অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৪, ০২:৩১ এএম
আপডেট : ২৮ আগস্ট ২০২৪, ০৮:০৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শিল্প-সংস্কৃতির মুক্তিতেই উদ্ধার

শিল্প-সংস্কৃতির মুক্তিতেই উদ্ধার

‘স্বাধীনতা হলো জীবনে আমাদের নিজস্ব পথ বেছে নেওয়ার এবং কোনোরকম ভয় বা অনুশোচনা ছাড়াই বাঁচার শক্তি।’ স্বাধীনতা ও জীবনের মাঝে সেতুবন্ধন না হলে কী হয় বা হতে পারে—তা এখন আর আমাদের অজানা নয়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতার বয়স ৫৩ বছর। কম কিছু নয়। কিন্তু এ বয়সে সে সবচাইতে যেটা হারিয়েছে—তা হচ্ছে শিল্প স্বাধীনতা।

ভারী কথা নয়, সহজভাবেই বলা যায়। এরশাদের আমলেও আমাদের দেশে কথা বলার স্বাধীনতা ছিল। এরশাদ সেনা শাসক। এরশাদ রাজনীতি বুঝতেন না। দেশের শাসনভার নেওয়ার পর রাজনীতি করলেও তার আমলে কথা বলা যেত। গোপনে বা লুকিয়ে হলেও মানুষ তখনকার যায়যায় দিন আর দেশবন্ধু নামের ম্যাগাজিন পড়ার জন্য পাগল হয়ে থাকত। মিলার গল্পে শফিক রেহমান যুবক হৃদয় জয় করেছিলেন। ভাবা যায়—এরশাদকে লে জে হোমো এরশাদ পর্যন্ত ডাকা যেত। মাঝেমধ্যে পুরোনো লেখাপত্র ঘাঁটলে দেখি এরশাদ আর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যা ইচ্ছে লিখতাম আমরা। সিনিয়র কলামিস্টরা নানা নামে ব্যঙ্গ করে ডাকা থেকে হেন কিছু নেই, যা বলতেন না। তার পরও লেখনী থামেনি।

কুড়ি বছর আগেও আমাদের দেশে পাড়া-মহল্লায় খেলাঘর কচিকাঁচার আসর চাঁদের হাট ছিল। এসব শিশু-কিশোর সংগঠন এখনো আছে। তবে ইটচাপা ঘাসের মতো হলুদ ও বিবর্ণ। পথ নাটকের নামে রাস্তাঘাট মাতিয়ে রাখা সব নাটকের কোয়ালিটি ভালো ছিল বলা যাবে না। কিন্তু ধারাটা সচল ছিল। শক্তিশালী ছিল। একটা কোনো অন্যায় বা অঘটন ঘটলেই মানুষ পথে নামত। হাতিয়ার ছিল গান, নাচ, পথনাটক। আমি দেশ ছাড়ার বছরেই একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ আসে দেশ শাসনে। তাদের কোনো সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার দরকার পড়েনি আমার। চাইওনি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখলাম, সংস্কৃতি ক্রমেই শক্তিহীন হয়ে পড়ছে। দেশে একটি প্রগতিশীল ধারা বজায় থাকা জরুরি হলেও তা ছিল না। গত পনেরো বছরে দেশের বিশিষ্টজনের চেহারা ভুলে গিয়েছিল মানুষ। না ছিল কোনো যোগাযোগ, না কোনো প্রতিবাদ।

সবাই মিলে তুষ্ট করা আর তুষ্ট রাখার এক অসম প্রতিযোগিতায় মানুষ দেখল—যাদের তারা সম্মান করত, মেরুদণ্ডওয়ালা বলে জানত, তারা কেমন অমেরুদণ্ডী প্রাণীতে পরিণত হয়ে গেলেন। মানুষ বুঝে ওঠার আগেই দ্রুত বিলুপ্ত হতে শুরু করল সংস্কৃতি। আপনি যদি ভালো করে তাকান দেখবেন, দেশের সব জায়গায় ধীরে ধীরে গান-বাজনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রেডিও টিভিতে নামকাওয়াস্তে দু-একটি অনুষ্ঠান ছাড়া বাদবাকি সব ছিল টকশোর নামে অপপ্রচার। এগুলোতে সরকার ও সরকারবিরোধী উভয় দল কথা বললেও ছিল নিয়ন্ত্রণ। স্বাধীনতার সবচাইতে বড় দুশমন হচ্ছে ভয়। সে ভয়টা বুকের ওপর চেপে বসতে বসতে এমন হয়ে গিয়েছিল যে, নামকরা বুদ্ধিজীবীরা সবাই ক্রমেই উধাও হতে লাগলেন। যারা থাকলেন তাদের দেখলে গোপাল ভাঁড়ের চাইতে ভালো কিছু মনে হতো না মানুষের।

রাষ্ট্রটি যদি গণতন্ত্র নামক স্তম্ভের ওপর বহাল হয়, তাহলে এ দেশের নাগরিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলতে পারবে, সমালোচনা করতে পারবে, ভিন্নমত পোষণ করতে পারবে, মনের মধ্যে যে ভাবধারা আঁকুপাঁকু করতে থাকে, তা প্রকাশ করতে কোনোরূপ বাধাগ্রস্ত হবে না। মানুষ বিবেকসম্পন্ন সচেতন প্রাণী। নিজের মনের কথা, প্রাণের কথা প্রকাশ করতে গিয়ে যদি কেউ কথা হারিয়ে ফেলে, তাহলে বুঝতে হবে শক্তিধররা দৈত্যের মতো তার বুক চেপে ধরে বসে আছে।

এহেন বাস্তবতায় নিস্তেজ হতে থাকা বাকস্বাধীনতা আর শিল্প একসময় রোগী হয়ে উঠেছিল। সবাই জানত কী বলতে হবে, কতটা বলতে হবে। ইতিহাস বলছে, দেশে দেশে যুগে যুগে মানুষকে স্তব্ধ করার জন্য কিছু জুজুর দরকার পড়ে। আমাদের বেলায়ও সেটা হয়েছিল। উগ্রতা নৈরাজ্য বিকল্পহীনতার জুজু এসে কেড়ে নিত মানুষের ঘুম। ধীরে ধীরে তোতা পাখির মতো বুলি আওড়াতে আওড়াতে মানুষ ভুলেই গেল যে, তারা কথা বলতে জানে। এতে তোতার মালিক খুশি বটে; কিন্তু সংস্কৃতি নীরবে মৃত্যুর দিন গুনতে শুরু করে দিয়েছিল।

সংস্কৃতি না থাকলে দেশ ধনী হতে পারে কিন্তু জাতি কখনো ধনী বা সমৃদ্ধ হতে পারে না। মধ্যপ্রাচ্য বা এশিয়ার কয়েকটি দেশ এখন ইউরোপের বেশ কিছু দেশকে কিনে নিতে পারে। তার মানে কী এই যে, তারা ইউরোপের চাইতে সভ্য? সভ্য না এই কারণে ইংল্যান্ড ফ্রান্স বা জার্মানি স্পেনের মতো দেশ মানেই সংস্কৃতি। ইতালি গ্রিস এরা না থাকলে তো দুনিয়ার ইতিহাসই থাকে না। এটাই হচ্ছে শিল্প-সংস্কৃতির শক্তি। খেয়াল করবেন, এতগুলো বছরে কোনো কবি সাহিত্যিক নাট্যকার বা সৃজনশীল মানুষ আসেননি যিনি এসে চমকে দিতে পারতেন। ধারা চলছিল, সে ধারায় আবর্জনার মতো কত কবি কত লেখক। সবাই এক বিষয়ে এক মানুষকে নিয়ে স্তুতি করতে করতে একসময় তারা বুঝলেন যে, তাদের শক্তি শেষ। কিন্তু কারও দরকার পদ কারও পদবি। সংস্কৃতি যখন পদকবন্দি তখন আর কাজী নজরুলের জায়গা কোথায়? তখন রবীন্দ্রনাথ-লালন আক্রান্ত হবেন—এটাই তো স্বাভাবিক।

কাজী আবদুল ওদুদ আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন; কাজী আবদুল ওদুদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘কিন্তু এ সমস্যা কি বিশেষভাবে আজকার? অসভ্য যুগ, অর্ধ সভ্য যুগ, ধর্মতান্ত্রিক যুগ, সামন্ততান্ত্রিক যুগ, কোন যুগে ব্যক্তি নগণ্য ছিল না? অবশ্য বহু অতিমানব এসব যুগে জন্মেছিলেন। বিস্ময়কর হয়েছিল তাদের প্রভাব। কিন্তু সে প্রভাবও প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তির প্রভাব নয়, বিশেষ বিশেষ ভাবের বা ভাবধারার প্রভাব-অতিমানবে তা হয়েছিল মূর্ত। অতিমানবদের সাধারণত মানুষই ভাবা হয়নি। তাদের মানুষ ভাবা হয়েছে তখন, যখন তাদের বহু ত্রুটি অনেকের বুদ্ধিতে ও বিচারে ধরা পড়েছে। তখন অতিমানবের পদ তারা হারিয়েছে—অন্তত এসব বিচারক ও তাদের অনুবর্তীদের চোখে। অতিমানবরা যে যুগে অতিমানবত্ব হারালেন, সেই অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীই এক হিসেবে ব্যক্তিস্বাধীনতার যুগ। কিন্তু সেই ব্যক্তিস্বাধীনতাও অচিরে কলুষিত হলো কাঞ্চনকৌলীন্যে ও স্বেচ্ছাচারে। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি বা শ্রেণির সেই কাঞ্চনকৌলীন্য আর স্বেচ্ছাচারের প্রতিক্রিয়াই তো জন্ম হয়েছে এ কালের নির্ধনদের সামগ্রিকতার আর জাতীয় সামগ্রিকতা।’

শিল্প-সংস্কৃতিকে দুর্বল করলে বা বাক্সবন্দি করলে একসময় তা প্রভুর বিরুদ্ধে চলে যায়। তার আর কোনো শক্তি থাকে না কাউকে বাঁচাবার। সুযোগ এসেছে শিল্প সংস্কৃতিকে নতুনভাবে চেনা ও জানার। বাঙালির আদি ও অকৃত্রিম এই শক্তির উদ্বোধন হোক। তাতেই মঙ্গল।

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভূমিকম্পে কাঁপল রংপুর 

ব্যারিস্টার সুমনকে লক্ষ্য করে ডিম নিক্ষেপ

বাঁচানো গেল না সেই রিমিকে

কিমকে সিংহ উপহার দিলেন পুতিন

ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজে নিউট্রিশন ক্লাব প্রতিষ্ঠিত

আলু বীজের চড়া দামে দিশাহারা হাওরের চাষিরা

ট্রাম্প প্রশাসনে বড় দায়িত্ব পেলেন মুসলিম চিকিৎসক

ধামরাইয়ে পোশাক শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ

নির্বাচন কমিশন গঠন

আরশের সঙ্গে জুটি ভাঙার কারণ জানালেন তানিয়া 

১০

রোনালদোর ‘ইন্টারনেটে ঝড় তোলা’ অতিথির নাম প্রকাশ্যে

১১

সিইসি হলেন সাবেক সচিব নাসির উদ্দীন

১২

নোবিপ্রবির ১২ বিভাগে শিক্ষক সংকট চরমে

১৩

রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের অবরোধ, দুর্ভোগ চরমে

১৪

গাজা যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব : যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো, শান্তির পথে বাধা

১৫

রাসিকের ১৬১ কর্মীকে অব্যাহতি, ৩৮ জনকে শোকজ

১৬

ড. ইউনূসের নামে করা ৬ মামলা বাতিল

১৭

মোটরসাইকেল চাপায় মা-মেয়ে নিহত

১৮

পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে সার্বিয়ার ভয়ংকর বার্তা

১৯

ইউক্রেনে পুনরায় চালু মার্কিন দূতাবাস

২০
X