গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় বিপ্লবে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরকারের করুণ পতন ও পলায়নের পর প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে খানিকটা টানাপোড়েন চলছিল। কূটনৈতিক সম্পর্ক এখনো অনেকটাই শীতল। সঙ্গে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ক্ষোভের কেন্দ্রে রয়েছে মানচিত্রের তিনদিকে ঘিরে থাকা দেশটি। স্বৈরশাসনকে দেড় দশক টিকিয়ে রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল, জনগণের ওপর জুলুম, নিপীড়ন, খুন, গুমের দুঃশাসনে অকুণ্ঠ সমর্থন জোগানোর দায়ে পতিত শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতও জনগণের কাঠগড়ায় অভিযুক্ত। অপশাসন, দুঃশাসন ও লুটপাটের দায় বহুলাংশে নিকট প্রতিবেশী দেশের ওপর বর্তায় বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী।
এমনই এক প্রেক্ষাপটে কোনো পূর্বাভাস ও সতর্কতা জারি ছাড়াই ভারতের ত্রিপুরার ধলাই জেলার বিশাল জলাধার ডুম্বুরের বাংলাদেশমুখো গেট খুলে দিয়েছে ভারত। আকস্মিকভাবে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলকে। ভারতীয় মিডিয়ার খবর বলছে, ৪১ বর্গকিলোমিটারের ডুম্বুর জলাধারের গেট ৩১ বছর পর খুলে দেওয়া হয়েছে। ত্রিপুরা রাজ্যের এক সিনিয়র কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে যে, ‘গেট খুলে না দিলে জলাধার ফেটে ত্রিপুরা রাজ্যের গোটা অঞ্চল জলের তলায় চলে যেত।’
গত কদিন তীব্র বেগে পানি আসছে উজানের দেশ ভারত থেকে। সীমান্তবর্তী নদীগুলো দিয়ে বাংলাদেশমুখী পানির তোড় এতটাই প্রবল যে, মুহূর্তে তলিয়ে যাচ্ছে জনপদের পর জনপদ। ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, খাগড়াছড়িসহ আট জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে গেছে। বিপর্যস্ত মানুষ হয়ে পড়েছে দিশেহারা। ১৯৮৮ সালের পর এমন ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়নি দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষ।
বিশেষত ভারতের সীমান্তবর্তী ফেনী ও কুমিল্লার অবস্থা শোচনীয়। বাড়িঘরে হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি। সব সড়ক, ফসলি জমি তলিয়ে আছে। চৌদ্দগ্রামে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে হাঁটু থেকে কোমরপানি। রাজধানীর সঙ্গে বন্দরনগরীসহ পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোর যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ। মুরগি ও গরুর খামারসহ লাখ লাখ গবাদি পশুও পানির তোড়ে ভেসে গেছে। গোটা ফেনী জেলাই পানির নিচে। সর্বনাশা পানির গ্রাস থেকে রক্ষা পায়নি ফেনী শহরও। বিশেষ করে তিন উপজেলা পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার প্রায় পুরোটাই নিমজ্জিত। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। দুর্ভোগ-দুর্দশা অবর্ণনীয়।
নোয়াখালীর নয়টি উপজেলার আটটিই প্লাবিত। তিন দিন ধরে বেশিরভাগ ঘরবাড়ি পানিমগ্ন হয়ে আছে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের সবকটিই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট ও মৌলভীবাজারেও বন্যার বিস্তার ঘটছে।
গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশের একটি অঞ্চলকে ডুবিয়ে দেওয়া আন্তর্জাতিক আইন ও যৌথ নদী ব্যবস্থাপনার বিধিবিধানের সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ সেই প্রশ্নও উঠেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ঢাকার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার ১৫ দিনের মাথায় ভারত উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ পানি আগ্রাসন চালিয়েছে বলে জোর আলোচনা রয়েছে। বুধবার রাতে রাজধানীতে ভারতের পানি-কাণ্ডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভও হয়েছে। হাজারো তরুণ সে বিক্ষোভে অংশ নিয়ে ভারতীয় আগ্রাসন রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয় জানিয়ে স্লোগান দিয়েছে।
বাংলাদেশের ভুক্তভোগী মানুষের ক্ষোভকে আরও খানিকটা উসকে দিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জি মিডিয়া। এ মিডিয়ার একটি সাইটে বাংলাদেশের বানভাসি মানুষের সঙ্গে রীতিমতো উপহাসমূলক সংবাদ পরিবেশন করেছে। জি২৪ ঘণ্টা নামক সাইটে বুধবার একটি সংবাদের শিরোনাম করা হয়—‘ভারত ছাড়ল জল! হাবুডুবু খেতে খেতে বাংলাদেশের কাতর আর্জি’। সামাজিকমাধ্যমে এ সংবাদটি ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভে ফেটে পড়েন নেটিজেনরা। অবশ্য সন্ধ্যার মধ্যেই জি মিডিয়ার ওই সাইটটি হ্যাক করা হয়। এ নিবন্ধ লেখার সময় সাইটটিতে ঢুকতে চাইলে দেখাচ্ছে—‘সিস্টেম অ্যাডমিন বিডি’ কর্তৃক ওয়েবসাইটটি হ্যাক করা হয়েছে।
ভারতের পক্ষে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে, ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে টানা বৃষ্টির কারণে বন্যা পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। সিপাহিজলা, ধলাই, উত্তর ত্রিপুরা, গোমতী, দক্ষিণ ত্রিপুরা ও উনাকোটি জেলা আংশিকভাবে জলের তলায় চলে গেছে। এ পরিস্থিতিতে ভারতের আবহাওয়া দপ্তর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ‘কমলা সতর্কতা’ জারি করেছে। ত্রিপুরার বাংলাদেশঘেঁষা খোয়াই জেলার প্রশাসন সর্বোচ্চ ‘লাল সতর্কতা’ জারি করেছে। কারণ, খোয়াই নদের পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে।
দীর্ঘ দেড় যুগ পর বাংলাদেশে যে অভাবনীয় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে, তাতে ভারত হতচকিত। হয়তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়ও। দেশপ্রেমিক অদম্য তারুণ্যশক্তির উত্থানকে ভারত যে ভালোভাবে নিতে পারছেন না, তা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে ফেলার জন্য সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে মোদি সরকার ‘জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি’ পর্যন্ত গঠন করেছে। ভারতীয় মিডিয়ায় কল্পকাহিনি প্রচার করে এবং ঢাকার রাস্তায় সংখ্যালঘুর ব্যানারে ক্ষমতাচ্যুত দলের নেতাকর্মীদের নামানোর চেষ্টাও এরই মধ্যে বিফল হয়েছে।
দিল্লিতে আশ্রিত শেখ হাসিনা যে সেখানে শুধু খেয়ে-ঘুমিয়ে সময় কাটাচ্ছেন, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা তার মজ্জাগত। তা চরিতার্থ করতে ভারতের হাতে থাকা সব অস্ত্রই যে শেখ হাসিনা ব্যবহার করাতে চাইবেন, তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ কম। ভারতের শাসক দলের নেতারা এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন যে, শেখ হাসিনার জন্য তাদের যা কিছু করণীয় তার কোনো কমতি হবে না। বাংলাদেশ ও দেশের জনগণের পরিবর্তে ব্যক্তি শেখ হাসিনার সঙ্গে সম্পর্ককে বরাবরই গুরুত্ব দিয়েছে দিল্লি। সব ডিম এক ঝুড়িতে রেখে দিল্লির সাউথ ব্লক এখন কূটনৈতিক সংকটে আছে বলেও অনেক বিশ্লেষক মত দিচ্ছেন।
১৬ বছরের লুটপাট, খুন-গুম এবং সর্বশেষ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার দায়ে এরই মধ্যে কয়েক ডজন মামলার আসামি শেখ হাসিনা। এসব মামলায় বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে তাকে ফেরতের প্রশ্নেও নতুন করে ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। শেখ হাসিনাকে তিন মেয়াদ গদিতে টিকিয়ে রাখতে অনৈতিক সমর্থনের বিনিময়ে দিল্লি একতরফাভাবে যেসব সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে, তা পর্যালোচানার দাবিও ক্রমে জোরদার হচ্ছে। বাংলাদেশ যে প্রাপ্তি ছাড়া শুধু দিয়েছে, তা খোদ শেখ হাসিনাই জানান দিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। তিনি বলেছেন, ‘আমি ভারতকে যা দিয়েছি, তা কোনোদিনই ভুলতে পারবে না।’
ক্ষমতার পালাবদলে ঢাকায় যারা চালকের আসনে আছেন তারা বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার আগ্রহ জানান দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজে ফোন করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কথা বলেছেন। সম্পর্কে শীতলতা যাতে বরফে জমাট না বাঁধে, সে লক্ষ্য থেকেই হয়তো তিনি উদারতা দেখিয়েছেন। এই সৌজন্য ও উদারতা ভারত দুর্বলতা হিসেবে নিলে তা হবে মস্ত বড় ভুল। যদিও মোদি সরকার বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাওয়া এবং ড. ইউনূস সরকারের জন্য সতর্ক শুভকামনা জানিয়েছেন। কিন্তু তাদের মোড়লিপনার লক্ষণীয় কোনো পরিবর্তন নেই।
সীমান্ত হত্যা চলছে আগের মতোই। কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণে প্রথমবারের মতো বিএসএফকে বাধা দিয়েছে বিজিবি। ‘সীমান্তে পিঠ দেখানোর দিন শেষ’—এমন হুঁশিয়ারিও শুনতে হয়েছে দিল্লিকে। ভারত যদি মনে করে বাংলাদেশকে পানিতে ডুবিয়ে, সংখ্যালঘু কার্ড খেলে, সীমান্তে আগের মতোই একতরফা দাপট দেখিয়ে কাবু করে নতুন বাংলাদেশকে শাসন করবে, তা হবে নতুন ভুল। বরং জনগণের ম্যান্ডেটহীন শেখ হাসিনার সরকারের কাছ থেকে একতরফাভাবে যা আদায় করে নিয়েছে, তার হিসাব দেওয়ার সময় এসেছে। বাংলাদেশের তারুণ্যশক্তির যে নব-উত্থান হয়েছে তারা দানবীয় স্বৈরাচারের বন্দুকের গুলির সামনে যেমন বুক পেতে দিতে শিখে গেছে, তেমনি আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, হিন্দুত্ববাদের চোখে চোখ রেখে চ্যালেঞ্জ করতে কুণ্ঠিত হবে না। দেশ ও জনগণের স্বার্থে ভেতর ও বাইরের যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত বলেই জানান দিচ্ছে তারা।
ডুবিয়ে দিয়ে শিক্ষা দেওয়ার কথা ভেবে থাকলে তা পুনর্বিবেচনা করা উচিত ভারতের। অবিলম্বে খুলে দেওয়া গেট বন্ধ করতে হবে। ফারাক্কার গেটও খুলে দেওয়ার যে আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, তা থেকে সরে আসতে হবে। পানি আগ্রাসনসহ যে কোনো হুমকি এলে তাতে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী জনমত আরও প্রবল হবে। পরিণামে নতুন নতুন ফ্রন্টে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে দিল্লিকে। সে পথে না হাঁটাই হবে বুদ্ধিদীপ্ত ও দূরদর্শী কূটনীতি।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে