স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম গুমের ঘটনা ঘটে মুজিব সরকারের আমলে। শুধু গুমই নয়, ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডও মুজিব সরকারের আমলেই শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে ২ জানুয়ারি রাতে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির প্রধান নেতা সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদার তৎকালীন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন।
‘আয়নাঘর’—ফ্যাসিবাদী দানব শেখ হাসিনার একটি নির্মমতার প্রতীক। প্রথমদিকে অনেকেই বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারেননি। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে অনেকেই বিচলিত ছিলেন। তবে এ দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটেছে। ছাত্র-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ‘আয়নাঘর’ থেকে বেশ কয়েকজন ফিরে এসেছেন। হতভাগ্য এসব মানুষ আয়নাঘরের নির্মমতার ধরন গণমাধ্যমের কাছে বর্ণনা করেছেন। তাদের বর্ণনা শুনে অনুভূতিপ্রবণ মানুষমাত্রই শিউরে উঠেছেন। অনেকেই অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছে অশ্রু। শুধু ক্ষমতার মোহে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের ওপর এমন পৈশাচিক নির্যাতন চালাতে পারে, এটা অনেকের কাছেই কল্পনাতীত ছিল। একুশ শতকের নৃশংস স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন না ঘটলে বিষয়টি আরও কিছুদিন আমাদের মনোজগতে কল্পনা ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের বিষয় হয়েই থাকত। স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন হতো। অবশেষে আমরা জানলাম, ‘আয়নাঘর’ সৃষ্টির মাধ্যমে নিরপরাধ মানুষের ওপর যে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা ফ্যাসিবাদী দানব হিটলারের ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের’ নির্যাতনকেও হার মানিয়েছে। একজন ফ্যাসিস্ট যে কতটা বর্বর ও পৈশাচিক হতে পারে, অনুভূতিহীন দানব হতে পারে, আয়নাঘর থেকে কয়েকজন ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ ফিরে না এলে, তা আমাদের বোধের বাইরেই থেকে যেত।
রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হত্যা এবং রাষ্ট্র কর্তৃক নির্যাতিত এসব হতভাগ্য মানুষের প্রতি সহানুভূতি জানানোর জন্য যে সংহত, পরিচ্ছন্ন ভাষা ও বর্ণনারীতি প্রয়োজন, তা যেমন আমার নেই; তেমনি নেই নির্যাতনকারীদের প্রতি ধিক্কার জানানোর ভাষাও। আবার একজন ক্ষুদ্র গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে সময়ের দায়কে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতাও নেই।
যে কোনো ধরনের মৃত্যু মানেই গভীর দুঃখবোধ, বুকের মধ্যে সৃষ্টি করে একটি স্থায়ী শূন্যতা। তবে মৃত্যু যেহেতু মানুষের জীবনের একটি অনিবার্য নিয়তি, তাই স্বজন হারানোর বেদনা মানুষ একসময় মেনে নেয়। কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া মানুষটির পরিবারের সদস্যদের কষ্ট মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি দুর্বিষহ। এই যেমন ধরুন, গুম হওয়া কেউ যদি হত্যাকাণ্ডের শিকার হতেন, তার মৃতদেহ যদি পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হতো, তাহলে পরিবারের সদস্যরা তার মৃতদেহ দাফন করতে পারতেন, কবরের পাশে দাঁড়িয়ে একটু দোয়া করতে পারতেন, এতে তারা নিজেকে একটু সান্ত্বনা দিতে পারতেন। ধীরে ধীরে মৃত্যুর শোক পরিবারের সদস্যদের কাছে সহনীয় হয়ে আসত। কিন্তু একজন জীবন্ত মানুষ যদি হারিয়ে যায়, তার যদি কোনো হদিস না পাওয়া যায়, তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন, বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, এসবের কিছুই যদি না জানা যায়, তখন মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কিছুই থাকে না। বুকের গহিনের দুঃখবোধ ক্রমান্বয়ে গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। আর দুঃখ যেখানে গভীর, সান্ত্বনা সেখানে ডুবে যায়, এক দুঃসহ যন্ত্রণা সর্বদা তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। উদ্বেগ এবং অজানা বিপদের আশঙ্কায় তাদের মনে নানা আতঙ্ক ভর করে। ক্রমান্বয়ে তাদের জীবন পরিণত হয় এক নিরবচ্ছিন্ন উদ্বেগের ঘনীভূত ইতিহাসে।
হাসিনা সরকারের শাসনামলে অন্তত সাতশজন গুম হয়েছেন। এ সংখ্যা তালিকাভুক্ত। প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আরও অনেক বেশি। বিগত শতাব্দীর সত্তর এবং আশির দশকে সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট দক্ষিণ আমেরিকার সামরিক জান্তারা গুম এবং অপহরণের সঙ্গে যুক্ত ছিল। একুশ শতকে শেখ হাসিনার সরকার তার ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা জারি রাখতে আয়নাঘর, গুম এবং অপহরণের মতো মানবতাবিরোধী এ ধারা ফিরিয়ে আনে। একের পর এক গুমের শিকার হয় সাধারণ মানুষ। গুম হওয়া এসব মানুষের নিয়তি জানতে স্বজনরা গড়ে তোলেন ‘মায়ের ডাক’ নামের প্ল্যাটফর্ম। এ ‘মায়ের ডাক’ আর্জেন্টিনার ‘মাদারস অব দ্য মায়ো’র আদলে গঠিত, যা সত্তরের দশকের শেষদিকে আর্জেন্টিনার মায়েরা তাদের গুম হওয়া সন্তানদের নিয়তি জানতে এ ধারার সৃষ্টি করেছিলেন।
বিগত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকে আর্জেন্টিনা, চিলি, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, ব্রাজিল ও বলিভিয়ায় কায়েম থাকা একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অধীনে প্রতিপক্ষের লোকজনকে খুঁজে বের করে হত্যার বিশেষ অভিযান চালানো হয়। এ অভিযান ‘অপারেশন কন্ডোর’ নামে পরিচিত। ‘অপারেশন কন্ডোর’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বামপন্থি ভিন্নমতাবলম্বীদের অপহরণের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। এটি শুধু আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ছিল না, বরং দক্ষিণ আমেরিকার অন্য একনায়কদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে এ কাজ করেছিল। প্রতিপক্ষ দমনের এ নৃশংস কর্মকাণ্ড তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালু ছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম গুমের ঘটনা ঘটে মুজিব সরকারের আমলে। জাসদ ও অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাকর্মী এবং সরকারবিরোধী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে তৎকালীন রক্ষীবাহিনী তুলে নিয়ে যেত। তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যেত না। নির্মম নির্যাতনের পর তাদের হত্যা করা হতো। শুধু গুমই নয়, ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডও মুজিব সরকারের আমলেই শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে ২ জানুয়ারি রাতে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির প্রধান নেতা সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদার তৎকালীন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। আর এ হত্যাকাণ্ড বিষয়ে তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান দম্ভের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ সেই সিরাজ সিকদার’। মুজিব সরকারের আমলে ক্রসফায়ারে সিরাজ সিকদারকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা এবং তাকে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ওই উক্তি দেশের রাজনীতিতে নানা সমালোচনা ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক ও সাংবাদিকরা তাদের লেখায় সিরাজ সিকদার হত্যাকাণ্ডকে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে অভিহিত করেন। প্রয়াত বুদ্ধিজীবী ড. আহমদ শরীফ ‘বিপ্লবী বীর সিরাজ সিকদার প্রসঙ্গে’ শিরোনামে এক লেখায় বলেন, ‘সিরাজ সিকদার আজ আর কোনো ব্যক্তির নাম নয়। সিরাজ সিকদার একটি সংকল্পের, একটি সংগ্রামের, একটি আদর্শের, একটি লক্ষ্যের ও একটি ইতিহাসের অধ্যায়ের নাম। এ মানবতাবাদী সাম্যবাদী নেতাকে হাতে পেয়ে যেদিন প্রচণ্ড প্রতাপ শঙ্কিত সরকার বিনা বিচারে খুন করল, সেদিন ভীতসন্ত্রস্ত আমরা তার জন্য প্রকাশ্যে আহা শব্দটি উচ্চারণ করতেও সাহস পাইনি। সে গ্লানিবোধ এখনো কাঁটার মতো বুকে বিধে।’
বাস্তবিক ওই সময়ের বাংলাদেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রতিবাদ করারও কোনো উপায় ছিল না। তবে সত্তরের দশকেই আর্জেন্টিনায় গুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়। ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল আর্জেন্টিনার একদল মা তাদের গুম হওয়া সন্তানদের ফিরে পাওয়ার দাবিতে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভবনের নিকটবর্তী ঐতিহাসিক ‘প্লাজা দে মায়ো’ চত্বরে সমবেত হন। তাদের হাতে ছিল গুম হওয়া সন্তানদের ছবি আর মাথায় বাঁধা ছিল সাদা স্কার্ফ, এতে লেখা ছিল গুম হওয়া সন্তানদের নাম। দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে তারা তাদের এ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন। মুষলধারে বৃষ্টি কিংবা কাঠফাটা রোদ কোনো কিছুই তাদের এ কর্মসূচি থেকে বিরত রাখতে পারেনি। সেই ’৭৭ সাল থেকে অদ্যাবধি তারা অন্তত ২ হাজার ৪০০ বার তাদের গুম হওয়া স্বজনদের পরিণতি জানার দাবিতে সমবেত হয়েছেন। সামরিক স্বৈরাচারী জেনারেল হোর্হে রাফায়েল ভিদেলা তার শাসনামলে (১৯৭৬-৮৩) দুই বা ততোধিক লোককে একত্রিত হয়ে সভা-সমাবেশ করা নিষিদ্ধ করেছিলেন। এ কারণে সন্তানহারা মায়েরা তখন ‘প্লাজা দে মায়ো’র চারপাশে একা একা ঘুরে বেড়াতেন। তাদের এ কর্মসূচি দ্রুত গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যারা সহিংসতার নীরব থাকতে অস্বীকার করেছিলেন, যারা তাদের সন্তানদের ভাগ্য সম্পর্কে সত্য জানার অধিকারের জন্য লড়াই করছিলেন, এ সমাবেশের মাধ্যমে ধীরে ধীরে একটি শক্তিশালী মঞ্চ তৈরি হয়। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এই মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতাদের তিনজনকে আটক ও গুম করা হয়। তারা হলেন আজুসেনা ভিলা ফ্লোর, এথার ব্যালেস্ট্রিনো ও মারিয়া পন্স ডি বিয়ানকো। এ সত্ত্বেও তাদের সংগ্রাম অব্যাহত ছিল। প্রতি বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় সমবেত হওয়াটা তাদের একটি রুটিনে পরিণত হয়। মহামারি ছাড়া তারা কখনো তাদের কর্মসূচি থেকে বিরত থাকেননি। তাদের মধ্যে কয়েকজন যেমন হেবে ডি বোনাফিনি, নোরা কারটিনাস ও ট্যাটি আলমেদা এ আন্দোলনের জন্য আশার প্রতীক হয়ে ওঠেন। ২০২২ সালে হেবে ডি বোনাফিনি মারা গেছেন। সত্তরের দশকে সামরিক শাসকরা আর্জেন্টিনার রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে বাক্যচিন্তা স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে যে ভয়েস সংস্কৃতি তৈরি করেছিলেন তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল দ্য হেরল্ড। এ পত্রিকাটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হত্যা ও গুমের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। পত্রিকাটির অফিসে নিউজরুমে গিয়ে মায়েরা তাদের সন্তান এবং দাদিরা তাদের নাতি হারানোর কাহিনি বর্ণনা করতেন। সাংবাদিকরা যেসব কাহিনি ভুলে গিয়েছিলেন সেসব লিখতে সহযোগিতা করতেন তারা। এ ধরনের সংবাদ প্রকাশের জন্য সামরিক বাহিনী লা পেন্সা সংবাদপত্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রবার্ট কক্সকে আর্জেন্টিনা থেকে নির্বাসিত করেছিল। সাংবাদিক হিসেবে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর কারণে কক্স পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়েছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সৃষ্ট আয়নাঘরের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের কোনো গণমাধ্যম সোচ্চার হতে পারেনি...
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক