বর্তমান বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যাসিবাদের আলোচনা বেশ প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ফ্যাসিবাদের নানা দিক নিয়ে শুরু হয়েছে জোর আলোচনা। ফ্যাসিবাদকে প্রথম সংজ্ঞায়িত করেছেন মার্ক্সবাদীরা। তাদের মতে, ফ্যাসিবাদের উত্থান হয় বিকশিত পুঁজিবাদের সংকটের সময়। আমরা সাধারণত কোনো স্বৈরশাসক সরকারকে ফ্যাসিস্ট আখ্যা দিয়ে থাকি। এ ধারণা সঠিক নয়। স্বৈরশাসন ও ফ্যাসিবাদ এক নয়। এ দুয়ের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্য বুঝতে পারলে ফ্যাসিবাদের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের বুঝতে সহজ হবে। স্বৈরশাসকদের কোনো মতাদর্শ থাকে না। অন্যদিকে ফ্যাসিবাদীরা একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শের দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় আসে এবং দীর্ঘদিন টিকে থাকার চেষ্টা করে। এ লক্ষ্যে প্রথমেই তারা জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে। এতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টিকে থাকা তাদের জন্য সহজ হয়। এ লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি এবং বাকি সবাইকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে। পাশাপাশি তারা আয়নাঘর সৃষ্টি, গুম, খুন, অপহরণসহ নিজেদের সব ধরনের অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, লুটপাট ও দুঃশাসনকে বৈধতা দেয়। ফ্যাসিবাদী শাসকরা স্বেচ্ছাচারিতা ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডকে কোনো অন্যায় বলে মনে করে না। এগুলোকে তারা ন্যায়সংগত বলেই মনে করে। ফলে তাদের মধ্যে কোনো অপরাধবোধ জন্মায় না এবং নিজেদের কখনো অপরাধী ভাবে না।
সব ফ্যাসিস্ট শাসকই নিজেকে জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে জাহির করেন। দলের মধ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন একচ্ছত্র আধিপত্য। দলে তিনি হয়ে ওঠেন এক ও অদ্বিতীয়। দলকে তিনি পরিণত করেন সরকারে আর সরকারকে পরিণত করেন অতিরাষ্ট্রে। নানারকম প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে এ ধারণা দেওয়া হয় যে, দেশ ও জাতির কল্যাণে তার কোনো বিকল্প নেই। তিনি ছাড়া রাষ্ট্রের সবকিছু অচল হয়ে যাবে, সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই যে কোনো মূল্যে তাকে টিকিয়ে রাখতেই হবে। ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন বাহিনীকে দলীয়করণের মাধ্যমে এজেন্ডা বাস্তবায়নের স্বার্থে ব্যবহার করে। আর নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য দলীয় সদস্যদের সমন্বয়ে একটি প্রাইভেট বাহিনী তৈরি করে। এই প্রাইভেট বাহিনী অনেকটা আধাসামরিক বাহিনীর মতো কাজ করে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল হেলমেট বাহিনী। তাদের কাজ হলো মতাদর্শের বিরোধীদের দমন করা, প্রয়োজনে একে একে খতম করা।
ইতালি ও জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ ক্ষমতায় এসেছিল তৃতীয় বিকল্প হিসেবে। সেখানে ফ্যাসিবাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দুটি শক্ত মতাদর্শ ছিল। এর একটি হলো উদারনৈতিক পুঁজিবাদ, অন্যটি মার্ক্সবাদ। অন্যদিকে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের উত্থান হয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিকল্প হিসেবে, গণতান্ত্রিক শক্তির ছদ্মাবরণে, উন্নয়ন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সামনে রেখে। বিশ্বের ফ্যাসিবাদী শাসকদের অধিকাংশেই ছিলেন জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক। অন্যদিকে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী শাসক ছিলেন আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের তাঁবেদার। তাদের এ বৈশিষ্ট্য তারা কখনো গোপন করেননি। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা প্রকাশ্যেই বলেছেন, ...‘দিল্লি আছে, আমরা আছি...।’ ফলে ছাত্র-জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানের পর স্বাভাবিকভাবেই শেখ হাসিনাকে আমরা ভারতে পালিয়ে যেতে দেখলাম।
শেখ হাসিনা এবং তার কাছের মানুষদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর একটি প্রমাণ হলো, হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘বেগমপাড়া’ তৈরি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষ দখলের পর ২০০ বছরে যে পরিমাণ সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার করেছিল, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার চেয়েও বেশি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন।
সাধারণত ধরা হয় ফ্যাসিবাদ মানেই একটা হিংসাশ্রয়ী ব্যবস্থা। এটাও ভুল ধারণা। ভুল এই অর্থে যে, ফ্যাসিবাদ শুধু হিংস্রতাকে প্রবলভাবে প্রশ্রয়ই দেয় না, এর পাশাপাশি হিংস্রতাকে তারা বৈধতা বা মান্যতা দেয়। দলের অনুসারীদের মধ্যে ক্রমাগত হিংসার চেতনাকে সঞ্চিত করা হয়। এতে একপর্যায়ে দলের অনুসারীদের মধ্যে এ বোধের জন্ম নেয় যে, মানুষকে হিংসা করা, ঘৃণা করা কোনো অন্যায় কাজ নয়। এটাই স্বাভাবিক ও ন্যায়সংগত।
ফ্যাসিবাদী শাসকরা বরাবরই দেশপ্রেমের কল্পকাহিনি প্রচার করে সর্বগ্রাসী লুটপাটের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে, বিরোধী মতবাদকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে কারাগারে নির্যাতন করেছে। সেইসঙ্গে বাকি জনগোষ্ঠীর ওপর ভয়ের সংস্কৃতি জারি রেখেছে। এটাই হলো ফ্যাসিবাদীদের কৌশল। হয় তুমি আমার গুণগান করো, পা চাটো, তেল মারো, উচ্ছিষ্ট ভোগের অংশীদার হও, অন্যথায় তুমি দেশদ্রোহী, রাজাকার, জঙ্গি। এ দুয়ের মাঝখানে কোনো অবস্থানকে ফ্যাসিবাদীরা কখনো স্বীকার করে না। কেননা ফ্যাসিবাদের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বিরোধী মতের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতা। এই বিরোধী মতকে দমন করার সহজ ও বহুল ব্যবহৃত ফ্যাসিবাদী পন্থাটি হলো সরব বিরোধীদের গায়ে দেশদ্রোহীর ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া। শেখ হাসিনার বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তার জন্য শুধু প্রয়োজন রাজাকার ও জঙ্গি লিঙ্কের কোনো একটা অভিযোগ বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া। আর একে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রস্তুত ছিল ফ্যাসিবাদ সৃষ্ট গণমাধ্যম এবং একগুচ্ছ কালো আইন। কেউ মানবাধিকার নিয়ে সরব হলেই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রথম কাজ হলো যেনতেন প্রকারে তাদের রাজাকার ও জঙ্গিবাদী গন্ধ খুঁজে বের করা এবং তা দিয়ে তাদের দেশদ্রোহিতার মোড়কে মুড়ে ফেলা। রাষ্ট্রের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিবাদ করার মতো অদম্য সাহসী মানুষগুলোকে দমন করার এটাই হলো চিরাচরিত ফ্যাসিবাদী কৌশল। অথচ আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা যখন জামায়াতের সঙ্গে লিয়াজোঁ করেছেন, তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছেন, আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীকে সমর্থন করার জন্য শেখ হাসিনা যখন গোলাম আযমের কাছে দোয়া চাইতে গিয়েছিলেন, তাকে তসবিহ ও জায়নামাজ উপহার দিয়েছিলেন, তখন কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি! মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধ্বজাধারী হিসেবেই বহাল ছিলেন। অর্থাৎ কৃষ্ণ করিলে লীলা আর অন্যরা করিলে বিলা বৈকি!
আবার আওয়ামী লীগের নেতারা কিংবা শেখ হাসিনার নিকটজন যখন ব্যাংক দখল করেন, লুট করেন রিজার্ভ, কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে লুটে নেন হাজার হাজার কোটি টাকা, সর্বস্বান্ত করেন অগণিত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তৈরি করেন বেগমপাড়া, রাষ্ট্রীয় সম্পদকে পরিণত করেন ব্যক্তিগত সম্পদে, এক টাকার বিনিময়ে কিনে নেন গণভবন, তখনো তারা কিন্তু রাষ্ট্রশক্তির দম্ভে দেশপ্রেমিক হয়েই থাকেন! দুর্নীতিপরায়ণ, মাফিয়া বনে যান না।
শেখ হাসিনা মুখে অবিরাম মানবাধিকারের কথা বললেও রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হত্যাকে তিনি বৈধতা দিয়েছেন। তাকে অবহিত করা হয়েছিল ‘মানবতার মা’ হিসেবে। অথচ তিনি ‘আয়নাঘর’ তৈরি করে বহু নিরপরাধ মানুষকে অমানবিক নির্যাতনের নতুন নজির তৈরি করেছেন। গুম করেছেন শত শত মানুষকে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বৈধতা দিয়েছেন, আন্দোলন দমনে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করেছেন দ্বিধাহীনচিত্তে, অভ্যুত্থান দমনে নির্দেশনা দিয়েছেন হেলিকপ্টার দিয়ে গুলি করার।
আবার শেখ হাসিনা মুখে সবসময় অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের কথা বলেছেন আর এসব বক্তব্যের আড়ালে শুধু রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের তাগিদে মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়কে দুই জাতিসত্তায় বিভাজিত করেছেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর তিনি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। তবে সংখ্যালঘু নির্যাতন, তাদের ভিটেমাটি দখল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিমা ভাঙচুর ইত্যাদি মানবতাবিরোধী কাজে তার দলের কর্মী-সমর্থকরা অন্য দলের চেয়ে পিছিয়ে ছিল না।
রাজনৈতিক দলের পক্ষে অনেক সময় ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হয় না। এর বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজ অর্থাৎ ছাত্র-জনতাই যে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে এর বড় প্রমাণ চলতি বছরের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। তবে ফ্যাসিবাদ দমনের সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা হলো গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সব স্তরে জনপ্রতিনিধিদের শাসন নিশ্চিত করা। কেননা, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনেক দায়। এ দায় অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাকে প্রতিহত করে। নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করা হলে ধীরে ধীরে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে।
করোনা মহামারির সময় আমরা অনেকেই নতুন করে আলবেয়ার কাম্যুর ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসটি পড়েছি। সাহিত্য সমালোচকদের একাংশ এ উপন্যাসটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফ্রান্সে নাৎসি বাহিনীর রূপক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। প্লেগের জীবাণুকে আলবেয়ার কাম্যু ফ্যাসিবাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। উপন্যাসের শেষ কয়েকটি লাইনে তিনি বলেছেন, ‘বছরের পর বছর এই জীবাণু সুপ্ত থাকে আসবাবপত্রের মাঝে, কাপড়চোপড়ের বাক্সের ভেতর, ওতপেতে থাকে শোবার ঘরে, বড় বড় ট্রাঙ্ক, বইয়ের সেলফে। তারপর সেই দিনটি আসে, যেদিন এই জীবাণু সর্বনাশ এবং শিক্ষার জন্য আবার তার ইঁদুরগুলোকে জাগিয়ে উত্তেজিত করে মরবার জন্য। ঝাঁকে ঝাঁকে ওদের পাঠিয়ে দেয় আনন্দমুখর কোনো শহরে।’ অতএব, সাধু সাবধান!
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক