পাহাড়ি অঞ্চলে। বাবা ছিলেন স্থানীয় ব্যাংকের ম্যানেজার। মাত্র সাত বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাদের পরিবার দেশটির রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সে স্থানান্তরিত হয়। এখানেই তিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেন। শিক্ষাজীবনের শুরুতেই তিনি নৃত্য, পিয়ানো ও ফরাসি ভাষা শিক্ষায় মনোযোগী হন। লেখাপড়ায় মোটেই ভালো ছিলেন না। ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হতে পারেননি। পঞ্চম শ্রেণিতেই ঝরে পড়েন। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে তিনি নাইট ক্লাবের একজন নর্তকী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পাশাপাশি ফোক মিউজিক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হন। ওই সময় একটি নাচের দলের সঙ্গে তিনি দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ সফর করেন। এ সফরের মাধ্যমেই তার জীবনের নাটকীয় পরিবর্তনের সূচনা হয়। পানামা সফরকালে সেখানে ইসাবেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় আর্জেন্টিনার সাবেক সামরিক একনায়ক জেনারেল হুয়ান পেরনের। সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে তিনি পানামায় নির্বাসিত জীবনযাপন করছিলেন। বয়সে হুয়ান পেরন ছিলেন ইসাবেলের চেয়ে ৩৫ বছর বড়। পেরন প্রথম দর্শনেই ইসাবেলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন। পানামা থেকে তারা স্পেনে নির্বাসিত হন এবং বিয়ে করেন। সেখান বসেই পেরন আর্জেন্টিনার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন। ১৮ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে ১৯৭৩ সালে পেরন দেশে ফেরেন। ওই বছর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি তৃতীয়বারের মতো আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হন। আর রানিংমেট হিসেবে ইসাবেল হন ভাইস প্রেসিডেন্ট। ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মাথায় হুয়ান পেরন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে ইসাবেল প্রেসিডেন্ট হন।
ইসাবেল ও হাসিনার মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন অযোগ্য এবং দুর্নীতিপরায়ণ। ইসাবেলের অন্যতম বড় সমস্যা ছিল তার দলের প্রবীণ নেতা ও ব্যক্তিগত সচিব হোর্হে লোপেজ রিগা। দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। দেশবাসীর কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘জ্যোতিষী’ হিসেবে। কেননা ‘হস্তরেখা’ গণনায় তিনি দক্ষ ছিলেন। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হিসেবে তিনি প্রমাণও রেখেছিলেন। ইসাবেলের পতনের কিছুদিন আগে তিনি বিমানযোগে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। আর শেখ হাসিনার অন্যতম বড় সমস্যা ছিল, তার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা, প্রবীণ ব্যবসায়ী নেতা সালমান এফ রহমান। তিনিও দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। দেশবাসীর কাছে তিনি ‘দরবেশ’ হিসেবে পরিচিত। তবে আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে তার জ্ঞানের যে ঘাটতি আছে, তা বলাই বাহুল্য। আর এ ঘাটতির কারণেই তিনি দাড়ি-গোঁফ কামিয়েও পুলিশের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারেননি। অনেকটা অসহায়ভাবেই তাকে গ্রেপ্তারবরণ করতে হয়েছে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন তার বাবার উত্তরাধিকারী হিসেবে। তার বাবা যখন হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, তখন তিনি দেশে ছিলেন না, ইউরোপে বেড়াতে গিয়েছিলেন। অবস্থান করছিলেন বেলজিয়ামে। আর ইসাবেল তার স্বামীর উত্তরাধিকারী হিসেবে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। তার স্বামী যখন মারা যান, তখন তিনিও ইউরোপে বেড়াতে গিয়েছিলেন। অবস্থান করছিলেন ফ্রান্সে। স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে দ্রুত দেশে ফিরে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ইসাবেলের পতনের আগে আর্জেন্টিনায় পোলট্রি এবং ডিমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি দেশবাসীকে জানিয়েছিলেন, এই কারসাজির সঙ্গে তার সরকার যুক্ত নয়। তথাপি গণবিক্ষোভ সামাল দিতে তিনি বাজারমূল্যের চেয়ে অর্ধেক দামে পোলট্রি এবং ডিম বিক্রি শুরু করেছিলেন। আবার শেখ হাসিনার আমলের শেষদিকেও পোলট্রি এবং ডিমের দাম বৃদ্ধি পায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘বর্ষাকালে মুরগি ডিম একটু কম পাড়ে।’ তিনি সবাইকে বর্ষার আগে ডিম কিনে সিদ্ধ করে ফ্রিজে সংরক্ষণে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
ইসাবেল এবং হাসিনার পতনের সঙ্গে হেলিকপ্টারের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। ১৯৭৬ সালের ২৪ মার্চ একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন ইসাবেলের পতন হয়, তখন তাকে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে একটি হেলিকপ্টারে অজ্ঞাত স্থানে নেওয়া হয়। আর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন হলে তাকেও গণভবন থেকে হেলিকপ্টারে সামরিক বিমানঘাঁটিতে নেওয়া হয়। সেখান থেকেই তিনি একটি সামরিক বিমানে ভারতে পালিয়ে যান।
ইসাবেল যখন রাজনীতি শুরু করেন, তখন তিনি স্পেনে নির্বাসিত ছিলেন। সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি আবার স্পেনে নির্বাসিত হয়েছেন। এখনো তিনি জীবিত আছেন এবং স্পেনে বসবাস করছেন। আর শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন অর্থাৎ দলের সভাপতি হন, তখন তিনি ভারতের দিল্লিতে ছিলেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পাড়ি দেওয়ার পর ছাত্র-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানে তিনি আবার ভারতেই পালিয়ে গেছেন এবং এখন দিল্লিতে অবস্থান করছেন।
ইসাবেলের বিরুদ্ধে গুম ও হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০০৭ সালে আর্জেন্টিনার একটি আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। কিন্তু স্পেনের একটি আদালত তাকে আর্জেন্টিনার কাছে হস্তান্তরের বিপক্ষে রায় দেন। ফলে তিনি এখন স্পেনেই বসবাস করছেন। আর শেখ হাসিনার পতনের পর তার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে একাধিক মামলা হয়েছে। তবে বিচার এখনো শুরু হয়নি। বিচারে সাজা হলে ভারত থেকে তাকে ফেরত আনা যাবে কি না, এ বিষয়টি এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ...
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক