ঐতিহাসিকভাবেই দুনিয়াজুড়ে শিল্পী-সাহিত্যিক-দার্শনিক-সাংবাদিক সমাজ মানবতাবাদী হয়ে থাকে। সবসময় নিপীড়িতের পক্ষে অবস্থান নেয় তারা। এ নিয়ে নানা কিংবদন্তি গল্প প্রচলিত আছে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-মানবাধিকার প্রশ্নে সোচ্চার সংস্কৃতিকর্মীরা জীবন দিতেও দ্বিধা করেন না। এই বোধ নিয়ে জন্ম বা দীক্ষা নেওয়ায় অন্যদের মতো হিসেবি-সংসারী পেশাজীবী হন না তারা। বঞ্চিত-দলিত-সর্বহারাদের পক্ষ নিয়ে অনেক শিল্পীকে নিরাপদ ও আয়েশি জীবনও ত্যাগ করতে দেখা গেছে। জালিয়ানওয়ালাবাগ ট্র্যাজেডির প্রতিবাদে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ব্রিটিশের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ছুড়ে ফেলে মুক্তিকামীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানেও সে ধারা বজায় ছিল। যে কারণে সৃষ্টিশীল মানুষগুলোকে সবসময় সম্মান দিয়ে এসেছে দেশবাসী। শিল্পী-সাহিত্যিকদের তারকাখ্যাতি যুক্ত করে গণমানুষের সংগ্রামকে উজ্জীবিত করা হয়েছে। এতে তাদের জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে।
কিন্তু গত দেড় দশকে এ ধারণা শুধু পাল্টে যায়নি। পুরোপুরি উল্টে গেছে। কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকারের তদারকিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মতো শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনও পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। প্রতিবাদী সত্তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। পোষা বিড়ালের মতো মিউ মিউ শেখানো হয়েছে জুজুর ভয় দেখিয়ে। দারুণ জনপ্রিয় ও অমিত সম্ভাবনা থাকার পরও মানুষগুলো এখন শুধুই নির্বীজ ফুটফুটে সুন্দর। তাদের রং করা পুতুল মনে করে রাষ্ট্রীয় বৈষম্যে ক্ষত-বিক্ষত বিক্ষুব্ধরা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিখ্যাত কবি তারাপদ রায়ের ততোধিক বিখ্যাত কবিতা ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে’ আবৃত্তি করছেন অনেকে। কবি লিখেছেন—“আমরা যে গাছটিকে কৃষ্ণচূড়া গাছ ভেবেছিলাম/ ওর উদ্দেশ্যে ধ্রুপদী বিন্যাসে কয়েক অনুচ্ছেদ/ প্রশস্তি লিখেছিলাম / গতকাল বলাইবাবু বললেন, ‘ঐটি বানরলাঠি গাছ।’... আমরা বুঝতে পারিনি/ আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
হ্যাঁ, সাধারণ মানুষের এখন এমন অনুভূতি হচ্ছে। বন্যার পানি নেমে গেলে ধ্বংসের রূপ বের হয়। উত্তাল জুলাই-আগস্টের পর বিভিন্ন সেক্টরের ক্ষতগুলো উৎকটভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভ্যুত্থানের সময় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেক রথী-মহারথী নির্লিপ্ত ছিলেন। ফ্যাসিস্টের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নেওয়া অনেকের কদর্য রূপ বেরিয়ে আসছে। বিশেষ করে, ‘আলো আসবেই’ নামের অনলাইন গ্রুপে অংশ নেওয়া তারকাদের অন্ধকার দিক ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে।
ওই গ্রুপের অন্যতম সদস্য, সুদর্শন, সুঅভিনেতা, নায়ক ফেরদৌস। সম্প্রতি বিলুপ্ত হওয়া সংসদের সদস্য ছিলেন তিনি। অনেক আগেই সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে ভারত জয়ের(!) সম্মান অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে অভিনয় প্রতিভা কাজে লাগিয়ে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হন। চলচ্চিত্র ছেড়ে আওয়ামী লীগ সরকারের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকেন। ত্যাগী নেতাদের টপকে রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ ফেরদৌস খোদ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ আসনের এমপি হন। তার এ দ্রুত সাফল্যের পেছনে ভারত সংযোগ অন্যতম ফ্যাক্টর বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এতদিন ধরে তিনি ভারতের হয়েই আওয়ামী লীগ করেছেন বলে নিজ দলেই সমালোচনা ছিল। নন্দিত এ নায়ক হাসিনা রেজিমের অংশ হিসেবে জনতার কাছে এখন নিন্দিত খলনায়ক। আরেক পতিত নায়িকা তো অরুণোদয়ের সময় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গরম জল ঢেলে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন না, বিপ্লবীরা রাজপথে গরম রক্ত ঢেলে ভাসিয়ে দিয়েছে জগদ্দল পাথর। করুণা হয় ওই যাত্রাবালার জন্য। অথচ, তার বাবা ছিলেন গণমানুষের প্রিয় যাত্রাসম্রাট। এসব অবশ্য নতুন কিছু নয়। রাজা-বাদশাহদের বিনোদনের জন্য প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বিখ্যাত নট-নটী জোগাড় করা হতো। সেবা দিতে দিতে তাদের অনেকে ক্ষমতার অংশও উপভোগ করেছে কালে কালে। তবে প্রকৃত সংস্কৃতিসেবীরা কখনো স্বৈরাচারের দোসর হন না। নানা প্রলোভন বা হুমকিতে টলেন না। প্রয়াত স্বৈরাচার এরশাদ দেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের নানা উপঢৌকন দিয়েও শেষরক্ষা পাননি। দেশের শিল্পাঙ্গনের পুরোধা ব্যক্তিরা ছিলেন তার বিরুদ্ধে একাট্টা। অথচ ২০২৪-এর অভ্যুত্থানে তাদের অবস্থান হলো তার উল্টো।
প্রলেতারিয়েতের কবি হিসেবে পরিচিতরা হাসিনা রেজিমে রাজকবির সুবিধা ভোগ করেছেন। ‘হুলিয়া’র কবিও শিশু-কিশোরদের প্রাণঘাতী বিপ্লব কীভাবে ‘ভুলিয়া’ থাকেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনাগত ভবিষ্যতে হয়তো লেখক-গবেষকদের রচনায় উঠে আসবে এ কর্তৃত্ববাদী শাসনের ইতিবৃত্ত। এ শ্যামল বাংলায় কীভাবে বিস্তৃত হলো ফ্যাসিস্ট সরকার! স্বৈরাচার শাসকরা যেনতেনভাবে শুধু ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। ক্ষমতার মাধ্যমে দুর্নীতির বিস্তার করে। অনুসারীদের টাকা এবং পেশিশক্তিতে অপরাজেয় দানব করে তোলে। আর ফ্যাসিস্টরা শুধু ক্ষমতা পাকাপোক্ত ও দুর্নীতিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। তারা দেশের সংস্কৃতিই পাল্টে দেয়। প্রতিবাদের ভাষা মুছে ফেলে। নিজেদের দলীয় আদর্শকে সর্বজনীন করতে চায়। এজন্য মানসিক ও শারীরিক দমন-পীড়নে বিনিয়োগ করে। নিজেদের রাজনৈতিক দল এবং নেতাকে অলঙ্ঘনীয় ধর্মের মতো মান্য করে। জনগণকেও নানা অসিলায় তা মানতে বাধ্য করে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, জবরদখলকারী রাষ্ট্রের চরিত্র আলাদা আলাদা। ইংল্যান্ড তার কলোনি দেশগুলোর অর্থনীতি ধ্বংস করে দিত। আর ফ্রান্স করত সংস্কৃতি ধ্বংস। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট সরকার চেয়েছে, প্রতিপক্ষকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মুছে ফেলতে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কলঙ্কিত করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এজন্য ব্যবহার করা হয়েছে সরকার ও তার এজেন্সি নির্ধারিত কিছু সৃষ্টিশীল এবং লোভী সাংবাদিক-লেখক-শিল্পীদের। এসব প্রকল্প থেকে দূরে থেকেছেন পরিচিত অনেক আওয়ামীপন্থি মেধাবী, বিবেকবান, প্রতিবাদী, জনপ্রিয় মানুষ। জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে শেখ হাসিনার মতোই দীর্ঘদিন কুরসিতে সেঁটে ছিলেন সংশপ্তক নাটকের চরিত্র কালু। এজন্য আওয়ামী লীগ ও স্বৈরশাসকের অনুগত বাম লেখক-শিল্পীদের কারও কারও ছিল না পাওয়ার বেদনা। তারা বলতেন, এরকম একটি পদে শিল্পজগতের ‘মিয়ার বেটা মিয়া’ বসার কথা। নিদেনপক্ষে ‘কানকাটা রমজান’ হলেও চলত। তাই বলে কালু! লিয়াকত আলীকে সত্যিকারের লাকি মনে করতেন অন্যরা। তারা এটাও বলতেন, শেখ হাসিনা তার সরকার সাজিয়েছেন বামন দিয়ে। তার চেয়ে যোগ্য, মেধাবী কাউকে পাত্তা দেননি। আভূমি অনুগতদেরই প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি। একচ্ছত্র ক্ষমতায় শুধু প্রশংসা চেয়েছেন। কোনো প্রশ্নকর্তা চাননি। ফলে বিপর্যয়ের সময় সাহসী কোনো পরামর্শক পাননি।
যে কারণে প্রধানমন্ত্রী পালানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রধান বিচারপতি, জাতীয় মসজিদের খতিব থেকে পিয়ন-চাপরাশিও নিরুদ্দেশ হয়েছে। এমনটি কখনো আগে হয়নি। এরকম শূন্যতা জনগণ আগে দেখেনি।
প্রায় ১৬ বছরের আওয়ামী শাসনামলে অনেক মেধাবী তরুণ, বিজ্ঞ বৃদ্ধ; সম্মান ও জীবন বাঁচাতে বিদেশে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে গেছেন। যারা যেতে পারেননি, তারা চুপ মেরে গেছেন। তাদের সৃষ্টিশীল কর্ম থেমে গেছে। জ্ঞানপাপীর অপবাদ নিয়ে শুধুই জীবনযাপন করেছেন তারা। আর স্তাবকের দল হৃদয় ও মগজ বন্ধক রেখে টাকা কামিয়েছেন। দেশের অর্থনীতিকে ঝাঁজরা করে নাম দিয়েছেন ‘হাসিনোমিক্স’। ভোগ-বিলাসে মত্ত থেকে মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এই সময়টাতে বেহায়া, অযোগ্য, লোভী মানুষের বাম্পার ফলন হয়েছে। তারা এখন পান থেকে চুন খসলেই বিপ্লবী সরকার নিয়ে উপহাস করেন। সহস্র জনতাকে নিষ্ঠুরভাবে খুনের ঘটনা তাদের হৃদয়কে আলোড়িত করে না। অথচ আধুনিক দুনিয়ায় এক আবু সাঈদের হত্যাদৃশ্যই সরকার পতনের দাবি রাখে। বিনা ভোটের নির্বাচন, লক্ষ কোটি টাকা পাচার, জমিদারতন্ত্রে রূপান্তরিত আমলাতন্ত্র, রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে দলীয় কার্যালয় বানানোর মতো ঘটনাকে তারা স্বাভাবিক অভ্যাস বলে মেনে নিয়েছিল। এখন নানা ছুঁতোয় পোকায় খাওয়া সংবিধানের সংকট বড় করে তুলে ধরছে। আসলে আশ্চর্য শূন্যতা বিরাজ করছে পরাজিতদের মগজে। সাংবিধানিক শূন্যতার চেয়েও যা প্রকট। প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারী হয়েও তারা কওমি জননীকে দিনের পর দিন বিকল্পহীন বলে প্রচার করতেন। বছরের পর বছর পুলিশি নিয়ন্ত্রণে চলেছে নামকাওয়াস্তে সাংস্কৃতিক আয়োজন। নেই কোনো প্রতিবাদী প্রযোজনা। অস্তিত্ব সংকটে ধুঁকছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। অন্যদিকে, রাজনৈতিক প্রয়োজনে ইসলামপন্থি রাজনীতিকদের রমরমা ইছালে ছওয়াব মাহফিলের প্রসারে ভূমিকা রেখেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। লুটপাটে ব্যস্ত থেকেও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় বেশ খরচ করেছেন তারা।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নামে আওয়ামী পদলেহী সংগঠনটি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের আখেরি আনুষ্ঠানিকতার প্রতিনিধিত্ব করেছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে বানিয়েছে নিজস্ব শোরুম। কোটি কোটি টাকা খরচে শতভাগ বিদ্যুতায়নের মিথ্যা উদযাপনে লোকদেখানো কনসার্ট আয়োজন করেছে আশীর্বাদপুষ্ট পাঁঠারা। বন্ধ হয়ে গেছে নিয়মিত সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা। বরাদ্দের অভাবে তালা ঝুলছে পাঠাগারে। অথচ এক ব্যক্তি, এক পরিবার নিয়ে মতলবি লেখা হাজার হাজার বই কিনেছে সরকার। সে বইয়ের বেশিরভাগেরই প্যাকেট খুলে দেখেনি সাধারণ পাঠক। এর সবকিছুই বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে।
সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার ভক্তরা তথাকথিত সংবাদ মাহফিলে দিনের পর দিন প্রশংসা করেছেন শেখ হাসিনার। এ বৈপরীত্য, শুধু নষ্ট প্রতিভার পক্ষেই সম্ভব। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-গণমাধ্যমের এসব পচে গলে যাওয়া ব্যক্তিদের চিকিৎসা প্রয়োজন। সুস্থ না হলে প্রয়োজনে তাদের বাদ দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। শূন্য থেকে শুরু করবে তারুণ্য। সুস্থ, সুন্দর, দ্রোহের জন্য সুকুমার বৃত্তির চর্চা জরুরি। এসব ছাড়া মানবতা বিকশিত হয় না। সময়ের চাহিদা পূরণে শুরু হোক পূর্ণ সাধনা।
লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা