অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:০৫ এএম
আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৪০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশেষ সাক্ষাৎকার

স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে

স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে

অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষ করেছেন সম্প্রতি। ১৯৮১ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স ও ১৯৯১ সালে অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন নিশ্চিতে বেসরকারি সংস্থার ভূমিকা’ বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত ছাত্র-জনতার আন্দোলন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম, রাষ্ট্র সংস্কার, নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন।

কালবেলা: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের একটি নতুন সরকার গঠিত হলো। এই গণঅভ্যুত্থান ও পরিবর্তনকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

তাসনিম সিদ্দিকী: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় এই পরিবর্তনকে বলা হয় এনোমিক মুভমেন্ট। এনোমিক মুভমেন্ট প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়। কিন্তু সাধারণত এই মুভমেন্ট বা আন্দোলন শেষ হওয়ার পর সেটি আর টিকে থাকে না। অর্থাৎ সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে ছাত্রদের এবারের আন্দোলনটি শুধু তাদের ইস্যুতে সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন একটি স্বৈরশাসনের মধ্যে ছিলাম। ছাত্রদের আন্দোলন সেই স্বৈরশাসনের কাঠামোটি উপড়ে ফেলতে পেরেছে। বলতে গেলে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যে তত্ত্ব সেটাকে মিথ্যা করে দিয়েছে আমাদের ছাত্র আন্দোলন। এখন বলতে হবে, এনোমিক মুভমেন্টও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। সেই উদাহরণ বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে।

এই পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য ভীষণ জরুরি ছিল। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে যখন পরিবর্তন সম্ভব হয়নি, রাজনৈতিক দলগুলো মোটামুটিভাবে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে ছাত্রছাত্রীদের বিপুল শক্তি স্বৈরশাসনের শক্ত কাঠামো ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে আন্দোলনে ছাত্রীদের সংযুক্ত হওয়া এই আন্দোলনের শক্তিকে বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এটি আমাদের নারী রাজনীতির সম্পর্কে নতুন একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করছে। সবকিছু মিলিয়ে এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি আন্দোলন ছিল এবং এর ফলাফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে, যদি আমরা পরবর্তী ধাপগুলোতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি।

বাংলাদেশে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে তার প্রধান হিসেবে শপথ নিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ড. ইউনূস বিশ্বজনবিদিত একজন ব্যক্তি এবং একই সঙ্গে এরকম একটি সময়ে বাংলাদেশের হাল ধরার জন্য তার থেকে আর কোনো যোগ্য ব্যক্তি আছে বলে আমার মনে হয় না। সেদিক থেকে একদম সঠিক ব্যক্তি এ মুহূর্তে দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এই সরকারটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে গঠিত হয়েছে। ফলে সরকারে যারা রয়েছেন তাদের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে বুঝে উঠতে কিছুটা সময় প্রয়োজন। আমি আশা করছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের একটি ভালো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

কালবেলা: সাধারণত কোনো দেশে গণঅভ্যুত্থান হলে নতুন করে রাষ্ট্রকাঠামো গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সেই জায়গাটায় আপনার কী পরামর্শ থাকবে?

তাসনিম সিদ্দিকী: বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এখানে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয় এবং কিছুটা সময় পর সেই গণতান্ত্রিক সরকার ধীরে ধীরে স্বৈরাচারী রূপ লাভ করে। ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে তারা বারবার নিজেদের প্রয়োজনমতো সংবিধানকে পরিবর্তন করে নেয়। তারা সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে নেয়। পরবর্তী সময়ে আবার আরেকটা বিপ্লব করে তাদের ক্ষমতা থেকে সরাতে হয়, অন্য কোনো উপায়ে তাদের সরানো কঠিন হয়ে পড়ে। যখন আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি প্র্যাকটিস করেছি, তখন এর অধীনে নির্বাচনগুলো মোটামুটি ভালো হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন অসহিংস প্রক্রিয়ায় হয়েছে। কিন্তু এর পরই আবার রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরাচারী আচরণ শুরু করেছে।

