মালিহা নামলাহ
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৪, ০২:৫৬ এএম
আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২৪, ০৪:৪৪ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জাহাঙ্গীরনগরে ১৫ জুলাই রাতে কী ঘটেছিল?

১৫ জুলাই রাতে জাহাঙ্গীরনগরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলে পড়ে ছাত্রলীগ। ছবি : সংগৃহীত
১৫ জুলাই রাতে জাহাঙ্গীরনগরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলে পড়ে ছাত্রলীগ। ছবি : সংগৃহীত

১৫ জুলাই জাহাঙ্গীরনগরে যেন এক কালরাত নেমে এসেছিল। ১৫ জুলাই রাত ও ১৬ জুলাই প্রথম প্রহরে যে নারকীয় তাণ্ডব চলেছে ক্যাম্পাসে, অন্য কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে এর তুলনা চলে না। সেদিন সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে পৌঁছে শুনি, কোটার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মিছিলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করেছে। কয়েক দফা হামলার শিকার হয়ে সবাই জড়ো হয়েছেন শহীদ মিনারে। মাথায় গুরুতর আঘাত, হাতে বা পায়ে জখম নিয়ে অনেকেই চিকিৎসাকেন্দ্রে এসেছেন। হামলার হাত থেকে রেহাই পাননি নারী শিক্ষার্থীরাও। গুরুতর আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে সাভারে। যারা হামলা চালিয়েছে তারা হয়তো আমারই ভাই-বন্ধু বা সহপাঠী। ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ জানানো তো দূরের কথা, আমরা নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়েও তখন শঙ্কিত।

নিরাপদে হলে ফেরার দাবিতে মিছিল নিয়ে আমরা উপস্থিত হই উপাচার্যের বাসভবনের সামনে। ঘণ্টাখানেক সেখানে বসে থাকার পর উপাচার্য বেরিয়ে আসেন। উপাচার্যের বক্তব্য, ‘আমরা দ্রুতই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ তার সঙ্গে প্রভোস্ট কমিটির অধিকাংশ সদস্যই উপস্থিত ছিলেন। তার কাছে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ জানান ও তাদের নিরাপত্তার হুমকির কথা জানান। উপাচার্য ১৫ মিনিটের মধ্যে আলোচনা করে এসে শিক্ষার্থীদের জানাবেন বলে ভেতরে যান। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করবেন বলে জানিয়ে দেন। এরই মধ্যে ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে গেলেও উপাচার্য আর বের হননি।

রাত ১১টার পর আমাদের কাছে খবর আসে, বঙ্গবন্ধু হলে গেস্টরুমে প্রভোস্টের উপস্থিতিতে মিটিং করে ছাত্রলীগ হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মোবাইলে ভিডিও মারফত খবর আসে, আশপাশের এলাকা থেকে পিকআপে করে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করছে। এদিকে, উপাচার্যের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অনেকেই তখন হতাশ। ধীরে ধীরে কমতে থাকে তাদের সংখ্যা। বাসভবনের সামনে মোটে ৫০-৬০ জন শিক্ষার্থী। উপাচার্য ও প্রক্টরকে আমরা বারবার অনুরোধ করতে থাকি নিরাপত্তা দিয়ে হলে দিয়ে আসার জন্য। কিন্তু একরকম নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন তারা।

একদিকে ছাত্রলীগের হামলার প্রস্তুতি, অন্যদিকে প্রশাসনের নির্লিপ্ততা। শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নেন, হামলা হলে তারা জীবন বাঁচাতে উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে ঢুকে যাবেন। সন্ত্রাসীরা আর যা-ই করুক, উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে ঢুকে হামলা চালাবে না—এটাই ছিল তাদের ধারণা।

রাত ঠিক ১২টায় ছাত্রলীগের বাহিনী এগিয়ে আসতে থাকে। কোনো স্লোগান নয়; একেবারে নিঃশব্দে এগিয়ে আসতে থাকে হায়নাদের বাহিনী। তাদের সবার মাথায় হেলমেট, হাতে হকিস্টিক বা লাঠি, কয়েকজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। গতানুগতিক মিছিল বা হামলার মতো নয়, তারা এগিয়ে আসতে থাকে ক্যাম্পাসের ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম হামলার পরিকল্পনা নিয়ে।

ছাত্রলীগ খুব কাছাকাছি চলে এলে গেট খুলে প্রাণভয়ে শিক্ষার্থীরা ঢুকে পড়েন উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে। গগনবিদারী হুংকার দিয়ে তারা স্লোগান দিতে শুরু করে। তাদের চোখে-মুখে তখন স্পষ্ট জিঘাংসা, মুখে স্লোগান—‘ধইরা ধইরা জবাই কর’। প্রাণভয়ে বাসভবনের ভেতরে শিক্ষার্থীরা তখন প্রতিরোধের চিন্তা বাদ দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছেন। উপাচার্যের বাসভবনের শক্ত দরজা ধাক্কা দিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।

একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা বাসভবনের ভেতরে কাচের বোতল ছুড়ে মারতে থাকে। ভিসির বাসার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন সাবেক প্রক্টর ফিরোজ-উল-হাসান, অধ্যাপক বশির, অধ্যাপক শাহেদ রানাসহ ৪-৫ জন শিক্ষক। বাইরে থেকে ছোড়া কাচের বোতল, বেপরোয়া ইটপাটকেল তাদের গায়েও পড়ে। শিক্ষার্থীরা তাদের কাছে নিরাপত্তার জন্য আবেদন জানাতে থাকেন।

খানিক বাদে পুলিশ আসে। আমাদের মনে এবার আশার সঞ্চার হয়, ভাবে পুলিশ হয়তো সন্ত্রাসীদের হাত থেকে তাদের নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু পুলিশ এসে সোজা ভিসির বাসায় প্রবেশ করে। ভেতরে কী আলোচনা হয় তাদের মধ্যে, বাইরে বেরিয়ে তারা ঠায় দাঁড়িয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে হলে দিয়ে আসুন।’ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তাদের নির্লিপ্ততা দেখে বোঝার বাকি থাকে না তাদের পরিকল্পনা কী!

সাবেক প্রক্টর ফিরোজ ও অধ্যাপক বশির এ সময় প্রস্তাব নিয়ে আসেন, মেয়েদের পুলিশের গাড়িতে নিরাপত্তা দিয়ে আসা হবে। সবাই বুঝতে পারে, মেয়েদের পাঠিয়ে দিয়ে ছেলেদের লাশ ফেলে দিতেও সন্ত্রাসীরা কুণ্ঠাবোধ করবে না। মেয়েরা সবাই জোর গলায় বলেন, ‘আমরা গেলে একসঙ্গেই যাব, ভাইদের ফেলে আমরা যাব না।’

উপাচার্যের বাসভবনের আঙিনায় ঘাসের ওপর সবাই বসে পড়েন। ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত আর ক্লান্ত অবস্থায় শিক্ষার্থীদের সবার চোখে-মুখে তখন মৃত্যুভয়। উপরন্তু ছাত্রলীগের সন্ধ্যার আক্রমণের কারণে অনেকেই তখন গুরুতর আহত। পুলিশের উপস্থিতিতেই বৃষ্টির মতো মুহুর্মুহু পড়তে থাকে কাচের বোতল, ককটেল, পেট্রোল বোমা।

একপর্যায়ে গেট ভেঙে ভেতরে ঢোকে সন্ত্রাসীরা। এ মুহূর্তে যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে একজন ফেসবুক লাইভে আসে। উপাচার্যের বাসভবনের বারান্দায় জড়োসড়ো হয়ে আর্তচিৎকার করতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। গেটের ভেতরে মাত্র ৭-৮ হাত দূরে তখন তাদের অবস্থান। তাদের হাত থেকে বাঁচাতে মেয়েদের সবাইকে মাঝে রেখে ঢাল হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে যান ছেলেরা। সন্ত্রাসীদের অনেকেরই মুখ ঢাকা, হাতে চাপাতিসহ ধারালো অস্ত্র। এভাবে পেরিয়ে যায় অনেকটা সময়। চাপাচাপিতে তখন সবার দমবন্ধ অবস্থা।

ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আশ মিটিয়ে হামলা চালিয়ে নেওয়ার পর পুলিশ এসে তাদের আপাতত বাইরে বেরিয়ে যেতে বলে। ‘জনগণের বন্ধু পুলিশে’র এমন ভূমিকায় অবাক হওয়ার শক্তিটুকুও তখন অবশিষ্ট নেই। তারা বেরিয়ে যাওয়ার পরও কেউ উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না। দরজার সামনে সাদা টাইলসের ফ্লোর তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। চাপাচাপিতে কারও ভালোভাবে নিঃশ্বাস নেওয়ার উপায় নেই। সবার জামা রক্তে ভেজা! অনেকেরই হাত-পা, মাথা, পিঠ ফেটে গেছে। কার গায়ের রক্তে কার জামা ভিজে গেছে, তা বোঝার উপায় নেই।

রাত তখন প্রায় ৩টা। উপাচার্যের বাসভবনের একপাশ থেকে হামলার পর এবার রাস্তার পার্শ্ববর্তী গেট থেকেও হামলা শুরু হয়। একপর্যায়ে আমরা বুঝতে পারি, বাইরে থেকে সাহায্য না এলে এদের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা যাবে না। ততক্ষণে সব হল থেকে আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে সবাই বেরিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো ক্যাম্পাস থেকে জড়ো হয়ে সাহায্যে এগিয়ে আসে প্রায় হাজারখানেক শিক্ষার্থী। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বা পুলিশের পক্ষে সে জনস্রোত সামলানো ছিল খুবই কঠিন।

উপাচার্যের বাসভবনের শক্ত দরজা তখনো বন্ধ। আমাদের শত অনুনয়, রাতভর হামলা, আর্তচিৎকার কোনো কিছুই তার মনকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ ঘোষণা করে বলে, ‘এখানে কিছুতেই থাকা যাবে না।’ যে পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে ছাত্রলীগকে হামলার সুযোগ করে দিয়েছে, এখন তারাই বলছে, ‘আপনাদের নিরাপত্তার স্বার্থে আপনারা বাসভবন ছেড়ে চলে যান।’ জনগণের বন্ধুর কি উত্তম দৃষ্টান্ত!

উপাচার্যের বাসভবন থেকে শিক্ষার্থীদের বের করতে এবার পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়ে। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের আক্রমণের সময় কোথায় ছিল তাদের টিয়ার গ্যাসের শেল! রাতভর হামলার পর টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় শিক্ষার্থীদের অনেকেই তখন গুরুতর আহত। কয়েকজন জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন। ভেতরে অনেকেই আটকা পড়ে আছেন তখনো। পুলিশের টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় আহত বন্ধুদের নিয়ে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে আসে। প্রাণ হাতে নিয়ে যখন পরিবহন চত্বরে আসি তখন ফজরের আজান হচ্ছে। নির্ঘুম আর আতঙ্কে ভরা সে রাত যেন শেষ হয়ে আসছে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিন বছর পেরিয়ে গেছে। আন্দোলনের কারণে নানা ঘটনাবলির সাক্ষী হয়েছি। কিন্তু স্মৃতির পাতায় চিরদিন জাগরূক হয়ে থাকবে ১৫ জুলাই রাত। কি এক দুঃসহ সময় পেরিয়ে এসেছি আমরা! নির্ঘুম সেসব রাত পেরিয়ে মুক্ত বাতাসে স্বাদ নিতে পারছি—এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া।

মালিহা নামলাহ: শিক্ষার্থী, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ (সহ-সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উত্তাল সাগর, শূন্য হাতে ঘাটে ফিরছেন জেলেরা

ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ পারভেজ ৪০ দিন পর মারা গেলেন

কক্সবাজারে একদিনে রেকর্ড বৃষ্টিপাত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের হামলা

তিতুমীর কলেজে সমন্বয়ক পরিচয়ে রুম দখলের প্রতিবাদে মানববন্ধন

ড. ইউনূসের মেগাফোন কূটনীতিতে ভারতের অস্বস্তি

আওয়ামী নেতার সিনেমায় বুবলী, মুখ খুললেন নায়িকা 

অস্ত্র হাতে সেই লিটন গ্রেপ্তার

কমলার সঙ্গে আর বিতর্কে যাবেন না ট্রাম্প

চিরকুট ও কাফনের কাপড় রেখে প্রাণনাশের হুমকি

১০

অসুস্থ ফুটবলারের চিকিৎসায় পাশে দাঁড়ালেন তারেক রহমান

১১

ভারতে পাচারকালে কুমিল্লা সীমান্তে ফের ইলিশের চালান জব্দ

১২

সুনামগঞ্জ সীমান্তে সাড়ে ১৯ লাখ রুপিসহ যুবক আটক

১৩

দাবানলে পাল্টে যাচ্ছে আবহাওয়া, স্যাটেলাইটে ভয়ংকর দৃশ্য

১৪

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডিতে নতুন মুখ

১৫

শেখ হাসিনার নতুন ফোনালাপ, নিজেকে প্রধানমন্ত্রী দাবি

১৬

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে ৩ জনের মৃত্যু

১৭

৫০ হাজার কর্মীর পরিবার করুণ অবস্থায় আছে : আওয়ামী লীগ

১৮

সাতক্ষীরায় ১১টি সোনার বারসহ চোরাকারবারি আটক

১৯

আসছেন ডোনাল্ড লু / ঢাকাকে বিরক্ত না করতে দিল্লিকে দেবেন বার্তা

২০
X