একটা সময় সরকারপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন—এমন ঘোষণায় সবার মধ্যে কৌতূহল ও আগ্রহ সৃষ্টি হতো। কী ঘোষণা বা নির্দেশনা আসছে, তা জানতে উদগ্রীব থাকত মানুষ। সাগ্রহে টিভির সামনে বসে প্রতীক্ষায় প্রহর গুনত—নতুন কী ঘোষণা বা বার্তা আসছে দেশবাসীর জন্য। গত সাড়ে ১৫ বছর শেখ হাসিনার একনায়কত্ব ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে মানুষ সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। জাতির উদ্দেশে ভাষণ কিংবা সংবাদ সম্মেলন, কোনোটাতেই জনসাধারণের তেমন কোনো উৎসাহ ছিল না। তার অন্যতম কারণ, ভাষণ মানেই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কিছু বিষ উদগিরণ আর নিজের আমিত্ব জাহির করে মিথ্যা আর ধোঁকাবাজির বেসাতি। লুটতান্ত্রিক উন্নয়নের একই ফিরিস্তি শুনতে শুনতে মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠেছিল।
অতীতচর্চাও ছিল জাতির উদ্দেশে ভাষণের অন্যতম উপাদান। কৃত্রিম আবেগমিশ্রিত কথামালায় জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে ফেরানোর একটা অপচেষ্টা থাকত। সংবাদ সম্মেলনে সাজানো প্রশ্ন আর তেলবাজি, মোসাহেবির প্রতিযোগিতা জনমনে তীব্র ঘৃণার উদ্রেক করত। সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন আবার রাষ্ট্রপ্রধানের ভাষণ শোনার জন্য মানুষ মুখিয়ে থাকছে।
দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পর বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এটি ছিল নিকট অতীতের ব্যতিক্রম। অত্যন্ত সাবলীল ও সহজবোধ্য ভাষায় তার সরকারের এক মাসের কর্মকাণ্ড এবং রাষ্ট্র সংস্কারসহ সামনের দিনগুলোর পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন জাতির সামনে। বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বার্তাকে প্রতিফলিত করতে সংবিধানসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কার তার সরকারের অগ্রাধিকার। ভাষণে তিনি গত ১৫ বছরেরও বেশি সময়ে দেশের প্রশাসন, অর্থনৈতিক খাত কিংবা বিভিন্ন জায়গায় যেসব সংকট তৈরি হয়েছে, সেগুলোর ওপর আলোকপাত করেছেন। পাশাপাশি সংকট নিরসনে সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ সংস্কার পরিকল্পনার কথাও জানান দিয়েছেন। গভীর সংকটকালে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখে দায়িত্বপালনরত অরাজনৈতিক সরকারপ্রধানের দেওয়া এ ভাষণ আশাব্যঞ্জক।
বুধবারের ভাষণটি ছিল জাতির উদ্দেশে তার দ্বিতীয় বক্তব্য। পরিমিতির দিকটি উপেক্ষা না করে পরিশীলিত ভাষায় দেওয়া এ ভাষণের বড় দিক হচ্ছে—রাষ্ট্র সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠনের ঘোষণা। বলা হচ্ছে, এটি মূলত বহুল কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের পথনকশা। তিনি জানান, বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠন করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে এ কমিশনগুলো পরিচালনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিশন গঠনের পাশাপাশি বলা যায়, দেশকে নির্বাচনের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি অনুযায়ী একটি রোডম্যাপে এগোনোর বিষয় তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হওয়ার পর এসব কমিশনপ্রধান আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী ১ অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করবেন এবং তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন ড. ইউনূস। কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শসভার আয়োজন করবে বলেও জানান তিনি।
গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিশনগুলোর দায়িত্ব কারা পেয়েছেন তা নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা ও মতামত আসছে সামাজিকমাধ্যমে। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারকে। পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব পেয়েছেন সফর রাজ হোসেন। তিনি সাবেক স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন সচিব। ২০০৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৫ সালের মার্চ পর্যন্ত তিনি জনপ্রশাসন সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। যদিও তার নামটি ভুলভাবে সরফরাজ চৌধুরী হিসেবে আসায় কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল।
বিচার বিভাগ সংস্কারের দায়িত্ব পালন করবেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান। তিনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ছিলেন। অত্যন্ত দক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ বিচারক হিসেবে সুনাম থাকলেও পরিবারে একজন বিএনপি নেতা থাকায় আওয়ামী লীগ তাকে প্রধান বিচারপতি করেনি। দুদফা তাকে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতি করায় অভিমানে তিনি পদত্যাগ করেন। দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান হয়েছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ। এ ছাড়া জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয়েছে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব পেয়েছেন ড. শাহদীন মালিক। তারাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ।
রাষ্ট্র ও শাসনতন্ত্রে সংস্কারের মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন ও সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ঘোষিত এ পথরেখা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন দেখতে চাইবে জনসাধারণ। যারা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন, তাদের অনেকের ব্যাপারে দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশের মতাদর্শগত সীমাবদ্ধতা আছে। তবুও নিশ্চয়ই তারা দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অন্তর্নিহিত বার্তা এবং জনপ্রত্যাশার প্রতি সুবিচার করতে পারবেন। রাজনৈতিক দলগুলোও কমিশনকে উদার মনোভাব নিয়ে সহযোগিতা করলে ভালো কিছু আশা করা যায়। গঠিত কমিশন নির্মোহভাবে রাষ্ট্রের স্বার্থে, জনগণের কল্যাণে এবং নির্ভেজাল গণতন্ত্র চর্চার প্রয়োজনে কাজ করলে বিতর্ক এড়াতে পারবে। দল বা ব্যক্তিকে টার্গেট করে কোনো সংস্কার প্রস্তাব আনলে তা বিতর্ক উসকে দেবে। তখন সংস্কার কমিশনের সংস্কারের দাবি ওঠাও অস্বাভাবিক নয়।
প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে গত এক মাসে সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেছেন। এক মাসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ১৯৮টি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার সরকার। তিনি জানান, খুব অল্প জনবল নিয়ে দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু করা হলেও প্রথম দিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে পাঠানো বিবিধ প্রস্তাব বিষয়ে দ্রুতগতিতে এবং আইনগত সব বাধ্যবাধকতা মেনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জনগণের উদ্দেশে ড. ইউনূস যথার্থভাবেই বলেছেন, ‘আমাদের কাজ বড় কঠিন, কিন্তু জাতি হিসেবে এবার ব্যর্থ হওয়ার কোনো অবকাশ আমাদের নেই। আমাদের সফল হতেই হবে। এ সাফল্য আপনাদের কারণেই আসবে।’
ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবে শহীদদের পরিবারকে আশ্বস্ত করে সব শহীদের পরিবারকে পুনর্বাসন এবং আহত শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় সরকার বহন করবে বলে ভাষণে উল্লেখ করেছেন। আহতদের দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা এবং শহীদদের পরিবারের দেখাশোনার ‘জুলাই গণহত্যা স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথাও পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। দেশের সাংবাদিক সমাজ আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার বিচার চাইছে। নিজের বাসায় শয়নকক্ষে নৃশংসভাবে খুন হওয়া সাংবাদিক দম্পতির হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার নিয়ে প্রায় একযুগ ধরে যে তামাশা চলছে, তার অবসান চায় সাংবাদিক সমাজ। প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাননি। তিনি বলেছেন, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডসহ পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের বিচারকে তার সরকার অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এ সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তিতে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
দেড় দশক ধরে মানুষ প্রায় বোবা হতে বসেছিল। মন খুলে কথা বলার সুযোগ ছিল না। প্রাণ খুলে হাসতে ভুলে গিয়েছিল দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী। স্বাধীনভাবে লেখার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল ফ্যাসিবাদী শাসকশ্রেণি। বাকস্বাধীনতা হরণ করতে নানা কালাকানুন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ড. ইউনূস সেই স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা পুনরুল্লেখ করেছেন। তিনি দেশের জনগণের উদ্দেশে বলেছেন, আপনারা মন খুলে আমাদের সমালোচনা করেন। আমরা সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মিডিয়া যাতে কোনোরকম বাধাবিপত্তি ছাড়া নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারে, সেজন্য একটি মিডিয়া কমিশন গঠন করা সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে বলেও জানান তিনি।
সরকারের এক মাস অতিক্রান্ত হয়েছে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার মধ্যে। বিশেষত জেলা প্রশাসক পর্যায়ে পদায়ন কেন্দ্র করে গত কয়েক দিন ধরে সচিবালয়ে কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা হট্টগোল করে চলেছেন। সরকারও বারবার সিদ্ধান্ত বদল করে এক ধরনের দায় স্বীকার করে নিচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে দায়িত্ব গ্রহণের এক মাসে প্রশাসনে কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, এক মাসে জনপ্রশাসনের ১৩৫ জন অতিরিক্ত সচিব, ২২৭ জন যুগ্ম সচিব ও ১২০ জন উপসচিবকে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে।
এ ছাড়া এখন পর্যন্ত ৫৯টি জেলার জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং নতুন ৫৯ জন জেলা প্রশাসককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ৬৭ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। ১০ জন যুগ্ম সচিব, ৮ জন অতিরিক্ত সচিব এবং ৬ জন সচিবকে ওএসডি করা হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের ৮০ জন ডিআইজি, ৩০ জন পুলিশ সুপারসহ ১১০ জনকে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। একজন ডিআইজি, একজন অ্যাডিশনাল ডিআইজি এবং চারজন পুলিশ সুপারকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। এর পাশাপাশি আইজিপিসহ ১০ জন অতিরিক্ত আইজি, ৮৮ জন ডিআইজি, ২১ জন অ্যাডিশনাল ডিআইজি এবং ১৭৭ জন পুলিশ সুপারসহ ২৯৭ জন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে।
বর্তমান সরকার ছাত্র-জনতা গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছে। কোনো দলের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা যেমন নেই, তেমনি প্রশাসন বিন্যাসের ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দের বিষয় থাকার কথা নয়। তবে বিগত সরকারের দলীয়করণের ফলে প্রশাসনে যে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনের গুরুভার এ সরকারের ওপর বর্তেছে। যে কারণে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে চিন্তাভাবনা করে। পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের অতীত রেকর্ড ভালোভাবে পর্যালোচনা করা জরুরি। রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে তাদের পেশাগত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, নীতিনিষ্ঠা ও সততাই বিচার্য বিষয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেহেতু বৈষম্য ও বঞ্চনার প্রতিকার করার বিষয়ে সরকারের অঙ্গীকার রয়েছে; সেহেতু বিগত শাসনকালে সত্যিকারের বঞ্চিতদের মধ্য থেকে যোগ্য ও কর্মদক্ষ কর্মকর্তার এখন মূল্যায়িত হওয়ার কথা। আবার বঞ্চিত সেজে পতিত স্বৈরাচারের দোসর কিংবা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তরা যাতে কোনোভাবেই পুরস্কৃত না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে