প্রধান উপদেষ্টা, দেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের ইমামতিতে রাষ্ট্র মেরামতের ছয় কান্ডারির ছয় কমিশনের নতুন করে খুব বেশি প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে না। সেই কবে থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মাথা ঠুকরে চলছেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। নির্বাচন বিষয়ক কমিশনের কান্ডারির দায়িত্ব তাকেই দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ক প্রচুর হোমওয়ার্ক তার। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান সাবেক বিচারপতি জীবন্ত কিংবদন্তি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান। বাংলাদেশে দুর্নীতির বিষবৃক্ষ উপড়ানোর আহ্বান ও তাগিদের ফেরিওয়ালা টিআইবির ড. ইফতেখারুজ্জামানকে দেওয়া হয়েছে দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব। পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্বে সাবেক স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন সচিব সফর রাজ হোসেন। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। আর সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান শাহদীন মালিক। তারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে ইউনিক-অতুলনীয়ের উদাহরণ।
একসঙ্গে এই হাফ ডজন ব্যক্তিত্বের দায়িত্ব বণ্টনে একটা প্রশ্নের কিঞ্চিৎ ফয়সালাও হয়ে গেল। প্রশ্ন ছিল—সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেবো কোথা? মানে সংস্কারের বটম লাইন হবে কোথায়? কোন জায়গা বা ক্ষেত্র দিয়ে শুরু হবে কাঙ্ক্ষিত সংস্কারটি? প্রশ্নটির জবাব মিলছিল না। তাদের দায়িত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে মোটামুটি খোলাসা হয়েছে, কোনো জায়গাই বাদ দেওয়া হবে না। নির্বাচন, সংবিধান, বিচার, দুর্নীতি দমন, সিভিল-পুলিশ ছয়টি বিভাগেই মেরামত চলবে। আর এ কটি সেক্টরে সংস্কার হলে তেমন কিছু বাকি থাকে না। এ কাজে তারা সহায়ক নেবেন। আর সঙ্গে রাখবেন ছাত্র শ্রমিক জনতা আন্দোলনের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের। রাস্তা বা কোনো ঘরদুয়ার সংস্কার হলে কয়েক রাত-দিন বেশি খাটুনি করে কাজটা তুলে আনা যায়। কিন্তু দীর্ঘদিনের চর্চায় প্রতিষ্ঠিত কুপদ্ধতি সারানো দিন-মাস-বছরের বিষয় নয়। আবার নিয়ত সাফ থাকলে, কর্মপদ্ধতি টেকসই হলে, পরিচ্ছন্ন লোকদের স্টিয়ারিংয়ে রাখলে পয়লা রাত থেকেই বিড়াল মারা পড়তে বাধ্য। এখন পর্যন্ত ভরসা এ জায়গাতেই।
এর বিপরীতে সংস্কারের নামে বিভিন্ন সেক্টরে যা ঘটেছে বা ঘটছে, তা কেবলই অদলবদল। রামের বদলে রহিম, আবুলের চেয়ারে বাবুল বা কামালের জায়গায় জামাল। বিশেষ করে প্রশাসনে কেবল তালগোল বা আউলাঝাউলা নয়; জব্বরের বলী খেলার দশা একদম প্রকাশ্যে। তা ঠেকাতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ডাকতে হয়। পদবঞ্চিত কর্মকর্তাদের দাবি, আওয়ামী লীগ আমলে যেসব কর্মকর্তা সুবিধা পেয়ে এসেছেন, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
ক্রাইটেরিয়া হচ্ছে নিজেকে বঞ্চিত-নির্যাতিত মর্মে ট্যাগ নিশ্চিত করা। আশ্চর্য ম্যাজিকে পুলিশ-সিভিল দুই জায়গাতেই এ কামে কামিয়াবি হয়েছেন অনেকে। আবার সত্যিকারের বঞ্চিত-নিগৃহীত কারও কারও নসিবে নেমেছে নতুন প্রতারণা। এ নিয়ে প্রশাসনে এক চরম অরাজকতা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অবসরে পাঠানো পাঁচ অতিরিক্ত সচিবকে ১৭ আগস্ট বিভিন্ন দপ্তরের সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে এক দিন পরই ১৮ আগস্ট তা বদল করে তাদের ‘সিনিয়র সচিব’ করা হয়। আবার এই পাঁচজনের মধ্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া এম এ আকমল হোসেন আজাদকে তিন দিনের মাথায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে বদলি করা হয়। রেলের সচিব পদে আনা হয় পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য আব্দুল বাকীকে। একইভাবে ১৪ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগ পান মো. মোকাব্বির হোসেন। তিন দিনের মাথায় ১৭ আগস্ট তাকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। জনপ্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে এভাবে ঘন ঘন চলছে সিদ্ধান্ত বদল। কোনো পদে কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার আদেশ জারির ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সেই সিদ্ধান্ত বদল করতে হয়। এই তুলকালামের মধ্যেই জেলা প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে মশকরাময় ঘটনা।
দুই দফায় দেশের ৫৯ জেলায় নতুন ডিসি দিয়ে আবার দুই দফায় তা সংশোধন। কাঁচামালের বাজারি কাইজ্জার মতো কাণ্ডকীর্তিতে প্রশাসনের হেড কোয়ার্টার সচিবালয়ে এখন এক হাস্যকর হাউকাউ। সচিবালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের অন্দর মহলের কিছু ঘটনা এরই মধ্যে গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে। ডিসি নিয়োগ নিয়ে সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের হট্টগোলের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে তা বিজ্ঞপ্তি আকারে জারি করতেও হয়েছে। পদ-পদায়ন হাসিল বা বাতিলের এ ধারা চলতে থাকলে জনপ্রশাসন বা পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেক্টরের ছয় সংস্কারকের কী দশা হতে পারে? বিগত ১৫ বছর ৭ মাসের নোংরামিতে এখন প্রশাসনের যে কোনো কর্মকর্তা নিজেকে পদবঞ্চিত মনে করতে পারেন। কিন্তু তার প্রতিকারের জন্য নিয়মনীতি আছে, সেটা অনুসরণ না করে চাপ দিয়ে নিয়োগ হাসিল বা বাতিল খুবই অন্যায্য। তা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের স্পিরিটের সঙ্গে বেমানান। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জনপ্রশাসনে প্রথম বড় পদোন্নতি হয় ১৩ আগস্ট। দিনটিতে ১১৭ জন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবকে উপসচিব করা হয়। এর এক সপ্তাহের মধ্যে ২২৩ উপসচিবকে যুগ্ম সচিব করা হয়। এরপর ২৫ আগস্ট ১৩১ কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব করা হয়। আর নিচের দিকে পিয়ন-আরদালির হিসাব তো আলাদা এবং অগুনতি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪ কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে উপসচিব, এরপর যুগ্ম সচিব ও সর্বশেষ পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন। ৫ আগস্টের আগেও তারা ছিলেন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব। চাকরির বাকি সময়ে পদোন্নতি হবে না—এমনটা নিশ্চিত জেনে অবসরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারা। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কর্মকর্তাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন হয়েছে। অল্প সময়ের ব্যবধানে তিন ধাপে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
এখন হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ পদে গিয়ে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাদের কারও কারও সমস্যা হতে পারে। অল্প সময়ে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব হওয়ার এমন রেকর্ড এবারই প্রথম। তারা কাজে কেমন যোগ্যতার পরিচয় দেন, এটা যার যার ব্যাপার। বায়না ধরে বা না চাইলেও এভাবে পদপদায়নের এ রেকর্ড সামনের দিনগুলোতে নতুন কোন রেকর্ড তৈরি করবে, তা অপেক্ষা করে দেখার বিষয়। আর যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারলে সেটা হবে আরেকটি রেকর্ড। বলার অপেক্ষা রাখে না, এবারের এ রেকর্ডের রেকর্ড ও প্রশাসন সংস্কারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ক্ষমতার পালাবদলের পর রাজনীতির মতো প্রশাসনেরও অনেকের রূপ বদলে যাওয়া অবধারিত নিয়মের মতো। কারণ এ দেশে দল আর সরকার একাকার হওয়া দোষের মনে করা হয় না। আর আরেকটা শ্রেণি ঘোরে সুবিধার আশায়। গর্বের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের প্রভাবশালীদের সঙ্গে ছবি পোস্ট করে ক্ষমতাকেন্দ্রের আপনার আপন জানান দেওয়া মহলটিরও এখনকার পরিচয় ‘বঞ্চিত-নির্যাতিত’। তা প্রমাণ করতে গিয়ে সেসব ছবি তারা ৫ আগস্টেই মুছে ফেলেছে। এখন তাদের সময় কাটে বিগত সরকারের গোষ্ঠী উদ্ধারে। আর ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ক্ষমতাধরদের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টায়। তাদের দাপটে প্রকৃত বঞ্চিত-ত্যাগীরা পড়ে থাকছে চিপাচাপায়। এটাই বাস্তবতা। এদিকে, ১৫ বছর ৭ মাসের তুলনায় ৩০-৩১ দিন কোনো সময়ই নয়। কিন্তু, মানুষের চাহিদা-আকাঙ্ক্ষা অফুরান। দাবিও বিস্তর। বন্যা-দুর্যোগসহ নানা দুর্গতির মধ্যেও তাদের দাবিতে কোনো ছাড় নেই। নগদে সবার সব দাবি এখনই পূরণ করতে হবে। মানতে হবে। নইলে আদায় করে ছাড়া হবে। এ অবস্থা কারা করেছে, তা সবারই জানা। দাবিদাররা এতদিন কোথায় ছিলেন, কেন তারা দাবি নিয়ে এভাবে সোচ্চার হননি বা হতে পারেননি, তাও জানার বাইরে নয়। ১৫ বছর ঘুমে নয়, সজাগই ছিলেন তারা। এখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাচ্ছেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাক।
আসলে স্বৈরাচার যত না ব্যক্তি; তার চেয়ে বেশি পদ্ধতি বা ব্যবস্থা। স্বৈরাচার তৈরির সব জানালা খোলা রেখে খানা-খাদ্য বহাল রেখে দরজা বন্ধ করলে ফজিলতে আসে না। শাসক আর শাসন ভিন্ন কথা। স্বৈরশাসক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী শাসন খতম হয়ে যায় না—এ দেশের জন্য কথাটা বেশি প্রযোজ্য। সমাজের মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে এই মজাদার শাসনের কায়া ও ছায়া বসত বাঁধে। স্বৈরশাসক বিদায় নিলেও রেখে যায় ধ্বংস করা রাষ্ট্রীয় কাঠামো, দুর্বল প্রতিষ্ঠান এবং বিকৃত প্রশাসন। দীর্ঘ সময় স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে থাকা নাগরিকদের মানসিকতায়ও বিকৃতি দেখা দেয়। তারা জ্বি হুজুরে নগদ কিছু প্রাপ্তিতে সুখ-সম্ভোগ খোঁজে। তা যে কোনো দল বা ক্ষমতাসীনদের উছিলায়ই হোক। পর্বতসম দায়িত্ব ইউনূস সরকারের। তার সিলেবাস ও কাজের ভলিউম খুব মোটা। এ সিলেবাস শেষ করা এক মাসের কাজ নয়। এর পরও একটার পর একটা নয়, সমানে সব চ্যাপ্টারেই চোখ ফেলতে হচ্ছে। রাগ বা অভিমানের সুযোগ নেই। সংস্কারের কথা দিতে হচ্ছে। এরই মধ্যে নানান সংস্কারের প্রয়োজনে পাকা-করিৎকর্মা বিশিষ্টজনকে দিয়ে কমিশনও করেছে। আবার এ সুযোগে সংস্কারের আওয়াজে মতলববাজির মশকরায় লিপ্তদের রোখাও যাচ্ছে না। নিষ্ঠুর এ বাস্তবতায় নতুন উনুনে দেশ ও সমাজের অনন্য হাফ ডজন ব্যক্তিত্ব। স্ব স্ব ক্ষেত্রে তারা সবাই তারকা।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন