সকালে বৃষ্টি দেখে মিউজিক ছেড়ে চুলায় খিচুড়ি ওঠায়। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয় কাব্যমাখা স্বস্তির স্ট্যাটাস। পরিবহন সংকটে নাকাল স্কুল-অফিসগামী মানুষ। সেটা দেখে বৃষ্টির সময়জ্ঞান নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়ে। দুপুরে কটকটে রোদ আর ভ্যাপসা গরমে বিরক্তির স্ট্যাটাস। বিকেলে জলজট, ট্রাফিক জ্যামে অফিসফেরতা মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে ফেসবুকে আহাজারি করে পোস্ট। ক্ষণে ক্ষণে মনের রং পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি প্রকাশ করে মানুষ। এটা শুধু আবহাওয়ার বেলায় নয়। রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতি; এমনকি চিরন্তন ঐতিহ্য ও ধর্মীয় বিষয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত চলে অস্থির বিতর্ক।
এটি শুধু নেটিজেনদের মধ্যে চলে তা নয়। পাড়ার চায়ের দোকান, গলির মুখ, গণপরিবহন, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, ক্লাবে অবিরত চলছে মুক্তবাক। গত দেড় দশকের পুঞ্জীভূত কথা-ব্যথা গলগল করে বেরিয়ে আসছে। গুম আতঙ্কে ভোগা স্বার্থপর করপোরেট ব্যক্তিটাও ডেকে ডেকে কথা বলছেন। ক্ষমতাসীন দলের সামান্য ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ভয়ে এতদিন মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেননি অনেক ফেবুবিপ্লবী। মহল্লার পাতি নেতাকে চাঁদা দিতে দিতে পুঁজি হারিয়ে বসা সবজি বিক্রেতাও এখন উপদেষ্টাদের ভুল ধরছেন অবলীলায়। বিষণ্ন হয়ে থাকা সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি থেকে টোকাই পর্যন্ত স্বাধীনতা ভোগ করছেন। তবে উন্মুক্ত জায়গায় আড্ডা দেওয়ার সময় অভ্যাসবশত কেউ কেউ আশপাশে তাকিয়ে নেন। তারা চান, লেখার স্বাধীনতা। কথা বলার সময় যেন চারদিকে তাকিয়ে ভয় তাড়াতে না হয়। তবে স্বাধীনতা নিশ্চিতের পাশাপাশি দায়িত্বশীল আচরণের বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিপ্লবী সরকারের সমর্থকরা।
হঠাৎ ভয় কেটে যাওয়ায় রাস্তায় নেমে এসেছেন দীর্ঘদিনের বঞ্চিত পেশাজীবীরা। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন থেকে শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, সচিবালয় সব জায়গায় অবাধ বিচরণ বিক্ষোভকারীদের। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সফলতা দেখে দাবি আদায়ে নেমেছেন তারা। জাদুর শহর এখন দাবির শহর। তাদের আর কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। এমন প্রত্যয়ে রাস্তা বন্ধ করে প্রায় প্রতিদিন ঢাকাবাসীকে যানজট উপহার দিচ্ছেন। অথচ কিছুদিন আগেও ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘শেখ হাসিনা’র ছবি এবং ‘উন্নয়নের স্লোগান’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দাবি আদায়ে বিনীত বিক্ষোভ করেছেন তারা। নিয়ন্ত্রিত প্রতিবাদ সমাবেশে সরকার বাহাদুরকে সমীহ করে ইনিয়ে-বিনিয়ে দাবি উত্থাপন করেছেন। দাবি পূরণের প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন দলের তৃতীয় শ্রেণির নেতার উপস্থিতি নিশ্চিতে কাকুতি-মিনতি করতে হয়েছে তাদের। কর্তৃত্ববাদী শাসকের এক দশক সহ্য হলেও অন্তর্বর্তী সরকারকে এক মাসও সময় দিতে চাচ্ছেন না তারা। তাদের এ বেপরোয়া কর্মসূচিকে অনেকে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন। এ প্রসঙ্গে শিক্ষার্থী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেই ফেলেছেন, ১৬ বছরের জঞ্জাল এত দ্রুত সমাধান সম্ভব নয়। বিক্ষুব্ধ, বঞ্চিতদেরইবা দোষ কী? তারা দেখছেন, অনেকে মিলে চাপ দিলে দ্রুতই দাবি আদায় হচ্ছে। যেমন, বিক্ষোভের মুখে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে না বলে কবুল করলেন সরকার। যদিও এ সিদ্ধান্ত সর্বজনীনতা পায়নি। শিক্ষার্থী আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ তার প্রতিক্রিয়ায় দ্বিমত জানিয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের এরকম প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করছেন সাধারণ মানুষ। আগে হস্তক্ষেপের সুযোগ ছিল না বলে হাত গুটিয়ে বসেছিলেন তারা। সাবেক স্বৈরশাসকের বানানো গল্প কেউ বিশ্বাস করত না। একসময় প্রতিবাদ করাও ছেড়ে দিয়েছিল। নিরাপদ বলয়ে ফিসফাস করে হাস্যরস করত সবাই। বিশেষ করে ক্রসফায়ার, আলোচিত গ্রেপ্তার, রিমান্ড, মামলাবিষয়ক সরকারি প্রেস রিলিজের স্ক্রিপ্ট দুর্বল ও একঘেয়ে হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। নাম গোপন রেখে বিশ্বস্ত সোর্স হিসেবে সরবরাহ করা রিমান্ড কাহিনি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতো। তবে লেখক-পাঠক কেউই এসব বিশ্বাস করে না। রহস্য গল্পের মজা নেয় সবাই। সম্প্রতি সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানসহ একাধিক ভিআইপির গ্রেপ্তারে সেই পুরোনো স্ক্রিপ্টই ব্যবহার করা হয়েছে বলে সমালোচনা হয়েছে। বিশেষ করে, রিমান্ডে আনিসের হাসি, পলকের কান্না। এ তথ্য শুনে জনতা বলে—আর না, আর না। এসব বিষয়ে মিল দেখে জনমনে প্রশ্ন জাগে, তবে কি তারাই বহাল রয়েছে? যারা হাসিনা সরকারকে ডুবিয়েছে?
গত আট দিনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিরুদ্ধে সারা দেশে অর্ধশতাধিক হত্যা মামলা হয়েছে। কোনোটি সরকার, কোনোটি ব্যক্তি বাদী হয়েছেন। হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, উসকানিসহ নানা অভিযোগে মামলা হয়েছে কয়েকশ। শেখ পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, বরখাস্ত জনপ্রতিনিধি, পতিত সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিসহ আসামি সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। এ ছাড়া অজ্ঞাত আসামির সুযোগ রয়েছে বরাবরের মতোই। কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িত না থেকেও মামলার আসামি হয়েছেন পদে বা বিপদে থাকা সারা দেশের অনেক আওয়ামী লীগ নেতা। কোনো কোনো মামলা সাজানোর তরিকা মিলে যাচ্ছে পতিত সরকারের পেটুয়া বাহিনীর সঙ্গে। এসব নিয়ে কথা হচ্ছে দ্বিতীয় স্বাধীনতার মুক্ত পরিবেশে। এসব ভাবাচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ‘গায়েবি মামলা’ থেকে কি ‘ভৌতিক আসামি’র দিকে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আবারও কি পুলিশ-আদালত মওকা পাচ্ছে পয়সা কামানোর? আর এত মামলা এত আসামি! এত সাক্ষী পাওয়া যাবে কোথায়? মামলা নিষ্পত্তিতে এত সময় কোথায় পাবে অন্তর্বর্তী সরকার? পতিত আওয়ামী লীগ সরকার হামলা-মামলা করে দেড় দশকে রাষ্ট্রের মূল্যবান সময়, সম্পদ নষ্ট এবং মজলুমের কষ্ট ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি।
মাসখানেক আগেও বিরোধী মত দমনে কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম পছন্দ ছিল হামলা আর মামলা। গণহারে আসামি করে হাজার হাজার মামলায় লাখ লাখ মানুষকে নাজেহাল করেছে। আসামিকে না পেলে তার বাবা-মা বা স্বজনকে আটক করত পুলিশ। কম হয়রানির আশ্বাসে বিপন্ন পরিবারগুলোর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিত তারা। এ কাজে সহযোগী ছিল আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নানা স্তরের নেতারা। রাজাকারের মতো বিরোধী মতের আন্দোলনকারীদের বাড়ির পথ চিনিয়ে দিত তারা। বিনিময়ে পুলিশের উচ্ছিষ্টের ভাগ পেত প্রশাসনের কাছে উপেক্ষিত রাজনীতিতে দেউলিয়া নেতাকর্মীরা। শত শত গায়েবি মামলায় মৃত মানুষকেও আসামি করা হতো।
প্রতারণার অভিযোগ থাকলেও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও সাংবাদিক দম্পতি শাকিল-রুপার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। যুগের পর যুগ গোয়েন্দা তালিকা ও গণমাধ্যমে ‘ইয়াবার গডফাদার’ তকমা পেলেও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলা হয়েছে। এসব মামলা নিয়ে আরও সুচিন্তিত উদ্যোগ দেখতে চায় মানুষ। ইসলামে পুলসিরাতের উল্লেখ আছে। মৃত্যুর পর সেই সেতু পার হয়ে বেহেশতে যেতে হবে। চুলের চেয়েও বেশি চিকন আর তরবারির চেয়েও বেশি ধারালো। এর ওপর লোহার শিকল ও কাঁটা থাকবে। পুণ্যবান মানুষ চোখের নিমিষেই পার হয়ে যাবে। পাপীরা ব্যর্থ হয়ে নিচের অগ্নিকুণ্ডে অঙ্গার হবে। আসলে প্রতিনিয়ত প্রতিমুহূর্তে মানুষকে পুলসিরাত পার হতে হয়। ভারসাম্য না থাকলেই বিপর্যয় ঘটে। এটা খুব সাধারণ জীবনযাপনকারী লোক থেকে রাষ্ট্রীয় মহান দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিদের বেলায়ও একইরকম ফল বয়ে আনে।
লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা