ড. মাহ্বুব উল্লাহ্ অর্থনীতিবিদ ও লেখক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ১৯৭৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেছেন। পাশাপাশি ১৯৯৩-১৯৯৭ মেয়াদে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য এবং ২০০৩-০৬ মেয়াদে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর এবং ভারতের জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ষাটের দশকে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক; স্বাধীনতার পর ন্যাপের রাজনীতিতে যুক্ত হন। সম্প্রতি সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তী
সরকারের কাজ, রাষ্ট্র ও সংবিধানের সংস্কার, প্রশাসনের স্বচ্ছতা-জবাবদিহি প্রভৃতি বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
কালবেলা: জুলাই ও আগস্টে আমরা ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থান দেখলাম। এই গণঅভ্যুত্থান আমাদের কী বার্তা দিচ্ছে?
মাহ্বুব উল্লাহ্: একটি জনগোষ্ঠী যদি দীর্ঘদিন ধরে শোষণ নিপীড়ন বঞ্চনার মধ্য দিয়ে যায়; যদি জেলজুলুম, গুপ্তহত্যা, গুম-খুনের শিকার হয়; যদি বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিপতিত হয়—তখন দেয়ালে মানুষের পিঠ ঠেকে যায় এবং মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মানুষ যখন তার অধিকার পায় না, বিচার পায় না তখন সমাজের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। দেশে যদি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকে, যদি কথা বলার এবং প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা থাকে, যদি মিছিল-মিটিং এবং সমাবেশ করার স্বাধীনতা থাকে—তাহলে মানুষ তাদের ক্ষোভ, বঞ্চনা ও দুঃখের কথা প্রকাশ করতে পারে। আর মানুষ যখন ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে, তখন সেটা কিছুটা হলেও কমে যায়।
কিন্তু স্বৈরশাসনের ফলে যখন মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে না তখন একটা সময় এই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। বাংলাদেশের মানুষ পাঁচ বছর পর একটাই মাত্র অধিকার প্রয়োগ করতে পারে। সেটা হলো ভোট দেওয়ার অধিকার। সেই ভোটও যদি দিতে না পারে, তাহলে মানুষ কোনো কিছুর পরোয়া না করে রুখে দাঁড়াতে চায়।
এই গণঅভ্যুত্থানকে আমরা বলতে পারি, গত ১৬ বছর ধরে যে দমবন্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, সেটা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটি বজ্রাঘাত। মানুষ তার প্রাণের মায়া না করে গর্জে উঠেছে। ১৫ দিন আগেও ভাবা যায়নি যে মানুষ এতটা সাহসী হয়ে উঠবে, তারাই প্রতিবাদ করে প্রাণ দিতে রাস্তায় নেমেছে।
এখান থেকে আমাদের জন্য বার্তা একটাই। যারাই এ দেশ শাসন করুক, যখনই করুক, তাদের মনে রাখতে হবে তারা জনগণের হয়ে দেশ শাসনের দায়িত্ব পেয়েছেন। তারা জনগণের সেবক। তারা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছেন এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা তাদের পূরণ করতেই হবে। তারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, রাষ্ট্রের মালিক নন। তারা যদি এটা ভুলে যান, তাহলে সেটা খুবই বিপজ্জনক হবে। তাই ভবিষ্যতে যারা বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় আসবেন, তাদের জন্য এবারের জুলাই-আগস্টের মহান বিপ্লব একটা বার্তা হয়ে থাকল।
কালবেলা: রাষ্ট্র সংস্কারের কথা উঠছে। একই সঙ্গে উঠছে রাজনীতি সংস্কারের কথাও। রাজনীতি সংস্কার কীভাবে হতে পারে বলে মনে করেন?
মাহ্বুব উল্লাহ্: সবকিছুর মূল হলো রাজনীতি। এ সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে, তা হলো—‘পলিটিকস ইন কমান্ড’। এ রাজনীতি যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয় তাহলেই দেশের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। রাষ্ট্র থেকে মানুষ তাদের কাঙ্ক্ষিত সুযোগ-সুবিধাগুলো তখন আর পায় না। আমাদের দেশে রাজনীতির মোটা দাগে যে বয়ান সেখানে একটির সঙ্গে আরেকটির পার্থক্য অত্যন্ত বিশাল। একটা বয়ান মনে করে—তারা ছাড়া এ দেশে আর কারও রাজনীতি করার অধিকার নেই। তারা অন্যদের অস্তিত্বও অস্বীকার করতে চায়। এ ধরনের বয়ান বা চিন্তাভাবনাই ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়।
গত ১৬ বছরে যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা প্রায়ই বলতেন—এটা বিশ্বাস না করলে তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই, ওটা বিশ্বাস না করলে তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই। ভাবটা এরকম যে, তারা পারলে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে বেআইনি ঘোষণা করে। বিরোধী মতাদর্শের রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এমন ঘটনাও ঘটেছে। বিগত ১৬ বছরে তাদের প্রয়াস ছিল বাহ্যিকভাবে বহুদলীয় ব্যবস্থা বজায় রেখে কার্যত একটি একদলীয় শাসন কায়েম করা।
তাদের রাজনীতির আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য, ক্ষমতা কাঠামো এককেন্দ্রিক করা। আর এই এককেন্দ্রীকরণ এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর আঙুল হেলানো ছাড়া এ দেশে কোনো সিদ্ধান্তই হবে না। স্বেচ্ছাচার এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীভুবন এতটাই খারাপ অবস্থায় গিয়েছিল যে, দেশের মন্ত্রিসভা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল। সংসদে কোনো বিরোধী দল ছিল না। ফলে সংসদ একদমই কার্যকর ছিল না। বিরোধী দল নামে যেটা ছিল, তা ছিল সিট ভাগাভাগির এবং সমঝোতার বিরোধী দল। ছিল গৃহপালিত বিরোধী দল।
এ পরিপ্রেক্ষিতে যে রাজনৈতিক সমস্যার উদ্ভব হয়, তা সহজে সমাধান করার নয়। তত্ত্বগতভাবে বলতে হয়, এমন অনেক সমাজ আছে যে সমাজের ভিত্তিমূল স্বৈরতন্ত্রের জন্য উপযোগী। আমাদের সমাজটাও ঠিক সেরকম কি না, তা ভেবে দেখতে হবে। যদি তাই-ই হয়, তাহলে বলব আমাদের উত্তরণের পথটা সহজ হবে না।
আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা সব থেকে বড় যে ক্ষতিটা করেছে তা হলো—তারা দেশের মুষ্টিমেয় ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের সঙ্গে এক ধরনের অশুভ যুগল বন্ধন তৈরি করেছিল। আর এর পাশে এনে দাঁড় করিয়েছিল পুলিশ, র্যাব, আমলাতন্ত্র এমনকি সামরিক বাহিনীর কিছু ব্যক্তিকেও। এই অশুভ নেক্সাস একে অন্যকে যেভাবে সমর্থন জুগিয়েছে, তাতে অন্যদের পক্ষে তা ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি। যখনই কেউ এই নেক্সাস ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে, তার ওপর খড়গহস্ত হয়েছে এই নেক্সাসের দোসররা। বিএনপি অনেকবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তারা এ নেক্সাসের সঙ্গে পেরে ওঠেনি।
কালবেলা: আমরা এ ধরনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারব কি?
মাহ্বুব উল্লাহ্: আমরা এ ধরনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারব কি না, তা ভাবতে গেলে প্রথমেই আমাদের সমাজকে বিশ্লেষণ করতে হবে। শুধু একটি ডিক্রি জারি করে বা কোনো আদেশ বা আইনের বলে এ রাজনীতি বদলানো কতটা সম্ভব, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
ব্যালিংটন মুর তার লেখা বইতে একটি কথা লিখেছিলেন—‘নো বুর্জোয়া নো ডেমোক্রেসি’। অর্থাৎ যে দেশে সুস্থ সুঠাম বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে ওঠে না, সে দেশটা গণতন্ত্রের জন্য উপযোগী নয়। অন্যদিকে আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর থেকেই গড়ে ওঠা বুর্জোয়া শ্রেণির দিকে তাকালে শুধু লুণ্ঠনই দেখতে পাই। তারা লুটতরাজ করে ধনী হয়েছে এবং তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনো কাজে আসে না। সমাজের বুর্জোয়ারা যদি এরকম লুণ্ঠনকারী চরিত্রের থেকে যায়, তাহলে তারা এমন কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে দেবে না, যেখানে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে।
আমরা আমাদের পাশের দেশ ভারতের উদাহরণ দিতে পারি। ভারতকে বলা হয় সব থেকে বড় গণতন্ত্রের দেশ। এমনকি আজকের এই নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী শাসনামলেও ভারতে গণতন্ত্র কার্যকর রয়েছে। যদিও অনেক অবক্ষয় হয়েছে, তবে সেখানে গণতন্ত্র ভেঙে পড়েনি। আর এর অন্যতম কারণ হলো—ভারতের বুর্জোয়া গোষ্ঠী। ভারতে বেশ কিছু ধনী বুর্জোয়া পরিবার রয়েছে, যাদের ঐতিহ্য অনেক গভীরে।
কিছু সংস্কার করে দিলে বা কিছু নিয়মকানুন পরিবর্তন করে দিলেই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর হয়ে যাবে তেমনটা আমি মনে করি না। তবে এভাবে কিছুটা কাজ হবে, এটা সত্য। তবে তা হবে কসমেটিক চেঞ্জ অর্থাৎ মেকআপ করে সুন্দর দেখানো। আমাদের প্রথমে উচিত সমাজ এবং রাষ্ট্রের সত্যিকার অবস্থাটি বোঝার চেষ্টা করা। আর এখানে সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের রুগণ রাজনীতিকে সুস্থ করে তুলতে হলে হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, যাতে রুগণ রাজনীতি রুগণ হতে হতে একসময় মৃত্যুবরণ করে। নয়তো বিপ্লব দিয়ে সমগ্র রাষ্ট্রকেই নতুন করে গড়তে হবে।
চারদিক থেকে আমরা সংস্কারের দাবি শুনতে পাচ্ছি। আমিও মনে করি নিঃসন্দেহে সংস্কার দরকার। তবে কী সংস্কার করতে হবে এবং কতটুকু করতে হবে, তা আগে বুঝতে হবে। আর এটা না বুঝলে আমাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে এবং এর লক্ষণ এরই মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে। সমাজে অনেক সময় বিশাল অভ্যুত্থানের পর নৈরাজ্য দেখা দেয়। ফ্রেঞ্চ রেভল্যুশনের পর এমনটাই ঘটেছিল। আমাদের ছাত্র-জনতার অনেক ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে পাওয়া নতুন স্বাধীনতা কোনোভাবেই যেন অশুভ শক্তির দখলে না যায়, সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে।
কালবেলা: অনেকে সংবিধান পরিবর্তন বা নতুন করে লেখার কথা বলছেন। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
মাহ্বুব উল্লাহ্: বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালে প্রণীত হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে কাটাছেঁড়া ও সংশোধিত হয়ে আজকের রূপে রয়েছে। আজকে যারা ক্ষমতায় রয়েছেন, তারাও এই সংবিধান রক্ষা করবেন বলে শপথ নিয়েছেন। তবে এটাও সবাই বোঝেন যে, আমাদের সংবিধান আদর্শ কোনো সংবিধান নয়। এটা কোনো ঐশী গ্রন্থ নয়, যাকে পরিত্যাগ করা বা সংশোধন করা যাবে না। পৃথিবীর অনেক দেশেই সময়ের প্রয়োজনে সংবিধান বারবার পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের সংবিধানও বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে একনায়কতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করে রাখার জন্য। কাজেই এ সংবিধান যে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য উপযোগী নয়, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমি মনে করি নিঃসন্দেহে এ সংবিধানের পরিবর্তন দরকার।
এখন প্রশ্ন হলো, সংবিধান পরিবর্তন হবে কীভাবে? এখনকার সংবিধানকেই কাটাছেঁড়া করে পুনঃলিখন করা হবে, নাকি একেবারেই নতুন করে একটি সংবিধান লেখা হবে? আমার মনে হয় এই সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে সংস্কার করার সুযোগ খুবই কম। সংবিধানের একটি বিরাট অংশজুড়ে এমন কিছু ধারা রয়েছে, যা অপরিবর্তনযোগ্য। এগুলোকে সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং এগুলোতে হাত দেওয়া যাবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানকে ফিরিয়ে আনা জরুরি। একই সঙ্গে বিদ্যমান সরকার রেখেই নির্বাচনের যে সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে, এটাও বিলুপ্ত করা দরকার। আবার সংবিধানের এমন কিছু ধারা রয়েছে, যা আদৌ কোনোদিন বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা হয়নি। যেমন সংবিধানের ন্যায়পাল নিয়োগের কথা রয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও সেই ন্যায়পাল নিয়োগ হয়নি।
আমি মনে করি, সংবিধান কাটাছেঁড়া করে পুনঃলিখনের সুযোগ খুবই কম। তাই নতুন একটি সংবিধান লিখতে হবে যেটা এই মুহূর্তের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। নতুন সংবিধানকে আরও শক্ত ও আঁটসাঁট করে রচনা করতে হবে, যাতে ক্ষমতার অপব্যবহার বা আইন না মানার পথ রুদ্ধ হয়।
সংবিধানের মতো বড় দলিল গণভোটের জন্য উপযোগী নয়। গণভোটের জন্য উপযোগী হলো কোনো একটি আইন বা কোনো একটি বিশেষ চুক্তি। একটি আইন বা চুক্তি গ্রহণযোগ্য কি না, সেটা জনগণের রায়ের জন্য রেফারেন্ডামের আয়োজন করা যেতে পারে। কিন্তু বিরাট কোনো দলিল গণভোটে পাস করানো খুব একটা যৌক্তিক হবে বলে মনে করি না। কারণ মানুষ আইনের সব ধারা বুঝবে না। এমনকি খুবই বিদ্বান ব্যক্তির জন্যও সেটা কঠিন। এজন্য আমার পরামর্শ হলো, একটি সংবিধান প্রণয়ন কমিটি বা constituent assembly গঠন করে তাদের হাতে নতুন সংবিধান লেখার দায়িত্ব দেওয়া।
একটি গণপরিষদ দরকার। তবে এ গণপরিষদ যদি শুধু সংবিধান লেখার জন্য গণপরিষদ হিসেবে কাজ করে তাহলে কিছু জটিলতা দেখা দেবে। আমার মতামত হলো, এ গণপরিষদ একদিকে সংবিধান রচনা করবে, আরেক দিকে তারা দেশও চালাবে। অর্থাৎ সরকার পরিচালনা করবে। এ দুটি কাজ একসঙ্গে তাদের হাতে দেওয়া গেলে সেটা হবে সব থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত।
কালবেলা: রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। এই মুহূর্তে কোন কোন বিষয়ে সংস্কার বেশি জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
মাহ্বুব উল্লাহ্: আমি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে পরিষ্কারভাবে বলেছি যে, ‘টাস্ক ইজ জায়গান্টিক, টাস্ক ইজ হিমালয়ান’ অর্থাৎ আমাদের সমস্যার পাহাড় হিমালয় পর্বতের মতো উঁচু ও বিশাল। এর শিখরে ওঠা খুব সহজ কাজ নয়। এটাকে যদি সহজে পাড়ি দিতে পারতাম তাহলে বলতে পারতাম যে হিমালয় পর্বত জয় করেছি। বাংলাদেশের সমস্যাটি হিমালয় পর্বতের সঙ্গে তুলনীয় এবং আমরা রাতারাতি এসব সমস্যার সমাধান করতে পারব না। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এ দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুমড়ে-মুচড়ে শেষ করে ফেলেছে। দেশের পুলিশ পলাতক। একটা রাষ্ট্রের পুলিশ পালিয়ে যায়, এটা আমরা ভাবতেও পারি না। অথচ সেটাই ঘটেছে আমাদের দেশে। যারা কাজে যোগ দিয়েছে, তাদের নৈতিক মনোবলের অভাব লক্ষণীয়।
দেশের আইনশৃঙ্খলা ঠিক করাকে সবকিছুর আগে প্রাধান্য দিতে হবে। এজন্য দেশের পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজিয়ে নতুন একটি পুলিশ বাহিনী তৈরি করা প্রয়োজন। যদিও সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তবু এটা আমাদের করতে হবে। একই সঙ্গে পুলিশ রেগুলেশনের জন্য বিদ্যমান আইনগুলো কতটা সময়োপযোগী খতিয়ে দেখতে হবে। এসব আইন কতটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপযোগী, বিচার বিশ্লেষণ করে এখানে পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোকে উন্নত করতে হবে। পরিবর্তনগুলো স্থায়ীভাবে আসবে শুধু একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই।
দ্বিতীয়ত, দেশের আমলাতন্ত্র ঠিক করতে হবে। আমলাতন্ত্রে যারা রয়েছেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার সেবক ছিলেন। একই সঙ্গে তারা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করতে হয় তার সবই করেছেন। এমনকি অনেকে রাজনৈতিক ভাষায় কথা বলেছেন, যেটা আদৌ কাম্য নয়। আমলাতন্ত্রকে ঢেলে সাজাতে হবে। এটা না করলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসেও দেশ চালাতে পারবে না।
তৃতীয়ত, আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ব্যাপক ত্রুটি রয়েছে। একদিকে স্বাস্থ্যসেবা রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীভূত, অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতি রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবাকে দুর্নীতিমুক্ত এবং বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। একই সঙ্গে সব মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে। অন্তত প্রত্যেকটা জেলায় ভালো হাসপাতাল এবং উন্নত চিকিৎসার সুযোগ তৈরি করতে হবে। যাতে ওই জেলার মানুষ নিজের জেলাতেই সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারে।
চতুর্থত, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা কেমন হবে, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা কেমন হবে এখন পর্যন্ত আমরা সেটাই নির্ধারণ করতে পারিনি। আমরা পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। আমাদের শিক্ষার মানে প্রচণ্ড অবনতি ঘটেছে। শিক্ষকদের নৈতিকতার এবং তাদের জ্ঞানগাম্ভীর্যের অধঃপতন ঘটেছে। শিক্ষাব্যবস্থার দ্রুত পরিবর্তন না করতে পারলে এ জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
চতুর্থত, আমাদের বিচারব্যবস্থারও সংস্কার প্রয়োজন। আদালতে দলীয়ভাবে বহু বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে। তারা আবার গর্ব করে নিজেদের বলছেন শপথবদ্ধ রাজনীতিক। এই শপথবদ্ধ রাজনীতিকদের বিচারক হিসেবে থাকা উচিত নয়। বিচারপতি কারা হবেন তার মাপকাঠিও নির্ধারণ ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন দরকার। ভালো মাপকাঠি না থাকার কারণেও বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে এ অনাচারগুলো হয়েছে। উচ্চ আদালতের পাশাপাশি নিম্ন আদালতেরও সংস্কার দরকার।
আইনশৃঙ্খলা, আমলাতন্ত্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিচারব্যবস্থা ছাড়াও আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিষেবাগুলোর সংস্কার আশু জরুরি। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। দেশের বিদ্যুৎসেবা উন্নত করতে হবে এবং এই খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। সর্বশেষ বলতে চাই, আমরা যতগুলো সেক্টরের সংস্কার করব, সেখানে লক্ষ রাখতে হবে যেন তা টেকসই হয়। সমাজে ক্ষমতার বিন্যাস প্রচণ্ডভাবে অসম। সমাজে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা ও জবাবদিহির জায়গা তৈরি করতে হবে, তাহলে আমরা গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে পারব।
কালবেলা: বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠছে। আবার ছাত্রদের মধ্য থেকে রাজনৈতিক দল গঠনের কথাও বলা হচ্ছে। এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।
মাহ্বুব উল্লাহ্: ছাত্ররা এই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে— এটা অবশ্যই তাদের জন্য একটি বিরাট কৃতিত্ব। তারা প্রতিদিন যা কিছু করছেন বা যা কিছু বলছেন সবই রাজনৈতিক। আসলে রাজনীতির বাইরে কোনো কিছুই নয়। এখন তারা যদি রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা করে থাকেন আমি তাদেরকে সাধুবাদ জানাবো। অবশ্যই তাদের রাজনৈতিক দল গঠন করার অধিকার রয়েছে। তারা জনগণের কাছে যাবে এবং জনগণ যদি তাদেরকে গ্রহণ করে তাহলে তারা রাষ্ট্র পরিচালনায়ও আসতে পারে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতির বিরাট অবদান রয়েছে। এমনকি এই উপমহাদেশের ইতিহাসেও ছাত্র রাজনীতির বিশেষ অবদান রয়েছে। তাই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার যে কথা বলা হচ্ছে সেটা খুব শুভ বুদ্ধির কাজ বলে আমি মনে করছি না। তাই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ না করে বরং আমাদেরকে দেখতে হবে কিভাবে ছাত্র রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় নিয়ে যাওয়া যায়। অতীতে সুস্থ ছাত্র রাজনীতির চর্চা ছিল। সেই পথেই আবার ছাত্র রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। সেজন্য একেবারে প্রাথমিক কাজ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রয়োগ করা। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ খুবই ত্রুটিপূর্ণ হয়ে গেছে। বেআইনি এ সকল নিয়োগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার জন্য শক্তিশালী কমিটি গঠন করা উচিত।
কালবেলা: বিভিন্ন সময়ে নানা সংস্কারের কথা বলা হলেও দেখা যায় রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এসে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেনি। এবার আমরা কতটা আশ্বান্বিত হতে পারি?
