মাছুম বিল্লাহ
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৪, ০২:০৮ এএম
আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০২৪, ০৯:২০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অটোপাসের সিদ্ধান্ত ভালো উদাহরণ নয়

অটোপাসের সিদ্ধান্ত ভালো উদাহরণ নয়

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে স্থগিত থাকা এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাগুলো বাতিল করা হয়েছে। সিলেট বোর্ড, মাদ্রাসা বোর্ড ও কারিগরি বোর্ড বাদে অন্য আটটি শিক্ষা বোর্ডে কোনো শিক্ষার্থীর সাতটি, আবার কোনো শিক্ষার্থীর আটটি পত্রের পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছিল। আটটি বোর্ডের পরীক্ষার্থীরা আবশ্যিক বিষয়ের পরীক্ষাগুলো দিয়েছে। আর ঐচ্ছিক বিষয়ের দুই-তিনটা পরীক্ষা দিয়েছে। ফলে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থীকে ১৩টি পত্রে পরীক্ষা দিতে হবে। এর মধ্যে আবশ্যিক তিনটি বিষয়ে পাঁচ পত্র আর চতুর্থ বিষয়সহ ঐচ্ছিক চারটি বিষয়ে আটটি পত্র। এইচএসসির একজন শিক্ষার্থীর আবশ্যিক পত্রগুলো হচ্ছে—বাংলা বিষয়ে দুই পত্র, ইংরেজি বিষয়ে দুই পত্র এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ে একটি পত্র। এইচএসসি ও সমমানের বাকি পরীক্ষাগুলো না দিয়ে পরীক্ষার্থীদের এক অংশ (পাঁচশ-ছয়শ শিক্ষার্থী) গত ১৯ আগস্ট সচিবালয়ে প্রবেশ করে এবং তার আগের দিন তারা ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করে। সচিবালয়ে ঢুকে বিক্ষোভ শুরু করে, সচিবালয়ের প্রবেশপথ আটকে দেয়। এতে জরুরি বৈঠকে বসেন শিক্ষা উপদেষ্টা। তারা প্রথমে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে প্রকাশ করা সূচি স্থগিত করে আরও দুই সপ্তাহ পরে স্থগিত পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর পরীক্ষার সময় ঠিক রেখে বাকি বিষয়গুলোর পরীক্ষা অর্ধেক প্রশ্নোত্তরে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তা না মেনে বিক্ষোভ করতে থাকে। আন্দোলনের একপর্যায়ে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করা হয়।

আমরা জানি যে, ২০২৪ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয় গত ৩০ জুন। কিন্তু সে সময় সিলেট বিভাগে বন্যা থাকায় ৮ জুলাই পর্যন্ত ওই বোর্ডের পাশাপাশি মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ওই তিন বোর্ডের পরীক্ষা শুরু হয় ৯ জুলাই। তারা যে চারটি আবশ্যিক পত্রের পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি, তা সব পরীক্ষা শেষে নেওয়ার কথা ছিল। ফলে বাকি আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে অর্ধেকের বেশি পরীক্ষা নেওয়া হলেও ওই তিন বোর্ডের শিক্ষার্থীরা তিন থেকে চারটি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে পেরেছে। শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কারণে ১৮ জুলাই, তারপর ২১, ২৩ ও ২৫ জুলাইয়ের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়। এরপর ২৮ জুলাই থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। পরে ১১ আগস্ট থেকে নতুন সময়সূচিতে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল, সেটিও স্থগিত করে ১১ সেপ্টেম্বর পরীক্ষা নেওয়ার সূচিও প্রকাশ করা হয়েছিল। এখন সবকিছুই বাতিল করা হলো।

এইচএসসি ও সমমানের বাকি পরীক্ষাগুলো বাদ নিয়ে ফল প্রকাশ কীভাবে করা হবে? এ নিয়ে শিক্ষা বোর্ড বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেবে বলে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন। আর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যে কটি বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছে, তার ভিত্তিতে এবং স্থগিত বিষয়ের পরীক্ষা এসএসসির সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে ম্যাপিং করে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার দাবি জানিয়েছেন। কভিড মহামারির কারণে ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত হয়নি এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। জেএসসির ২৫ শতাংশ ও এসএসসির ৭৫ শতাংশ ফলের ভিত্তিতে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এইচএসসিতে অটোপাসের ফল প্রকাশ করা হয়। ফল প্রকাশের জন্য মান বণ্টন, আইন সংশোধনসহ অনেক বিষয়ে তৎকালীন সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়ে। ফলে দেশজুড়ে সমালোচনাও তৈরি হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের বছরও কোনো পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি এবং স্বাধীনতার-পরবর্তী ক্লাসে অটোপাস দেওয়া হয়। এবার যারা ২০২৪ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বসেছিল, তারা ২০২২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। তবে ২০২০ সালে করোনার প্রাদুর্ভাবে এ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা ঠিকমতো ক্লাস করতে পারেনি। ফলে এসএসসিতে তাদের ১২টি বিষয়ের মধ্যে ৯টি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। বাকি তিনটি বিষয়ে বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়/সাধারণবিজ্ঞান, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ে আগের পরীক্ষার সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়েছে। অর্থাৎ এসএসসির ক্ষেত্রে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট, দাখিলের ক্ষেত্রে জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট এবং এসএসসি ও দাখিলের ক্ষেত্রে (ভোকেশনাল) নবম শ্রেণির ফলের ভিত্তিতে বিষয় ম্যাপিং করে নম্বর দেওয়া হয়েছে। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে অটোপাসের কালচার সেই কভিডের সময় শুরু হয় অথচ ওই সময়ও ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা বিশেষভাবে পরিচালনা করা হয়েছিল। কিন্তু সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের অটোপাস নামক পদ্ধতির মাধ্যমে পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়। সেই সমালোচনা এখনো পিছু ছাড়েনি, তার মধ্যে আবার অটোপাসের কালচার রিনিউ করা হলো!

এদিকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তকে ‘অযৌক্তিক’ বলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘যারা এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষা বাতিল চেয়েছেন তারা মেধার মূল্যায়ন করেন না। পরীক্ষা নেওয়া উচিত ছিল। এ সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক।’ পরীক্ষা বাতিল করার বিষয়কে কখনোই সমর্থন করেন না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা সচিবালয়ে শিক্ষা সচিব মহোদয় থেকে শুরু করে আমাদের সবাইকে অবরুদ্ধ করে। সেজন্য সচিব মহোদয় শিক্ষা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন। পরীক্ষা ছাড়া একজন শিক্ষার্থীকে কখনোই মূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। পরীক্ষাই হচ্ছে মেধা মূল্যায়নের একমাত্র মাধ্যম। এই যে পরীক্ষা ছাড়া মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে যারা প্রকৃত মেধাবী, যারা সারা বছর ধরে পড়াশোনা করেছেন, তাদের মূলত অনুৎসাহিত করা হলো। সুতরাং আমরা চাইব, আর কখনোই যেন এ ধরনের ডিসিশনের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’

আমরাও একমত পোষণ করছি হাসনাত আব্দুল্লাহর সঙ্গে কারণ এ পদ্ধতিতে প্রকৃত মেধাবীদের অসম্মান ও তাদের মেধার অবমূল্যায়ন করা হলো যেটি কখনো কাম্য হতে পারে না। কারণ শিক্ষার্থীদের মূল আন্দোলন ছিল মেধাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা। নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরাও বলেছে যে, তারা এ সিদ্ধান্ত মানে না। তারা বরং পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আন্দোলন করছে। পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। শিক্ষা ও শিশুরক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক রাখাল রাহা বলেন, ‘সারা দেশে ১৪ লাখের বেশি পরীক্ষার্থী আছে। এমন একটি সিদ্ধান্তের আগে সরকারের পক্ষ থেকে একটি জরিপ পরিচালনা করা উচিত ছিল। আহত শিক্ষার্থীদের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার চাইলে জেলা প্রশাসন এবং শিক্ষা বোর্ডগুলোর মাধ্যমে তাদের তথ্য সংগ্রহ করে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত; কিন্তু এভাবে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক হয়নি। এতে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে বিরূপ পরিস্থিতি হলেও সমাধান হিসেবে আবারও অটোপাসের দাবি আসার সম্ভাবনা রয়েছে।’

আমরা তার সঙ্গে একমত। কিন্তু অবস্থা যা দেখা গেল এবং উপদেষ্টাও বললেন, তাতে শিক্ষার্থীরা কিন্তু যৌক্তিক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় দেয়নি। তারা আশু লাভের আশায় নিজেদের জন্য সমালোচনা ডেকে আনল। এ ধরনের সিদ্ধান্তের জেরে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ শিক্ষা ও কর্মজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে এবং বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে।

উল্লেখ্য, ইংরেজি মিডিয়ামে যারা পড়াশোনা করছে তারা কিন্তু পরীক্ষা দিয়েই ‘এ’ লেভেল পাস করবে এবং বিদেশে উচ্চশিক্ষা কিংবা চাকরির ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে, যেখানে আমাদের অটোপাস করা শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে থাকবে। সামান্য এই আপাতলাভ তাদের ক্ষতি ডেকে আনবে। নতুন রুটিন প্রকাশের পর থেকেই শিক্ষার্থীদের একাংশ প্রতিবাদ শুরু করে। তাদের বক্তব্য ছিল, আন্দোলনে আহত অনেক শিক্ষার্থী এখনো চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছে এবং অনেকে মানসিকভাবে এর ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে সহপাঠীদের রেখে তারা বাকি পরীক্ষা দিতে চায় না এবং বিকল্প পদ্ধতিতে ফল চায়। এটি আসলে এক ধরনের খারাপ কালচার তৈরি করা হলো। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, আত্মত্যাগ ও বিশাল অর্জনকে আমরা সাধুবাদ জানাই, স্যালুট জানাই কিন্তু সামান্য লাভের আশায় বা সামান্য স্বার্থে সেটি কোনোভাবে যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, ম্লান হয়ে না যায় তাদের বিশাল অর্জন; সেটি জাতিকে যেমন দেখতে হবে, তেমনি শিক্ষার্থীদের বিষয়টিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

(সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজের শিক্ষক, চিফ অব পার্টি ব্র্যাক এডুকেশন এবং কান্ট্রি ডিরেক্টর-ভাব বাংলাদেশ)

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১০

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১১

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১২

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১৩

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৪

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১৫

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৬

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৭

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

১৮

‘এক ফ্যাসিস্টকে হটিয়ে আরেক ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না’

১৯

জুলাই বিপ্লবে আহত মুক্তিযোদ্ধার ছেলে বাবুকে নেওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ড

২০
X