বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ৪৭ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন যাদের বয়স ৫০ বছর, তারাও উপলব্ধি করতে পারবেন না কত ভয়াবহ পরিস্থিতি তখন ছিল। কেননা যাদের বয়স ৫০ বছর, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় তাদের বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। নোবেলজয়ী জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর ইউলি ব্রান্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর মন্তব্য করেছিলেন—‘যে জাতি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে, সেই জাতিকে আর বিশ্বাস করা যায় না।’ বিবিসি টেলিভিশনের দূরপ্রাচ্য সংবাদদাতা ব্রায়ান ব্যারন বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক দিন পর বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে ঢাকা পৌঁছান। তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তিন দিন আটক থাকার পর তাদের সবাইকে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে লিখিত তার সংবাদ বিবরণীতে বলা হয়, শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং জনসাধারণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা যখন ঘটবে, তখন নিঃসন্দেহে তার বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারক-চিহ্ন এবং তার কবরস্থান পুণ্য তীর্থে পরিণত হবে। (‘দ্য লিনার’, লন্ডন, ২৮ শে আগস্ট, ১৯৭৫)
আমি পাঠকদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের অংশবিশেষ উপস্থাপন করব। বইটির লেখক লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ, পিএসসি; যিনি খ্যাতিমান দাবাড়ু রানী হামিদের স্বামী এবং ফুটবলার কায়সার হামিদের বাবা। ১৯৯৪ সালে হাওলাদার প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। বইটির নাম ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’। লেখক ভূমিকায় যা লিখেছিলেন (ফ্ল্যাপে) তার কয়েকটা লাইন এরকম—
‘... ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, নভেম্বর অভ্যুত্থানগুলোর উপর আমার লেখার সুবিধা হলো, ঐ সময় সৌভাগ্যক্রমে আমি ঢাকার স্টেশন কমাণ্ডার হিসেবে অত্যন্ত কাছ থেকে ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানগুলো প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। এছাড়া অভ্যুত্থানের প্রধান নায়কদের প্রায় সবার সাথে ছিল আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও সরাসরি জানাশোনা।’
২৫ মে, ১৯৯৩
লে. কর্নেল (অব.) এম.এ. হামিদ পিএসসি
এবার দেখা যাক, লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ কী লিখেছিলেন—“যে কোনো কারণেই হোক, শেখ সাহেব ও আওয়ামী লীগ ব্যক্তিবর্গরা জিয়াকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী বলে মনে করতেন। জেনারেল ওসমানীও জিয়াকে ভালো চোখে দেখতেন না। এমনকি ঐ সময় জিয়াকে পূর্ব-জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে আর্মি থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা প্রায় পাকাপাকি হয়ে যায়। এসব জেনে জিয়া কর্নেল (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) খুরশীদের মাধ্যমে শেখ সাহেবকে বুঝাবার চেষ্টা করেন। কর্নেল খুরশীদ আগরতলা কেইসে শেখ সাহেবের সহযোগী ছিলেন। তাই তিনি তাঁর খুব কাছের লোক ছিলেন। কিন্তু তিনি জিয়ার প্রতি শেখ সাহেবের মনোভাব কিছুটা পরিবর্তন করাতে সক্ষম হলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না। তোফায়েল আহমদের সাথেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেন জিয়া, শেখ সাহেবের সহানুভূতি অর্জনের জন্যে। এ নিয়ে পঁচাত্তর সালে জিয়ার মন মেজাজ ভালো ছিল না। এ সময় তিনি প্রায় একঘরে দিন কাটান। বিশেষ কেউ তাঁর কাছে আসা-যাওয়া করতো না। আমি তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের স্টেশন কমান্ডার। ঐ সময় তাঁর সাথে যতবারই দেখা হয়েছে, তাঁর উগ্রতা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। তবে বলতেন, শেখকে ঐ ব্যাটারাই (শফিউল্লাহ, খালেদ) আমার বিরুদ্ধে খেপিয়েছে। জেনারেল ওসমানীকেও গালাগালি করতেন। আমি তাঁকে শান্ত থাকার অনুরোধ করতাম। জিয়ার সাথে বরাবর আমার ছিল ভালো সম্পর্ক। তাঁর সাথে আমার সুসম্পর্ক শফিউল্লাহ ও খালেদ ভালো চোখে দেখেননি। জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রদূত করে পূর্ব-জার্মানি অথবা বেলজিয়ামে পাঠাবার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। একদিন জিয়া তাঁর অফিসে আমাকে ডেকে বলল : হামিদ, তুমি ওসমানীকে ধরে এখনই কিছু একটা না করলে চিঠি বেরিয়ে যাবে। প্লিজ ডু সামথিং। জনাব সাইদুর রহমান, একজন প্রভাবশালী মুক্তিযোদ্ধা। তার সাথে আমার পরিচয় ছিল। তোফায়েল ও রাজ্জাকের সাথে উনার ছিল গভীর সংযোগ। আমি জিয়াকে আশ্বাস দিলাম, তাঁর মারফত আমি কিছু একটা করব। জনাব সাইদকে আমি বন্ধুবর জিয়াউর রহমানের ব্যাপারটি বললাম। তিনি কিছু একটা করবেন বলে আমাকে আশ্বাস দিলেন। আমি বরং জিয়াকেই তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম, যেন জিয়া নিজেই তাঁকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিতে পারে। পরে জনাব সাইদ, তোফায়েল আহমদ ও রাজ্জাককে ধরে বহু কষ্টে প্রায় শেষমুহূর্তে জিয়ার সিভিল পোস্টিং ধামাচাপা দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
ব্যাপারটা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ বহু বছর পর সেদিন জনাব সাইদ আমার টেলিফোন নাম্বার সংগ্রহ করে ফোন করে বললেন : কর্নেল সাহেব, আপনার জন্যেই ১৫ অগাস্ট, ৩ নভেম্বর এবং ৭ নভেম্বর সংঘটিত হলো। ব্যাপারটি আমি বুঝতে না পারায় তিনি এবার পরিষ্কার করে বললেন, আপনি সেই যে জিয়াউর রহমানের পোস্টিং ক্যানসেল করানোর জন্যে আমাদের কাজে লাগিয়েছিলেন, সেটাইতো কাল হলো। জিয়া না থাকলে তো এ তিনটা অভ্যুত্থানের কোনোটাই হতো না।” (‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’—পৃষ্ঠা নং ১৬, ১৭)
(দুই) ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টি আগে থেকে তার (জিয়াউর রহমান) জানা থাকলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের প্রতিহত করা বা রাষ্ট্রপতিকে বিষয়টি অবহিত করার ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেননি। তার অধীন বাহিনীকেও বঙ্গবন্ধুর সম্ভাব্য খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেননি। বরং, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগীদের তিনি অন্যতম। এমনকি ১৫ আগস্ট ভোরে কর্নেল শাফায়াত জামিল জিয়াউর রহমানের বাসভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর দিলে তিনি একটুও বিচলিত না হয়ে বলেন, ‘So what! President is dead? Vice-president is there. Get your troops ready.’ তার এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে একেবারেই আমলে নেননি তিনি।
১৯৭৫ সালে সপরিবার বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া না গেলেও বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের সাক্ষাৎকার ও সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহের নানা বিবরণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, জিয়াউর রহমান এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের অন্যতম কর্নেল ফারুক রহমান জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর সহায়তায় দেশের শাসনভার তুলে নেওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি বলেন, ‘আমি দুঃখিত। আমি এ ধরনের কাজে নিজেকে জড়াতে চাই না। তোমরা জুনিয়র অফিসাররা যদি একটা কিছু করতে চাও, তাহলে তোমাদের নিজেদেরই তা করা উচিত। আমাকে এসবের মধ্যে টেনো না।’ সে সময় ঢাকার স্টেশন কমান্ডার ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী লে. কর্নেল (অব.) আবদুল হামিদ ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার বিষয়ে বলেন, “আমরা সিনিয়র অফিসাররা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে টেনিস কোর্টে নিয়মিত টেনিস খেলতাম। ১৪ আগস্ট বিকেলে জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল মামুন, কর্নেল খোরশেদ ও আমি চাকরিচ্যুত মেজর নুরকে টেনিস কোর্টের আশেপাশে দেখতে পাই, যা আমার কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। কারণ তারা চাকরিচ্যুত জুনিয়র অফিসার। একই দিন জেনারেল সফিউল্লাহ আমাকে বলেন, ‘এরা চাকরিচ্যুত জুনিয়র অফিসার, এরা কেন টেনিস খেলতে আসে?’ আমাকে তিনি বলেন, ‘এদের মানা করে দেবেন, এখানে যেন এরা না আসে।’ খেলা শেষে আমি মেজর নুরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমরা কার অনুমতি নিয়ে এখানে খেলতে আসো?’ জবাবে নুর জানায়, জেনারেল জিয়ার অনুমতি নিয়ে তারা এখানে খেলতে আসে।”
১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাত্র ৯ দিন পর তিনি (জিয়াউর রহমান) চিফ অব আর্মি স্টাফ নিযুক্ত হন। ওই বছরের ৩ নভেম্বর কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ব্রিগেডের সহায়তায় খালেদ মোশাররফ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটালে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী-প্রধানের দায়িত্বে আসেন। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন সামরিক অভ্যুত্থান তাকে সে সময় রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। ক্ষমতায় আসার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের খুনিদের সেনাবাহিনীতে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের পদোন্নতিও দেন। এমনকি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে ও কূটনৈতিক মিশনে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের চাকরির ব্যবস্থা করেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান যে বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তের বিষয়ে জ্ঞাত ছিলেন, তা সম্ভবত প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত বা প্রচারিত হয় ১৯৭৬ সালে বিলাতের আইটিভি চ্যানেলের World in Action প্রোগ্রামে সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে দেওয়া লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। এ সাক্ষাৎকারে ফারুক-রশীদ দাবি করে যে, বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তের বিষয়ে ১৫ আগস্টের বহু আগেই জিয়াকে তারা অবহিত করে। ফারুক জানায়, “২০ শে মার্চ ১৯৭৫ সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটের দিকে সে জিয়ার বাসায় জিয়ার সাথে দেখা করে এবং তাকে বলে—The country required a change.
উত্তরে জিয়া বলেন, ‘Yes, yes, lets go outside and talk’। তখন জিয়া ফারুককে নিয়ে বাইরে বাড়ির লনে যায়। সেখানে ফারুক পুনরায় বলে, ‘We have to have a change. We, the junior officers, have already worked it out. We want your support and leadership’। জিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। জিয়া বলেন, ‘If you want to do something, you junior officers should do it yourself…’ (Anthony Mascarenhas, Bangladesh – A Legacy of Blood, page 54, Hodder and Stroughton, London, 1986)
প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭৬ সালে দেওয়া জিয়ার মাসকারেনহাসকেই দেওয়া এক সাক্ষাৎকার থেকে। মাসকারেনহাস এর ভাষায়, ‘In July, 1976, while doing a TV programme in London on the killing of Sheikh Mujib I confronted Zia with what Farook had said’ (তাদের সাক্ষাৎকারে)। জিয়া এ ব্যাপারে উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। ফারুকের সাথে তার এমন কথোপকথনের বিষয়টি এসেছে এভাবে— ‘Zia did not deny it– nor did he confirm it’ (Anthony Mascarenhas, Bangladesh– A Legacy of Blood, page 54, Hodder and Stroughton, London, 1986)|
সাক্ষাৎকারে জেনারেল জিয়ার গড়িমসি বা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ভাব দেখে ধারণা করা যেতে পারে যে, ফারুকের সঙ্গে জিয়ার এ কথোপকথন সত্য। এর সত্যতার আরও প্রমাণ মেলে আরও অনেক বছর পরে ১৯৯৭ সালে, যখন ফারুক জেলে আর রশীদ ইউরোপে। ১৯৯৭ সালে রশীদের সঙ্গে মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজের সাক্ষাৎ হয় ইউরোপে। লিফশুলজের ভাষায়, ‘In 1997 I met Rashid for several hours in an European city… I went over with him exactly what he had told Mascarenhas about ZiaÕs involvement. Rashid confirmed to me the accuracy of his interview with Mascarenhas.’
শুধু তাই নয়, রশীদ লিফশুলজকে এ ব্যাপারে আরও বহু কিছু বিস্তারিত জানায়। রশীদ জোরালোভাবে বলে যে, ‘He (Rashid) had met General Zia numerous times prior to the coup and that Zia was fully in the picture’ (In Conversation with Lawrence Lifschultz– The Daily Star, December 4, 2014).
জিয়ার সঙ্গে ফারুক-রশীদের সাক্ষাৎ এবং আলোচনা যে আরও অনেকবার হয়েছে তার প্রমাণ মেলে রশীদের স্ত্রী জোবায়দা রশীদের বক্তব্য থেকে। তিনি বলেন, “একদিন রাতে ফারুক জিয়ার বাসা থেকে ফিরে আমার স্বামীকে (রশীদ) জানায় যে, সরকার পরিবর্তন হলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চায়। শুধু তাই নয়, জিয়া আরও বলেন—‘If it is a success then come to me. If it is a failure then do not involve me.’ (আসাদুজ্জামান বস সবকিছুর ব্যবস্থা নিচ্ছেন, প্রথম আলো, ১৫ আগস্ট, ২০১৮)।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তের বিষয়ে অবহিত ছিলেন কী ছিলেন না, তা বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টা পর কর্নেল শাফায়েত জামিল এবং জিয়ার কথোপকথন থেকে। তবে বিষয়টা বুঝতে হবে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে। সেই সকালে শাফায়েত জামিল জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাকে শেভ করতে দেখেন। জামিল জিয়াকে বলেন, ‘The President has been killed, Sir. What are your orders?
উত্তরে জিয়া বলেন, ‘If the President is no longer there, then the Vice President is there. Go to your headquarters and wait there’| তখন কর্নেল জামিলের দৃষ্টিতে জিয়াকে অনেক শান্ত দেখায়, ‘Evidently aware of what had happened’ (Anthony Mascarenhas, Bangladesh– A Legacy of Blood, page 76, 1986)।
ওপরের বিশ্লেষণ থেকে কয়েকটি বিষয় এখানে পরিষ্কার, বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তের বিষয়ে জিয়া পূর্বেই অবহিত ছিলেন; চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেননি, বরং চক্রান্তকারীদের উৎসাহিত করেছেন এবং সেইসঙ্গে, আসন্ন পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। এসব তথ্য এবং বিশ্লেষণ থেকে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং একটি নির্বাচিত সরকারকে অবৈধভাবে উৎখাতে জিয়ার পূর্ণ সমর্থন ছিল। এ ব্যাপারে লিফশুলজের অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের ফলাফল পরিষ্কার—‘Had he (Zia) been against the coup, as Deputy Chief of the Army, Zia could have stopped it.’
তার মতে, “… Zia played perhaps the most crucial of all roles. He was the key ‘Shadow Man’. He (Zia) assured Rashid that he would make certain that the forces in the Army would not move against him and his men if they succeeded.” (In Conversation with Lawrence Lifschultz – The Daily Star, December 4, 2014).
এসব থেকে আমরা বলতে পারি যে, জিয়া জেনেশুনে এবং সজ্ঞানে উপ-সেনাপ্রধান হিসেবে দেশের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেননি। এ কারণে তার সাজা হতে পারে, তাই বলে কি বলা যাবে যে, জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তকারীদের একজন? যদি তাই হয়, তাহলে জিয়ার সঙ্গে শুধু ফারুক-রশীদের নয়, হত্যা পরিকল্পনার অন্যান্যদের যেমন, খন্দকার মোশতাক গং এবং আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে ১৫ আগস্টের (১৯৭৫ সাল) পূর্বে যোগাযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। তা কি ছিল? সত্য উদঘাটনে এ বিষয়টা তলিয়ে দেখা জরুরি।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন