গত ৪৫ বছরে বাংলাদেশে ইতিহাস সবচেয়ে বড় বন্যাটি হয় ১৯৮৮ সালে। এরপর ১৯৯৮ সালে এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে। এই বন্যাগুলো এবং এর পূর্ববর্তী তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আবহাওয়াবিদরা দেখেছেন, বাংলাদেশে বন্যার সঙ্গে ‘এল-নিনো’ এবং ‘লা-নিনা’-এর একটি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। যদি পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির তাপমাত্রা গত ৩০ বছরের গড় তাপমাত্রার থেকেও ০.৫ সেন্টিগ্রেডের বেশি হয়, সেটাকে বলা হয় এল-নিনো অবস্থা। আর এটা যদি ০.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কম হয়, সেটাকে বলা হয় লা-নিনো অবস্থা। দেখা যায়, দুই থেকে সাত বছর পরপর একবার করে এল-নিনো ঘটে।
১৯৮৭ সালে খুবই শক্তিশালী এল-নিনো ঘটেছিল এবং এর পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হয়। ১৯৯৮ ও ২০১৬ সালের বন্যার আগেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। গত ৫০ বছরের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শক্তিশালী মাত্রার এল-নিনো ঘটেছে গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে। এবং এরপরই এ বছর বাংলাদেশ ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা দেখতে পাচ্ছি আমরা।
সর্বশেষ আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত তথ্যে আমেরিকার আবহাওয়া সংস্থা ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড এটমোসফেরিক অর্গানাইজেশন জানায়, পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে এখন নিরপেক্ষ অবস্থা বিরাজ করছে। যেহেতু কিছুদিন আগেই মারাত্মক শক্তিশালী এল-নিনো ঘটেছিল সুতরাং এবার বাংলাদেশে বড় আকারের বন্যা হতে পারে সেটা আগে থেকেই অনুমেয় ছিল। আমি কয়েক মাস আগে থেকেই পূর্বাভাস বলেছি, এবছর বাংলাদেশ স্বাভাবিকের থেকে বড় আকারের বন্যা হবে। আমি বারবার সতর্ক করার চেষ্টা করেছি; কিন্তু আমার কথা শোনা হয়নি। বাংলাদেশে বন্যা হতে যাচ্ছে, এটা এক প্রকার নিশ্চিত ছিল।
ফেনি, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলে এবারের অতিভারি বৃষ্টি এবং এই ভয়াবহ বন্যার পেছনে মূলত চারটি কারণ দায়ী। এগুলোকে বলা হয় আবহাওয়া সম্পর্কিত সূচক। প্রথমটি হচ্ছে, বাংলাদেশের ওপর মৌসুমি লঘুচাপটি স্থায়ী হয়ে থাকা। এ লঘুচাপটি বুধবার (২১ আগস্ট) বিকেলেও চট্টগ্রামের অংশে অবস্থান করছিল, যা পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছিল না। এর প্রভাবে দেশের অধিকাংশ এলাকায় বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
দ্বিতীয়ত, বর্তমানে খুবই শক্তিশালীভাবে ম্যাডেন-জুলিয়ান অসিলেশন (এমজেও) বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। যে কারণে নিয়মিত গরম ও জলীয় বাষ্পসহ আর্দ্র বাতাস তৈরি হচ্ছে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে, যা প্রবাহিত হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের এই উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে। যদি শুধু বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প আসে তাহলে সেটা মারাত্মক হয় না। তবে যদি একই সময়ে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প বাংলাদেশের ওপর আসতে থাকে, তবে সেটা সর্বোচ্চ পরিমাণ বৃষ্টিপাত ঘটায়। এবারও তেমনটাই ঘটেছে। একই সময়ে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর থেকে আর্দ্র বাতাস বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চলের পাহাড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পুরো অঞ্চলজুড়ে ব্যাপক বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে।
তৃতীয়ত, ‘জেট স্ট্রিম’ এখন মধ্য এশিয়ার উপরিভাগে অবস্থান করছে। যে কারণে বৃষ্টিপাত হচ্ছে ভারতসহ বাংলাদেশে।
চতুর্থত, ভারত থেকে আসা পানি ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলে বন্যা ভয়াবহ রূপ নেওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ। তবে ভারত বাঁধের পানি ছেড়ে দেওয়ায় বাংলাদেশে বন্যা হয়েছে এই কথাটি পুরাপুরি সত্য নয়। ভারতের ডম্বুর বাঁধ যদি হঠাৎ খুলে দেওয়া হয় তাহলে আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ত্রিপুরার নিম্নাঞ্চল। পুরো অঞ্চলে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের ফলে আগে ত্রিপুরা বন্যা কবলিত হয়েছে এবং ঢালুপথে সেই পানি বাংলাদেশেও প্রবেশ করেছে। একই সঙ্গে ভারতের উঁচু ভূমি থেকে নেমে আসা পানি এবং বাংলাদেশের ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা অঞ্চলে হওয়া ব্যাপক বৃষ্টি, দুইয়ে মিলে এই অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করেছে।
প্রথম তিনটি কারণ একই সঙ্গে ঘটলে তখন ওই এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যায় এবং এর ফলে পাহাড়ি ঢল ও বন্যার সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালের জুন মাসে দেশে এই তিনটি কারণ একই সঙ্গে ঘটেছিল এবং এর কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম। যার ফলে সেই বছর চট্টগ্রামে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয় এবং পাহাড় ধসে মারা যায় শতাধিক মানুষ।
বাংলাদেশে এবারের এই ভারি বৃষ্টিপাতের ঠিক আগে আগে একটি লঘুচাপের সৃষ্টি হয়। গত ১৪ আগস্ট তারিখে এ লঘুচাপটি বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলে পৌঁছায়। আমি আমার আবহাওয়া বিষয়ক ওয়েবসাইটে সেই ১৪ তারিখ থেকেই বারবার পূর্বাভাস দিয়ে আসছি। ১৬ তারিখে লঘুচাপটি বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলে প্রবেশ করে। অথচ এ লঘুচাপটি নিয়ে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদরা ক্রমাগত মিথ্যা তথ্য প্রদান করছে। তারা গণমাধ্যমে সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে। তারা সময়মতো এই সিচুয়েশনের তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
আমার ওয়েবসাইটে আমি সচিত্র বর্ণনা করে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তথ্য আপডেট করে দেখিয়েছি। আমি বাংলাদেশে বড় ধরনের বন্যা হতে পারে তার আগাম সতর্কতা জানিয়েছি। কিন্তু আমার বার্তা বাংলাদেশের আবহাওয়া দপ্তর নেয়নি। ১৪ আগস্ট লঘুচাপটি উপকূলে পৌঁছায় এবং ১৬ তারিখে সেটি খুলনা এবং বরিশালের ওপরে বৃষ্টি শুরু করে। ১৭ ও ১৮ তারিখে এর অবস্থান ছিল বরিশাল, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনীসহ এই অঞ্চলে। আমি ১৬ তারিখ থেকে প্রত্যেক দিনের প্রতিটা পূর্বাভাসে বলেছি বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা অঞ্চল এবং ভারতের ত্রিপুরায় ভারি বৃষ্টিপাত হবে।
১৯ তারিখে এ লঘুচাপটি পৌঁছায় চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরার ওপরে। সেদিন থেকেই ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হয়। এবং এর পরের কয়েকদিন এই ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকে। আর এর ফল আমরা সবাই জানি। ম্যাডেন-জুলিয়ান অসিলেশন আমরা ত্রিশ থেকে চল্লিশ দিন আগে থেকেই পূর্বাভাস করতে পারি। আর এটা যে শক্তিশালী হবে, তা ১৫ দিন আগে থেকেই স্পষ্ট ছিল। অর্থাৎ ভারি বৃষ্টিপাত একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল না।
এখন আমার প্রশ্ন, আমি যেহেতু পূর্বাভাস দিতে পেরেছি আমাদের বাংলাদেশের আবহাওয়া দপ্তর কেন পূর্বাভাস দিতে পারেনি? যেখানে লঘুচাপ এবং বিশাল এরিয়ায় মেঘসহ বাতাসের ঘূর্ণনটা কৃত্রিম উপগ্রহের প্রতি ১০ মিনিট পরপর দেখা যাচ্ছে সেই জিনিসটা তারা দেখতে পেলেন না কেন? তারা কি এই সময়ে তাদের কম্পিউটারের সামনে বসেননি? তারা কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন? আমি এটা তাদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই।
লেখক: আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক, স্কুল অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সাস্টেইনিবিলিটি, সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়, সাসকাটুন, কানাডা