মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১
ইলিয়াস হোসেন
প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৫২ এএম
আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:০৬ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যে কথা কেউ শোনে না

অদ্ভুত আঁধার কাটে না কখনো

অদ্ভুত আঁধার কাটে না কখনো

যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। এটা হয়তো হতাশাবাদীদের প্রবাদ। আর আশাবাদী মানুষরা বলেন, আঁধার পেরিয়ে আলো আসবেই। আবার একই লোক ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে দুই রকম কথাও বলেন। সে লোক যদি ব্যক্তিত্ব হয়, তবে তো কথাই নেই। মুশকিলটা তখনই হয়। কেননা, সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তির কথা সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে।

গত দেড় দশকের আওয়ামী শাসনামল ছিল মারাত্মক পরাক্রমশীল। যে কারণে স্বৈরাচার বলতেও ভয় পেত ভুক্তভোগীরা। চার বছর আগেও অনৈতিক সরকার, একতরফা নির্বাচনের সরকার, রাতের ভোটের সরকার ইত্যাদি বলত বিরোধীরা। সব শর্ত মেনেও সময়মতো সমাবেশের অনুমতি পেত না তারা। আদালত-পুলিশ-প্রশাসনের দপ্তরে দপ্তরে নিষ্ফল ধরনা দিত। প্রাণের ভয়ে যৌক্তিক বিক্ষোভকেও অবদমন করত। গুম-খুন-হামলা-মামলার শিকার হলেও মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলের শিকার হতো বিএনপিসহ রাজপথের বিরোধী দলগুলো। পুলিশ-আমলারা বিরোধী নেতাদের অসহায়ত্ব নিয়ে মজা করত। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ভাষায় কথা বলত। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো পারে না; মাজাভাঙা, ছন্নছাড়া, ঈদের পর আন্দোলন—এরকম হাজারো কমজোরি বিশেষণ জুটেছে তাদের ক্যারিয়ারে। গণমাধ্যমও স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট শব্দগুলো এড়িয়ে চলত। বড়জোর ‘কর্তৃত্ববাদী শাসন’ বলে এক ধরনের সমীহ প্রকাশ করত। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলো ‘আনহোলি অ্যালায়েন্সে’র মাধ্যমে হাসিনা সরকারকে অপরাজেয় করে তুলেছিল। নাগরিক সেবা বাদ দিয়ে দলীয় সরকার তোষণ হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রীয় পবিত্র (!) দায়িত্ব।

এখন তারাই আবার বলছেন ভিন্ন কথা। সবকিছুর জন্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করছেন নানা কিছিমের সুবিধাভোগীরা। রিমান্ড ও আত্মগোপনে থেকে নতুন আত্মোপলব্ধি জেগেছে তাদের। চাকরি থাকবে না বলে শেখ হাসিনার মতের বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। এখন জীবন ও সম্পদ হারানোর ভয়ে জনগণের সঙ্গেই ছিলেন বলে দাবি করছেন সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে বড় চমক নিয়ে হাজির হয়েছে বরাবরের মতোই জাতীয় পার্টি (জাপা)। গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিশ্বস্ত প্রধান সহযোগী হিসেবে নানা সার্কাস দেখিয়েছে বহুল আলোচিত-সমালোচিত জাপা। এখন গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদেরের নেতৃত্বাধীন সংসদের সাবেক গৃহপালিত বিরোধী দল নতুন করে মাঠে নেমেছে। যদিও তাদের কর্মকাণ্ড বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলনেই সীমাবদ্ধ। নিজের অবস্থান ভুলে বিভিন্ন দূতাবাসে দেনদরবার করে বেড়াচ্ছেন। স্বৈরাচারের দোসর শব্দটায় প্রবল আপত্তি প্রয়াত স্বৈরাচার এরশাদ প্রতিষ্ঠিত দলটির। তারা দাবি করছে, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান সমালোচক ছিল জাপা। কারচুপির নির্বাচন, দুর্নীতি, অনিয়ম, সুশাসনের অভাব নিয়ে সংসদে এবং বাইরে সোচ্চার ছিল। এমনকি, এসব ব্যাপারে বিএনপির চেয়েও প্রতিবাদী ছিলেন বলে দাবি করেছেন জি এম কাদের। কিন্তু সাধারণ মানুষের স্মৃতি তো গোল্ডফিশের মতো প্রতারণা করছে না। তারা গত ১৫ বছর দেখেছে, জাপার আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে শেখ হাসিনার ভূমিকা। দলটিকে যাত্রা পার্টি বানিয়ে তারিয়ে তারিয়ে মজা নিয়েছেন তিনি। ওই পার্টির নেতা নির্বাচন থেকে শুরু করে তাদের দাম্পত্য কলহ পর্যন্ত মেটানোর নাটক করেছেন শেখ হাসিনা। পলায়নের আগমুহূর্ত পর্যন্ত দেবর-ভাবির বিরোধ জিইয়ে রেখে ফায়দা নিয়েছেন তিনি। পুতুলের মতো নেচেছেন জাপার নেতারা আওয়ামী লীগ সভাপতির ইশারায়। জেলের ভয় দেখিয়ে জেনারেল এরশাদকে জলের মতো ব্যবহার করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। কখনো আবার বানিয়েছেন বিশেষ দূত। সাবেক নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক এরশাদ শিকলে বাঁধা প্রাণীর মতো সুবোধ হয়ে সঙ্গ দিয়েছেন ততোধিক নির্মম হাসিনা সরকারকে। দীর্ঘদিনের বিতর্কিত সংসারে জমে থাকা অতৃপ্তির কথা এখন ফাঁস করছেন জি এম কাদের। তিনি বলছেন, গলায় ফাঁস লাগিয়ে তার দলকে নির্বাচনে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক কিছু বিষয়ে বেফাঁস তথ্যও দিয়েছেন তিনি। হাসিনা সরকারের প্রতি ভারতসহ বিদেশিদের সমর্থন এবং তার দলকে সঙ্গে থাকার নির্দেশনার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশেষ পরিস্থিতির আশায় জনাব কাদের এসব কথা বলছেন। কারণ, জনগণ জানে উনারা কাদের? ক্ষমতার সঙ্গে থাকতে কখনো সরকারের অংশ, কখনোবা নিয়ন্ত্রিত বিরোধী দলের ভূমিকায় অভিনয় করেছে তারা। নিজের স্ত্রীকে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য করতে দলের অন্যদের মতামত গুরুত্ব দেননি জি এম কাদের। ভবিষ্যতেও ক্ষমতার রুটি-হালুয়ার ভাগের জন্য যে কোনো ভূমিকায় নামতে কসুর করবেন না।

এই তো গেল একটি রাজনৈতিক দলের পল্টিবাজির কথা। এদিকে অসংগঠিত, সংঘহীন এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়েও ভোল পাল্টাচ্ছেন কেউ কেউ। কোনো কোনো নির্লোভ মানুষও আদর্শগত কারণে নির্দোষ ইস্যুতে দ্রুত ভিন্নমত পোষণ করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উৎকটভাবে প্রকাশ পাচ্ছে তা। দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসনের শেষ ১০ বছর দেশজুড়ে ছিল ফ্যাসিস্ট সরকারের ভয়ের সংস্কৃতি। সে সময় ক্ষমতাসীন দলের দুর্বল মানুষটিও আতঙ্কে কথা বলতেন না। এখন তিনিও কড়া সমালোচনা করছেন এক মাসেরও কমবয়সী অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে। এমনকি প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে শেখ হাসিনার প্রিয় গালিটিও ব্যবহার করছেন কেউ কেউ নির্দ্বিধায়। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দুই অনভিজ্ঞ উপদেষ্টার সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়েও নিষ্ঠুর ট্রল করছেন। ওই দুই তরুণের সাহস, ত্যাগ ও প্রত্যয় ভুলে যাচ্ছেন নতুন স্বাধীনতা পেয়ে। এসব অকৃতজ্ঞ, অস্থির মানুষের জন্য বিশ্বের বড় বড় মনীষী অনেক কথা বলে গেছেন। যদিও তারা তা পড়ে না। পড়লেও বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করলেও স্বার্থের বিপক্ষে গেলে ভুলে থাকার অভিনয় করে। বিশ্ববিখ্যাত মনোবিশ্লেষক সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেন, ‘বেশিরভাগ মানুষ আন্তরিকভাবে স্বাধীনতা চায় না; কারণ, স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্ব যুক্ত এবং বেশিরভাগ মানুষ দায়িত্বকে ভয় পায়।’

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানের নানা গল্প, ছবি প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। ফ্যাসিস্ট শাসকের অত্যাচার-নির্যাতন-নিষ্ঠুরতার একেকটি কাহিনি ও একেকটি ছবি দেখে শিউরে উঠছে জাতি। বুক চিতিয়ে সাঈদের গুলিবরণ, আন্দোলনকারীদের মধ্যে পানি বিতরণকালে মুগ্ধর কপালে গুলি, কার্নিশে ঝুলে থাকা গুলিবিদ্ধ কিশোর, হেলিকপ্টার দেখতে ব্যালকনিতে গিয়ে উৎসুক বালিকার গুলিবিদ্ধ লাশ, সাঁজোয়া যান থেকে ফেলে দেওয়া ইয়ামিনের নিথর দেহ, বস্তার মতো স্তূপ করে রাখা লাশে আগুন—হিটলারের শাসনামলের দমনপীড়নকেও যেন হার মানিয়েছে। এরকম শোকের হাজারো গল্প জন্ম নিয়েছে গণতন্ত্রের জন্য প্রায় হাজারখানেক মানুষের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। অথচ কী নিদারুণ সমালোচনা হচ্ছে মহলবিশেষে। যে কোনো ছোটখাটো অসংগতিতেই উচ্চারণ করছে— ‘আমরা কি এই স্বাধীনতা চেয়েছিলাম?’ পদত্যাগে বাধ্য সরকারের অতি উৎসাহী পেটুয়া বাহিনী ও অনুগত আমলারা ট্রমার অজুহাতে অনেকে কাজ করছেন না। তাদের বারবার ব্যর্থ প্রতিবিপ্লব চেষ্টা দেখেও উৎসাহ দিচ্ছে কেউ কেউ। তাদের কর্মকাণ্ড দেখে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা মনে পড়ে। তিনি বিরক্ত হয়ে মাঝেমধ্যেই শপথভাঙা বক্তব্য দিতেন। একবার বললেন, বেশি কথা বললে সবকিছু বন্ধ করে বসে থাকব। তার রেখে যাওয়া বশংবদ কর্মকর্তাদের নিষ্কর্মা অবস্থান দেখে তার কথা মনে পড়ে।

একপক্ষের আপাত সমাধি দেখে অন্যপক্ষের চাঁদাবাজ-দখলবাজরা যেন কবর থেকে উঠে এসেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে আশাবাদী বিএনপি নেতৃত্ব।

দুঃখিনী বাংলাদেশে শান্তি-স্বস্তিতে যেন ভীষণ বিরক্ত রাজনৈতিক দলের লোভী প্রভাবশালীরা। আর তাদের কৃপাপ্রার্থী পেশাজীবী থেকে বেকার অনুসারীরা পক্ষে-বিপক্ষে কোরাস গেয়েই চলে সব পরিস্থিতিতে। এ অচলায়তন, অদ্ভুত আঁধার যেন ঘুচবে না কোনো দিন। সেই ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত কবিতায় জীবনানন্দ দাশ বলেছেন—অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই—প্রীতি নেই—করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।/ যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি/ এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়/ মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা/ শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

আজও প্রাসঙ্গিক এই কবিতা। আজও আবেদন ফুরায়নি। এমনটি না হলেই ভালো হতো। বোধকরি জীবনানন্দ বাবুও আনন্দ পেতেন।

লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশের পর প্রতিবন্ধী রনি পেল হুইলচেয়ার

শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে : আবু হানিফ

ক্রীড়াবিদ শওকত আলীর স্মরণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল

শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

রাসূল (স.) আদর্শ ধারণ করে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে

ঝিনাইদহে নাশকতা মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী সুজনের গ্রেপ্তারের খবরে বিএনপির আনন্দ মিছিল

মানিকগঞ্জে ধলেশ্বরী নদী থেকে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার

ভূমি উপদেষ্টার পরিদর্শন, হয়রানি ছাড়া নামজারি খতিয়ান পেয়ে উৎফুল্ল নাজিম  

১০

চট্টগ্রামে জশনে জুলুশে মানুষের ঢল  

১১

বন্যা পরবর্তী প্রাণী চিকিৎসায় বাকৃবি শিক্ষার্থীরা

১২

‘দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির জন্য রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করতে হবে’

১৩

নার্সের ভুলে ৩ দিনের শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ

১৪

‘স্মরণকালের সবচেয়ে বড় গণসমাবেশ’ করার প্রস্তুতি বিএনপির

১৫

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালিত

১৬

রাত ১টার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের আভাস

১৭

সিরাজগঞ্জে কবরস্থানে মিলল অস্ত্র ও গুলি

১৮

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমিরের মতবিনিময়

১৯

২৮ থেকে ৪২তম বিসিএসের বঞ্চিত সেই ক্যাডাররা ফের বঞ্চনার শিকার

২০
X