সর্বশেষ, আওয়ামী লীগ একটানা প্রায় ১৬ বছর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকেছে। এ সময়ের মধ্যে চারটি নির্বাচন হয়েছে। প্রথম নির্বাচনে অর্থাৎ ২০০৯ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তারা ক্ষমতায় এসেছে। এরপর তিন-তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে তারা নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করেছে। এ সময় আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র কাঠামোর অনেক কিছু অকেজো করে ফেলেছে। বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ এক ব্যক্তির শাসনে পরিণত করেছে। বিচার বিভাগ, আইন বিভাগসহ রাষ্ট্রের সব কাঠামোই ভেঙে পড়েছিল। রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ক্ষমতা হারিয়েছিল। তারা এক ধরনের স্বপ্রণোদিত হয়েই ক্ষমতা হারিয়েছিল। সবকিছু এক ব্যক্তির হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল। কেউ কিছুই করতে চাননি। সবকিছুই প্রধানমন্ত্রী বলবেন তারপর হবে। এরকম একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে। এই জায়গা থেকে এখন আমাদের বের হতে হবে। ভবিষ্যতেও যাতে রাষ্ট্র কাঠামো আবার এরকম একটি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিণত হতে না পারে সেভাবে রাষ্ট্র কাঠামোকে পরিবর্তন করতে হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্বাচনের আয়োজন করবে। তবে তার আগে রাষ্ট্র কাঠামোর জরুরি সংস্কার করে যেতে হবে। দলীয় সরকার কথায় কথায় সংবিধান পরিবর্তন করে ফেলেছে। আমাদের সংবিধানকে দুষ্পরিবর্তনীয় করতে হবে। আইনসভাকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট করলে এটা সম্ভব। আমাদের যে বিশাল জনসংখ্যা, সেটা এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা দিয়ে চালিত হলে এক ধরনের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ডিক্টেটরশিপ চালু হয় বলে দেখেছি আমরা। আইনসভার দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট হলে এখান থেকে আমরা বের হতে পারব। একটি হবে পেশাভিত্তিক অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ সব পেশার রিপ্রেজেন্টেটিভ থাকবে। সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে দুটি কক্ষেই সেটা পাস হতে হবে। আমেরিকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা দেখি দুটি কক্ষে দুটি দল থাকে। আমরা যদি তেমন একটি সিস্টেমে যেতে পারি, তাহলে পরিবর্তন আসতে বাধ্য।

দ্বিতীয়ত, সংবিধানকে এখন একটি আমূল পরিবর্তনের মধ্যে নিতে হবে। কারণ আমাদের সংবিধান অকেজো হয়ে পড়েছে। ’৭২ সালে যে সংবিধান তৈরি করা হয়েছিল তা খারাপ ছিল সেটা বলব না। সে সময়কার বৈপ্লবিক জায়গা থেকে সেটা ভালো সংবিধান ছিল। কিন্তু ৭৩-৭৪ সালেও সেই সংবিধান পরিবর্তন করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে বারবার পরিবর্তন করতে করতে সংবিধান একটি অদ্ভুত অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। সম্পূর্ণ সংবিধানকে নতুন করে লেখা গেলে সব থেকে ভালো হতো। নতুন করে সংবিধানে লেখা হলে সেখানে এখনকার প্রেক্ষাপটে মানুষের অধিকারগুলো ভালোভাবে স্থান পেত। যদি কোনো সময় সরকার স্বৈরতান্ত্রিক হয় তাহলে জনগণ সরকারকে অপসারণ করতে পারবে, সেই বিধি সংবিধানে থাকতে হবে। জনগণের শক্তিকে প্রয়োগের বিধান সংবিধানে নিশ্চিত করতে হবে।

কালবেলা: বিদ্যমান ব্যবস্থায় রাষ্ট্র উন্নয়নে সব দলের অংশগ্রহণ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়?

তাসনিম সিদ্দিকী: নির্বাচনে যে দল জিতেছে তারাই নিজেদের মতো করে সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। একই সঙ্গে তারা বিরোধী দলকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করার কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু এমনটা থাকা চলবে না। আমরা যদি একটি শ্যাডো ক্যাবিনেটের ব্যবস্থা করি, যেটা ব্রিটিশ সরকার ব্যবস্থায় রয়েছে, তাহলে বিরোধী দলকে দমনের বিষয়টি আর আসবে না। যখন কোনো বিল পার্লামেন্টে উপস্থাপন করা হবে তখন বিরোধী দলের নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা সেই বিলের ওপরে রিসার্চ করবেন এবং তাদের মতামত প্রদান করবেন। সেই মতামতের ভিত্তিতে বিলটি আবার সংসদে আলোচনা করা হবে। আমরা এভাবে সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে রাষ্ট্র গঠনের স্বার্থে পরস্পর সহযোগিতার সম্পর্ক চাই।

আমরা দেখি স্থানীয় সরকারের কোনো ক্ষমতা নেই। সংসদ সদস্যরা আইন পাস বা নীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণে এককভাবে কাজ করেন। আমরা দেখি সংসদ সদস্যরা স্থানীয় সরকারে অংশগ্রহণ করছেন। এর ফলে স্থানীয় সরকার সবসময় দুর্বল থাকে। আমাদের প্রয়োজন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র সমস্ত ক্ষমতা ঢাকাকেন্দ্রিক করে রেখেছে। এই ক্ষমতাগুলোকে ক্রমান্বয়ে ব্যুরোক্রেসির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া এবং স্থানীয় পর্যায়ে ডিসিশন নেওয়া এবং পরিকল্পনা প্রণয়ন-বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।

কালবেলা: বিশ্বের অনেক দেশে আমরা প্রদেশভিত্তিক শাসন দেখি। কেন্দ্রের জন্য আলাদা একটি সরকার এবং প্রতিটি প্রদেশের জন্য আলাদা সরকার। এই প্রক্রিয়ায় কিছু ভালো ফল পাওয়া যায়। আপনি কী মনে করেন?

তাসনিম সিদ্দিকী: আমার মনে হয় বাংলাদেশের আয়তন ছোট দেখে প্রদেশভিত্তিক শাসনের কথা চিন্তা করা হয়নি। কিন্তু আমার মনে হয় ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের জন্য এখন এমন চিন্তা করে যেতে পারে। জেলা পর্যায়ে সম্ভব না হলেও আমাদের সাতটি বিভাগকে আলাদা আলাদা করে ধরে প্রাদেশিক শাসনের মতো শাসন তাদের হাতে তুলে দেওয়ার চিন্তা করা যেতে পারে। এটা আমাদের স্টাডি করে দেখতে হবে।

কালবেলা: সবাই সংবিধান সংশোধনের কথা বলছেন বা কেউ কেউ সংবিধানকে নতুন করে লিখতে বলছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেটা কীভাবে করতে পারে?

তাসনিম সিদ্দিকী: সরকার সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে একটি অ্যাসেম্বলি তৈরি করতে পারে বা একটি নির্বাচন দিতে পারে। এসব দল থেকে অভিজ্ঞ কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে এবং সরকারে বিদ্যমান বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এই নির্বাচনটা হতে পারে। নির্বাচনের পর গণপরিষদের মতো একটি সিস্টেমে সংবিধান সংশোধন করে তারপর আবার একটি নির্বাচন দিতে পারে।

কালবেলা: রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন?

তাসনিম সিদ্দিকী: রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত গ্রামপর্যায় থেকে নেতৃত্ব খুঁজে বের করা। আমাদের বিশাল ছাত্রসমাজ। এদের এলাকাভিত্তিক ভাগ করে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব খুঁজে বের করতে পারি। যদি মাঠপর্যায় থেকে নেতৃত্ব তুলে আনা যায় সেটা রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটা বড় পরিবর্তন নিয়ে আসবে। আমরা দেখি এখন দলের কেন্দ্র থেকে দু-একজনে ঠিক করে দিচ্ছেন কে কোন জায়গায় নির্বাচনে দাঁড়াবেন। আমাদের দেশে নমিনেশন বাণিজ্য ওপেন সিক্রেট একটা বিষয়। আমরা জানি, যিনি যত বেশি টাকা দিতে পারছেন তিনিই দলের নমিনেশন পাচ্ছেন। এই সিস্টেম থেকে বের হতে হবে।

প্রথমে এলাকাভিত্তিক একেবারে প্রাইমারি স্টেজ থেকে নির্বাচন করে কিছু নেতৃত্ব বের করে আনতে হবে। এরপর তাদের মধ্য থেকে রাজনৈতিক দল নমিনেশনের জন্য একজনকে বেছে নেবে। আমরা যদি এমন সিস্টেম তৈরি করতে পারি এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে তা মানতে বাধ্য করতে পারি, তাহলে পরিবর্তন সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ করবে যে, আমরা এই শর্ত মেনে নির্বাচনে আসছি এবং নির্বাচনের পরও তা বদলাব না। যদি তারা ক্ষমতায় এসে এই কন্ট্রাক্ট মানতে অস্বীকার করে, তাহলে জনগণ আবার আন্দোলন করবে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে নিজের ইচ্ছামতো যা খুশি তাই করবে, এই সুযোগ দেওয়া যাবে না।

কালবেলা: সংবিধান পরিবর্তন করতে চাইলে কোন কোন বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?

তাসনিম সিদ্দিকী: সাত নম্বর অনুচ্ছেদ বলা আছে, যদি কেউ ক্যু করে ক্ষমতায় আসে তার শাস্তি কোর্ট মার্শাল। তেমনি বিধান রাখতে হবে যদি কেউ সংবিধান পরিবর্তন করে তারও একই পরিণতি হবে। এভাবে সংবিধানের মধ্যে অনেক বিধানে পরিবর্তন করা প্রয়োজন। ৭০ অনুচ্ছেদে রয়েছে, সংসদ সদস্য তার দলের প্রস্তাবের বিপক্ষে ভেটে দিতে পারবে না।‌ এই আইন বাতিল করতে হবে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে ফ্লোর ক্রস করার স্বাধীনতা একজন সংসদ সদস্যের থাকতে হবে।

কালবেলা: গত তিনটি নির্বাচনে আমরা ব্যাপক কারচুপি দেখেছি। এর সমাধান কী হতে পারে?

তাসনিম সিদ্দিকী: আমাদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগগুলো হয়েছে দলীয়। নির্বাচন কমিশনের ব্যক্তিরা যে দল ক্ষমতায় থাকেন তার হয়ে কাজ করেন। নির্বাচন কমিশনকে দলীয় হওয়া থেকে বাঁচাতে হবে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের মধ্যে থাকা আইনকানুনগুলোর পরিবর্তন করতে হবে। আগামী নির্বাচনের আগেই নির্বাচন কমিশনের কাজের যে নিয়মাবলি তা নতুন করে তৈরি করতে হবে। যদি তারা নিরপেক্ষতার আইন মানতে না পারে তাহলে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

কালবেলা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারে নাগরিক সমাজের ভূমিকা কেমন হতে পারে?

তাসনিম সিদ্দিকী: আমরা এখন পর্যন্ত ভোটের অধিকারই প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। প্রতিটি বিষয় নিয়ে সিভিল সোসাইটির বক্তব্য শুনবে সরকার সেই বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে। যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুতে সিভিল সোসাইটির মতামত প্রদান করতে দেওয়া গণতন্ত্রের অন্যতম একটি হাতিয়ার। দেশের গণমাধ্যমকে স্বাধীন হতে হবে। দলের বাইরে গিয়ে তাদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। এবারের ছাত্র আন্দোলনেও সরকার গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। সরকার কর্তৃক মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ বন্ধ করতে হবে। এ ধরনের যে আইনগুলো সরকার তৈরি করেছে, তা বাতিল করতে হবে।

কালবেলা: রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি নাগরিকদের সংস্কারের প্রয়োজন আছে কি?

তাসনিম সিদ্দিকী: সমাজের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন প্রয়োজন। একটি পুনর্জাগরণের প্রয়োজন। এই পুনর্জাগরণ আমাকে আমার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করবে এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় কীভাবে অংশগ্রহণ করতে হয় তার পথগুলো শেখাবে। আমরা দেখেছি কীভাবে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমেছে। আমরা নাগরিক হিসেবে যেখানে ব্যর্থ হয়েছি সেই কাজ আমাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে করেছে। এখন আস্তে আস্তে দেশের সবকিছু স্বাভাবিক হচ্ছে, তাই এখন তাদের পড়াশোনার জায়গায় ফেরত যাওয়া দরকার। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কখন সামনে আসতে হয় সেই সচেতনতা থাকতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের আরও প্রস্তুত করতে হবে। সবসময় সংস্কারের জন্য পথে নামার প্রয়োজন হয় না। আইনি প্রক্রিয়ায়ও রাষ্ট্রসংস্কার সম্ভব। সেটাও আমাদের শিক্ষার্থীদের শিখতে হবে। মোট কথা তাদের সচেতন এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। রাষ্ট্রের যে কোনো প্রয়োজনে তারা যেন দায়িত্ব নিতে পারে নিজেদের সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে।

কালবেলা: স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক নর্মসগুলো গড়ে ওঠেনি কেন?

তাসনিম সিদ্দিকী: যখন প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিয়ম মানেন তখন বাকিরাও নিয়ম মানেন। কিন্তু যখন ওপর থেকে নিয়ম না মানার চর্চা শুরু হয় তখন সাধারণ মানুষও আর নিয়ম মানে না। আমাদের একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব দরকার। নাটক সিনেমাতেও আমরা দেখি কীভাবে নিয়ম ভঙ্গ করাটাই স্বাভাবিক। অথচ সেখানে উচিত ছিল কীভাবে সুনাগরিক হওয়া যায় এবং কীভাবে নিয়ম মানা যায় সেগুলোর চর্চা করা। নাটক সিনেমায় সমাজের শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্ত হওয়ার পথগুলো দেখানোর প্রয়োজন ছিল। সেগুলো দেখে মানুষ নিজের মধ্যে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারত। কিন্তু আমাদের দেশে হয়েছে ঠিক তার উল্টো। মানুষ তৈরি করার জন্য আমাদের সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে।

আমাদের প্রধান উপদেষ্টা সেদিন বললেন আমার ছবি আমি কোনো পত্রিকায় পাতায় দেখতে চাই না। এই একটি কথার মাধ্যমে তিনি তোষামোদি সিস্টেমটা বন্ধ করার আহ্বান জানালেন। তিনি যখন রাস্তা দিয়ে তার গাড়ি বহর নিয়ে গেলেন তখন জ্যামের মধ্যে আটকে থাকলেন। তিনি রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে জনদুর্ভোগ তৈরি করেননি। এভাবে নিয়ম মানার সিস্টেম ওপর থেকেই প্রতিষ্ঠিত হতে হয়। শাসক যখন নিয়ম মানেন তখন সাধারণ মানুষও নিয়ম মানে।

কালবেলা: অনেকে দাবি করছেন বাংলাদেশে আইন করতে হবে যাতে দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন। আপনার মতামত কী?

তাসনিম সিদ্দিকী: যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টশাসিত সরকার। সেখানে আইন রয়েছে একজন ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে নিয়ম হলো একজন ব্যক্তি দলের প্রধান হিসেবে যদি একবার নির্বাচনে হেরে যান তাহলে তাকে দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়ে অন্য কাউকে নেতৃত্ব দিতে হবে। এই দুটি সিস্টেমের যে কোনো একটি সিস্টেম আমরা নিতে পারি।

যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের মেয়াদ চার বছর। অনেক দেশে এরকম সরকারের মেয়াদ চার বছর। আবার অনেক দেশে আমাদের মতো পাঁচ বছরও রয়েছে। আমার মনে হয় সরকার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কিছু পদক্ষেপ নিতে গেলে পাঁচ বছর প্রয়োজন পড়ে। তবে আমরা যেখানে একবিংশ শতাব্দীতে এসে দাঁড়িয়েছি পৃথিবীটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সবকিছু আরও অনেক গতিশীল হয়েছে। আগে সরকারের যে কাজ পাঁচ বছর লাগত এখন সেই একই কাজ দুই বছরে করা সম্ভব। তাই সরকারের মেয়াদ চার বছর হতে পারে। পাঁচ বছরের জায়গায় সরকারের মেয়াদ চার বছর হলে হয়তো কাজের গতি বাড়বে। সবার লক্ষ্য থাকবে দ্রুত কীভাবে পরবর্তী নির্বাচনের আগে সরকারের ম্যান্ডেটগুলো সম্পন্ন করা যায়। সুতরাং এ বিষয়টা নিয়ে আমাদের আরও ভাববার অবকাশ রয়েছে।

কালবেলা: আমাদের সমাজে এক ধরনের বিভক্তি তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোই এই বিভক্তি তৈরি করেছে। এটা দূর করতে আমাদের করণীয় কী?

তাসনিম সিদ্দিকী: বাংলাদেশে প্রায় সব জনগণ একই জাতিভুক্ত। এখানে ৯৯ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষাভাষী। আমাদের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ও আদিবাসীদের আলাদা সংস্কৃতি ও ভাষা রয়েছে। তারা স্বাধীনভাবে সেগুলো চর্চা করতে পারে। সেটা নিয়ে সমাজে কোনো বিভক্তি নেই। কিন্তু আমাদের সমাজে যে বিভক্তি আমরা দেখি তার সম্পূর্ণই রাজনীতিকেন্দ্রিক। রাজনীতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে সমাজকে বিভক্ত করে ফেলেছে। কে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে কে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে! এটা শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নেই, এই চেতনা হয়ে পড়েছে বিরোধী দলকে দমনের অস্ত্র। আর সব থেকে খারাপ পর্যায় হলো, রাজাকার ট্যাগ দেওয়া।

মুক্তিযুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টিকে একটি দল দলীয়করণ করে ফেলেছে। দলকে সমর্থন না করলেই তারা রাজাকার, দলের বিরোধিতা করলেই তারা রাজাকার। দলের পক্ষে না হলে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি। এটা খুবই হাস্যকর। শুধু এই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি ও পক্ষ শক্তি ট্যাগ দিয়ে দীর্ঘদিন দেশের বিরোধী দলগুলোকে কোণঠাসা করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ। এই বিভেদটি তারাই তৈরি করেছে, একেবারেই নিজেদের স্বার্থে। এটা একান্তই আওয়ামী লীগের দায়। আওয়ামী লীগ ১৫ বছরে যে বিভেদ তৈরি করেছেন সেটা মুছতে হলে সময় লাগবে। আস্তে আস্তে সেটা ঠিক হবে।

আমরা এই ছাত্র আন্দোলনের শেষ দিকে যে স্লোগানটা দেখেছি—রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার। এই স্লোগানটা মুক্তিযুদ্ধ আর রাজাকারের এতকালের বিভেদকে এক মুহূর্তে বদলে দিয়েছে। এভাবেই বদলে দিয়েছে যে আমরা সবাই দেশপ্রেমিক। রাজাকার ট্যাগ দিয়ে একটা দল শুধু তাদের স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছিল। এই রাজাকার ট্যাগের কোনো ভ্যালু নেই। এই ট্যাগ দেওয়ার বিভেদকে বাদ দিয়ে আমাদের সবাইকে দেশপ্রেমিক হিসেবে সমাজকে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করব।

কালবেলা: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আপনার পরামর্শ কী থাকবে?

তাসনিম সিদ্দিকী: যেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নিয়েছেন ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস, সেহেতু আমি সরকারকে খুব ভালো চোখে দেখছি। দেশ-বিদেশে তার গ্রহণযোগ্যতা ব্যবহার করে আমরা এগিয়ে যেতে পারব। আমি মনে করি সরকারে যারা উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন তারা বসে অল্প সময়ের মধ্যে একটি রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব জনগণের সামনে তুলে ধরবেন। রাষ্ট্র সংস্কারের একটা রূপরেখা সামনে আনতে পারলে তারাও দ্রুত সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে এগোতে পারবেন। যদি তারা সবাই বসে একটি নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনায় চলে আসেন তাহলে ভালো হবে। তারা কোন বিষয়ে কী বলবেন এবং কী করবেন সে বিষয়ে তাদের মধ্যে একটি ঐকমত্য প্রয়োজন। যাতে আমরা একেকজনের কাছ থেকে একেকরকম চিন্তা বা কথা শুনতে না পাই। তারা কীভাবে কাজ করবেন কোন বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেবেন, সেটা ঠিক করে নিয়েই তাদের এগুলো করা উচিত। মনে হয় তারা একটি ভালো নির্বাচন দিতে পারবেন, একটি ভালো সংবিধান দিতে পারবেন এবং আমরা গণতন্ত্রের পথে একটু একটু করে এগিয়ে যাব।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রুরা ওত পেতে আছে

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ গ্রেপ্তার

‘গণহত্যায় উসকানিদাতা কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদেরও বিচারের আওতায় আনা হবে’

জাবিতে গণধোলাইয়ের শিকার সাবেক ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু ঘিরে রহস্য

বৈদেশিক ঋণ আবার ছাড়িয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা পদক পেলেন নৌবাহিনীর ২শ’ সদস্য

সিলেট জেলা ও মহানগর যুবদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা

জাহাঙ্গীরনগরে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে গণপিটুনি, হাসপাতালে মৃত্যু

ডিপিডিসি কর্মকর্তা-কর্মচারী সমবায় সমিতির নতুন কমিটি

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হয়ে আলী রীয়াজের ফেসবুক স্ট্যাটাস

১০

আলজাজিরার অনুসন্ধান / যুক্তরাজ্যে ৩৬০টি বাড়ি কিনেছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী

১১

রূপপুর পারমাণবিকের প্রথম ইউনিটে ডামি ফুয়েল লোডিং শুরু

১২

মহেশখালী থেকে অস্ত্রসহ একজনকে আটক করেছে নৌবাহিনী

১৩

নকল সোনার মূর্তি দিয়ে প্রতারণা, গ্রেপ্তার ২

১৪

কুমিল্লায় ট্রাকচাপায় প্রবাসী যুবক নিহত

১৫

ভুল সংশোধনী ও দুঃখ প্রকাশ

১৬

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে যানজট নিরসনে পুলিশের অভিযান

১৭

মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হেরে গেলেন গৃহবধূ শারমিন

১৮

সন্তানকে পানিতে চুবিয়ে হত্যার অভিযোগ, সৎ মা আটক

১৯

বাকৃবিতে জৈব বর্জ্যের বিকল্প শিল্পায়ন বিষয়ে আলোচনা সভা

২০
X