মাহ্বুব উল্লাহ্: এখানে বড় সমস্যা আমাদের রাজনীতিবিদদেরকে নিয়ে। ক্ষমতার বাইরে থাকলে তারা এক ধরনের কথা বলেন আর ক্ষমতায় থাকলে আরেক ধরনের কথা বলেন। ক্ষমতায় গেলে তারা কি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এবং কি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা ভুলে যান। তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন। এজন্যই ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার কথা বলা হচ্ছে। একই সঙ্গে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভর প্রণয়নের কথাও বলা হচ্ছে। এমনকি সংসদের ভেতরেও ব্যালেন্স রাখার জন্য সংসদীয় কমিটিগুলোকে শক্তিশালীকরনের কথা বলা হচ্ছে। এসব কিছু করতে পারলে হয়তো পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।
কালবেলা: রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি এখন আপনার পরামর্শ কি থাকবে?
মাহ্বুব উল্লাহ্: আমাদের দুর্ভাগ্য নতুন পরিস্থিতিতে পুরোনোরা বিদায় নিয়েছে এবং সেই জায়গায় নতুন দখলবাজদের উৎপত্তি হয়েছে। এই দখলবাজদেরকে নিরস্ত্র করতে না পারলে আমাদের সকল চেষ্টা ও ত্যাগ ব্যর্থ হয়ে যাবে। সুতরাং এই নব্য দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে এবং খুব শক্ত হাতে তাদেরকে দমন করতে হবে।
যেই ঐক্যের মাধ্যমে আমরা একটি শক্তিশালী স্বৈরতন্ত্রকে বিদায় করেছি, যাকে বিদায় করতে গিয়ে সহস্রাধিক ছাত্র জনতাকে জীবন দিতে হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে... সেই ঐক্যকে বিনষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। এত ত্যাগ এ তো রক্তকে বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত সংস্কারের বিষয়গুলো ফায়সালা না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থেকে কাজ করার আহবান জানাচ্ছি। মনে রাখতে হবে ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। এই মহা অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্রের বাসাকে ভেঙে দিতে হবে। আর এটা এককভাবে কোনো একটি দলের পক্ষে বা একটি বাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়। প্রয়োজন বিশাল জাতীয় ঐক্যের। আমাদেরকে প্রতি মুহূর্তে সাবধান থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমার একটাই বার্তা সেটা হল, সমাজে নতুন করে অনাচার, স্বেচ্ছাচার, দখলবাজি, দুর্নীতি যাতে না হয় তার জন্য সচেষ্ট থাকবেন একই সঙ্গে পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকবেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে ইতিমধ্যেই পরস্পরের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। তাদেরকে মনে রাখতে হবে ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। তারা যদি মনে করে থাকে সব বিপদ কেটে গেছে তাহলে ভুল করবে। যারা এই কথা কাটাকাটি বা বিবাদে লিপ্ত হচ্ছেন তাদের প্রতি আমার আবেদন, দয়া করে পরাজিত অশুভ শক্তির ষড়যন্ত্রকে ক্ষুদ্র করে দেখবেন না।