রাষ্ট্র মেরামত করতে সময়ের প্রয়োজন। আর সেই সময়টা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দিতে হবে। দীর্ঘদিনের জঞ্জাল পরিষ্কার করার জন্য সময় লাগবে। সেই সময়টুকু দিতে হবে। গত ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, কখন নির্বাচন হবে, সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সরকারের নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে তারা কখন এই সরকারকে বিদায় দেবেন। দেশের সংকটকালে ছাত্রদের আহ্বানে তারা এই দায়িত্ব নিয়েছেন। সরকার সব শক্তি দিয়ে এই দায়িত্ব পালন করবে।’
এদিকে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের অতি দ্রুত সংলাপ চেয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, কয়েকজন ব্যক্তির সংস্কারে তাদের বিশ্বাস নেই। নির্বাচন অবশ্যই ‘সীমিত’ সময়ের মধ্যে করতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, রাষ্ট্র মেরামত করবে নির্বাচিত সরকার। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সংলাপ চান। তিনি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণারও দাবি করেছেন।
বলতে গেলে এখন বিএনপির পথ পরিষ্কার। এখন তো আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নেই। কাজেই তাদের জন্য খালি মাঠে গোল দেওয়া একেবারেই সহজ হয়ে গেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেও সময় দিতে রাজি নন। তবে জামায়াত বলেছে, তারা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সময় দিতে রাজি।
ছাত্র আন্দোলনের ফসল এই অন্তর্বর্তী সরকার। ড. ইউনূসকে তারা পছন্দ করে এনেছেন। দেশে আসার পর ড. ইউনূস ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনারা যদি আমাকে চান, তবে আমার কথা শুনতে হবে। তা না হলে আমাকে বিদায় দেন, আমি আমার কাজে ফেরত যাই।’
ড. ইউনূস মূলত কোনো রাজনীতিবিদ নন। তার রাজনীতি করার ইচ্ছা আছে বলেও মনে হয় না। তিনি বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদ যেভাবে সাজিয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই দলনিরপেক্ষ ব্যক্তি। তারাও যে রাজনীতিতে জড়াবেন, এমন কোনো আশঙ্কা নেই। এ ছাড়া বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার চায় আন্তর্জাতিক মহল। ইতোমধ্যে জাতিসংঘসহ অনেক দেশই আশা প্রকাশ করে বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকার একটি নির্বাচন দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে নিয়ে আসে। কাজেই একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই বর্তমান সরকার নির্বাচন দেবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই বা থাকার কথাও নয়।
এদিকে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে কথা উঠেছে। বিএনপি বলছে, জনগণের সরকার বা নির্বাচিত সরকারই রাষ্ট্র সংস্কার করবে। রাষ্ট্র সংস্কার আমি বা আমরা দেখে আসছি স্বাধীনতার পর থেকেই। কখনো একদলীয় শাসন, কখনো সেনা শাসন, দেখেছি গণতান্ত্রিক শাসন, আর গত সাড়ে ১৫ বছর দেখলাম এক ব্যক্তির শাসন। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল এই জাতির ভাগ্যে খুব একটা জোটেনি। বরং জাতি হিসেবে আমরা হয়েছি অবহেলিত, লাঞ্ছিত আর বঞ্চিত। গণতন্ত্রের দাবিতে দেশ স্বাধীন হলেও গণতন্ত্রের স্বাদ এই জাতি ভোগ করতে পারেনি।
গণতন্ত্রের নামে এদেশে স্বৈরতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র আর একনায়কতন্ত্রই দেখেছি। এদেশের মানুষ চায় দুবেলা দুমুঠো খেয়ে শান্তিতে ঘুমাতে। আর সেটা স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও হয়ে ওঠেনি। ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট এদেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করে রাজনীতিবিদরা বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। বিদেশের ব্যাংকে টাকার পাহাড় গড়েছেন।
সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলনে দেখা গেছে, রিকশাচালক, দিনমজুর বা খেটে খাওয়া মানুষ সমর্থন দিয়েছেন। ঢাকার রিকশাচালকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়েছেন এবং উৎসাহ দিয়েছেন। শুধু কি তাই? পুলিশের গুলিতে রিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে। আমরা দেখেছি ৫ আগস্টের পর তাদের আনন্দ-উল্লাস। সমাজের সব শ্রেণির মানুষ ছাত্রদের আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়েছেন, যে যা পারেন তাই নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
দেশে ভয়াবহ বন্যার প্রভাব কাটেনি। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আসা পানিতে এখন দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চলছে ভয়াবহ বন্যা। ৯ জেলায় প্রায় ৪ কোটি মানুষ বন্যায় আক্রান্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে কীভাবে নারী ও শিশুদের মৃতদেহ পানিতে ভাসছে। এ এক মানবিক বিপর্যয়। ছাত্রসমাজ বন্যার্তদের সাহায্যে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে। ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে যে যা পারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বা দিচ্ছে। দেশে এই মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে সব রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে—এটাই আশা করছি। আর রাজনৈতিক দলগুলো এটাই করবে বলে আমাদের আশা। কিন্তু তা না করে আগে ক্ষমতার চিন্তায় মগ্ন। কবে, কীভাবে নির্বাচন দিতে হবে, কবে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা হবে বা করতে হবে, তাই নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যস্ত।
ছাত্র বা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফসল কি রাজনৈতিক দলগুলো এত তাড়াতাড়ি ভোগ করতে চায়? শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছে। ড. ইউনূস একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। তাকে শিক্ষার্থীরাই সাময়িকভাবে রাষ্ট্র মেরামত করার দায়িত্ব দিয়েছে। সেইসঙ্গে শস্ত্রস বাহিনীও কাজ করছে। ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারীদের ধরা হচ্ছে। রাজনীতির নামে যারা অপরাজনীতি করেছেন, তাদেরও ছাড়া হচ্ছে না। ধরা হচ্ছে রাজনৈতিক দালালদের। চালানো হচ্ছে পরিচ্ছন্ন অভিযান। ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী, ব্যাংক লুটকারী, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, অবৈধ অর্থ আত্মসাৎকারীসহ সবাইকে ধরা হচ্ছে। তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে—চোরের ১০ দিন, আর গৃহস্থের এক দিন। এসব কাজ কি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থেকে করতে পারবে বা সম্ভব?
আমাদের দেশে এখন যেসব রাজনৈতিক দল আছে, সেগুলো তো পরীক্ষিত। তবে যাই হোক, দেশ তো রাজনীতিবিদরাই চালাবেন। এত তাড়াহুড়া কেন? সাড়ে ১৫ বছর সইতে পারছেন, আর না হয় কিছু দিন অপেক্ষা করুণ। কেন এত অস্থিরতা? অপেক্ষা করুন, দেখুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র মেরামত করতে পারে কি না।
বিএনপি বলছে, তারা রাষ্ট্র মেরামত করবে, তারা কি এত সহজেই রাষ্ট্র মেরামত করতে পারবে? দেশে এখন বৈদেশিক ঋণ প্রায় ১১ বিলিনয় ডলার। অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রায় সাড়ে ৮ লাখ কোটি টাকা। দেশ থেকে গত সাড়ে ১৫ বছরে পাচার হয়েছে প্রায় ১০৯ বিলিয়ন ডলার। দেশের অর্থনীতি এখন পঙ্গু। ব্যাংকে টাকা নেই। এমতাবস্থায় বিএনপি কি রাতারাতি দেশের অর্থনীতি ঠিক করতে পারবে? নির্বাচিত বা গণতান্ত্রিক সরকার সবাই চায়। তবে তার আগে দেশের মানুষ ‘ভাত’ চায়। ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা আছে। বর্তমান সরকারের অর্থ উপদেষ্টাও একজন অর্থনীতিবিদ। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। আর রাষ্ট্র মেরামতের কাজ আপাত দৃষ্টিতে ভালোই করছে বলা যায়। কাজেই রাষ্ট্র মেরামতের কাজটা তারাই কিছু দিন করুক না।
লেখক: সাবেক কর কমিশনার, আইনজীবী ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন