জাকির হোসেন
প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২৪, ০৩:১৫ এএম
আপডেট : ২২ আগস্ট ২০২৪, ০৯:১০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ক্রান্তিকালে কথকতা

মগের মুল্লুকে বাউল বাঁশির সুর

মগের মুল্লুকে বাউল বাঁশির সুর

নামে কীবা এসে যায়। কানা ছেলের নাম ‘পদ্মলোচন’, বোবা মেয়ের নাম ‘সুভাষী’ আর যে লোকটি সারাদিন মিথ্যাচার করেন তার নাম ‘সত্য প্রকাশ’ হতেই পারে; এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু কলাম কিংবা সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে এ যুক্তি খাটে না। যে কোনো রচনার নামকরণ সার্থক হওয়া জরুরি। ‘ক্রান্তিকালের কথকতা’ আমার এ কলামের নামটি নির্বাচনে সহযোগিতা করেছেন সহকর্মী ইলিয়াস হোসেন। এখন থেকে ঠিক ২৪ বছর আগে একটি সাপ্তাহিকীতে ‘শয়নে-স্বপনে’ নামে একটি কলাম লিখতাম। রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে রঙ্গ করাই ছিল আমার কাজ। ভেবেছিলাম ওই নামে লিখব। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন নামে লেখা উচিত বলেই মনে হলো। সময়ের সঙ্গে থাকাই ভালো। কেননা সময় এক বৃদ্ধ যাযাবর, অবিরাম এগিয়ে চলে। তবে মাঝেমধ্যে থমকে দাঁড়ায়, নিজ দায়িত্বে মানুষের সব কৃতকর্মের হিসাব মিলিয়ে দেয়। সময়ের প্রয়োজন অনেক কিছু পাল্টে যায়। রাষ্ট্র পাল্টায়, সরকার পাল্টায়, শহর পাল্টায়, পাল্টে যায় শহরের দেয়াল। ছাত্র-জনতার কণ্ঠস্বরে জেগে ওঠা দেয়াললিখন দেখার এক বিরল সময়ের সাক্ষী হলাম আমরা। আবার সময়ের প্রয়োজনে মানুষও পাল্টায় আর পাল্টায় বলেই মানুষ বাঁচে, বেঁচে থাকার এটাই নিয়ম। সময়ের প্রয়োজনে পাল্টে যায় কবিতার শিরোনাম। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের আগে যে কবির কবিতার শিরোনাম ছিল ‘বেশ্যার বেড়াল’, স্বাধীন দেশে দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে সেই কবির কবিতার শিরোনাম হয়ে গেল—‘ভাত দে হারামজাদা’।

সময় এক নিষ্ঠুর খেলোয়াড়। কিছুদিন আগেও আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা ভেবেছিলেন রাজনীতির মাঠে তাদের কোনো শক্ত প্রতিপক্ষ নেই। তারাই হলেন রাজনীতির মাঠের একাধিপতি। তাই দলের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন অতিউৎসাহী নেতা অনাহুত ‘খেলা হবে’ বলে দম্ভভরে অবিরাম চিৎকার করছিলেন। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য এবং হেয়প্রতিপন্ন করছিলেন। কিন্তু ভরা বর্ষায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠবে, এটা তাদের বোধের মধ্যেই ছিল না। বিষণ্ন বর্ষার এক মধ্য দুপুরে ছুটে আসা এক বজ্রপাতে তাদের সব দম্ভ চূর্ণ হলো। রাজনীতির মাঠ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন তারা। আর এরই মাধ্যমে গত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশের বুকের ওপর ফ্যাসিবাদ নামের যে জগদ্দল পাথর চেপে বসেছিল, তার আপাত পতন ঘটল।

শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময়। ওই সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর ক্রমাগত দুঃশাসনের মুখোমুখি হয় দেশ। শাসকশ্রেণি সর্বগ্রাসী দানবীয় রূপ ধারণ করে। দালাল বুদ্ধিজীবী, শহরের কিছু পেশাদার পাণ্ডা এবং গ্রাম্য টাউটের হাতে টাকার বান্ডিল ছুড়ে দিয়ে এ দেশের রাজনীতি শুরু হয় নতুন স্টাইলে। কালনাগিনীর মতো বিষাক্ত ফণা তুলে ‘হাইব্রিড’ রাজনীতিরা উঠে আসে রাজনৈতিক মঞ্চে। আইন হয়ে ওঠে প্রতিপক্ষ দমনের এক নগ্ন হাতিয়ার, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ক্রমাগত বিস্তৃত হতে থাকে, শুরু হয় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হত্যা, দমন করা হয় সুষ্ঠু সাংবাদিকতার বিকাশ, হরণ করা হয় মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা। ফ্যাসিবাদ নামের মায়াবী ঘাতক সাংবাদিকতাকে ক্রমান্বয়ে গ্রাস করে। সুষ্ঠু সাংবাদিকতা মুখোমুখি হয় এক ঘোরতর দুঃসময়ের।

কিন্তু সবকিছুরই একটা শেষ আছে। একপর্যায়ে ভয়াবহ দুঃসময়ের মুখোমুখি হলো ফ্যাসিবাদ। লোকচক্ষুর অন্তরালে বেড়ে ওঠে ফ্যাসিবাদ বধের নায়করা। ফ্যাসিবাদ সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করলেও তারুণ্যকে তারা হত্যা করতে পারেনি। তারুণ্য ক্রমান্বয়ে জেগে উঠল ফ্যাসিবাদের জন্য এক ভয়ানক শ্বাপদ হয়ে। দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে ওরা দলে দলে এলো। শাসকের রক্তের পিপাসা মেটাতে ওরা বুক চিতিয়ে দাঁড়াল, প্রাণঘাতী বুলেটকে স্বাগত জানাল দ্বিধাহীন চিত্তে। রক্তে রঞ্জিত হলো পিচঢালা রাজপথ। সন্তানহারা বাবা-মায়ের আর্তচিৎকারে কেঁপে উঠল আল্লাহর আরশ। জ্বলেপুড়ে ছারখার হলো জালেম শাহির তখতে তাউস। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। সেইসঙ্গে আত্মগোপন করে তার পুলিশ বাহিনী। আধুনিক বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা। বিশ্বের কোনো দেশে এমনটি ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। এর আগে আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি ক্যু এবং পাল্টা ক্যুর ঘটনা ঘটেছে। সেনা অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। গণঅভ্যুত্থানে সামরিক স্বৈরাচারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পর তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন। কিন্তু দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমনে অন্তত ৬৫০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। জুলাই মাসে ২৬ জনকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। এখনো বেশ কয়েকজনের লাশ পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। এমন একটি পরিস্থিতিতে গত ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে দুই ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি সত্যিকার অর্থেই লজ্জাজনক ও দুঃখজনক। সংখ্যা দিয়ে এ ঘটনা বিবেচনায় নেওয়া ঠিক নয়। এ দুজনের একজন যদি আমি হতাম আর অন্যজন যদি আপনি হতেন, তাহলে আমাদের মধ্যে কেমন অনুভূতির সৃষ্টি হতো সেটা বিবেচনায় নেওয়া উচিত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের পক্ষ থেকে এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। এজন্য আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই। অতীতে আমরা দেখেছি, এ ধরনের ঘটনাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এসবের সঙ্গে জড়িতদের পুরস্কৃতও করা হয়েছে। ১৯৯৫ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের কথা অনেকেরই মনে আছে। ওই বছর ১৬ সেপ্টেম্বর ৭২ ঘণ্টা হরতাল চলাকালে অফিসগামী দুই ব্যক্তিকে রাস্তায় প্রকাশ্যে দিগম্বর করে ছাত্রলীগ। তারা হলেন শাহজাহান আলী ও অনিল কুমার বিশ্বাস। ইন্টারগ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশনের সহকারী হিসাবরক্ষক শাহজাহানকে দোয়েল চত্বর এলাকায় দিগম্বর করা হয়। আর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের টাইপিস্ট অনিল কুমার দেবনাথকে লাঞ্ছিত করা হয় জগন্নাথ হলের পেছনে। এ ঘটনায় ঢাবির গণিত বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র মোহাম্মদ আলমকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। আলম ১৬৪-এ দেওয়া জবানবন্দিতে ঘটনার কথা স্বীকার করেন।

শাহজাহান আলী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেন। তিনি সকাল ৮টার দিকে দোয়েল চত্বর এলাকা দিয়ে অফিসে যাওয়ার পথে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা পথ আগলে দিগম্বর করে। তিনি তাদের হাতে-পায়ে ধরে অনেক অনুনয় করেন। জোর করে কাপড় খুলে ফেললে তিনি প্রায় দেড় মিনিট দাঁড়িয়ে থাকেন। পরে তার কাপড় ফেরত দেওয়া হয়। জাতীয় দৈনিকগুলোতে এ সংবাদ প্রকাশিত হয়। ছাত্রলীগের হাত থেকে দাড়ি-টুপি পরিহিত ব্যক্তিরাও রেহাই পাননি।

কথিত আছে, শাহজাহান আলীকে দিগম্বর করার ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্রলীগ নেতা আনজাম মাসুদ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভিতে তাকে উপস্থাপনার সুযোগ করে দেওয়া হয়। প্রথমে তিনি ‘বিদ্যাঙ্গন’ এবং পরে ‘আজকাল’ নামের অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করতেন। তার উপস্থাপনার সমালোচনা করায় তিনি ওই লেখককে লাঞ্ছিত করতে পত্রিকা অফিসে হানা দিয়েছিলেন। ওই সময় লেখক অফিসে উপস্থিত না থাকায় তিনি আনজাম মাসুদের লাঞ্ছনার শিকার হওয়া থেকে বেঁচে যান।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার দিন অফিস শেষে গভীর রাতে বাড়ি ফিরি। মগবাজারের ঘিঞ্জি গলির কিনারে এ অধমের বসবাস। এখানে একসময় গভীর জঙ্গল ছিল। ছিল বাঘ-ভালুকের উৎপাত। দুঃসাহসী মগেরা এখানে বসবাস করত। অর্থাৎ এটা একসময় ছিল মগের মুল্লুক। এখন এখানে ক্রমেই বাড়ছে নাগরিক ব্যস্ততা। গভীর রাতে গলির মুখে পা রাখতেই দূর থেকে ভেসে এলো বাউল বাঁশির সুর। দেশটা মগের মুল্লুক হওয়ার পর এমন সুমধুর সুর কখনো শুনেছি বলে মনে করতে পারলাম না...

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মিরপুরে টস জিতে ব্যাটিংয়ে টাইগাররা, জাকের আলীর অভিষেক

চবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা

জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

লাহোরে ভয়াবহ বায়ুদূষণ, ঢাকার খবর কী

শরণার্থী শিবিরে হামলার নেতৃত্বদানকারী ব্রিগেড কমান্ডার নিহত

অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত সংস্কারকাজ শেষ করুন : ডা. তাহের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় / রাজু ভাস্কর্যের নারী প্রতিকৃতির মাথায় হিজাব পরাল দুর্বৃত্তরা

ডিএমপির ট্রাফিক পক্ষ শুরু আজ

ইতিহাসের এই দিনে আলোচিত যত ঘটনা

সোমবার ঢাকার যেসব এলাকায় মার্কেট বন্ধ

১০

বিকাশে চাকরির সুযোগ, আবেদনে নেই বয়সসীমা

১১

২১ অক্টোবর : নামাজের সময়সূচি 

১২

স্কয়ার গ্রুপে চাকরির সুযোগ

১৩

ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

১৪

বিওএ মহাসচিব শাহেদ রেজাকে সতর্কতামূলক পত্র এনএসসির

১৫

ব্যাংক কর্মকর্তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

১৬

শেখ হাসিনাসহ আ.লীগের ৯ শতাধিক নেতাকর্মীর নামে মামলা

১৭

কবজি দিয়ে লেখা মিনারার ভর্তি নিশ্চিতের আশ্বাস বেরোবি উপাচার্যের

১৮

নাটোরে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মশাল মিছিল

১৯

সিকৃবির ভিসি পদে ড. আলিমুল ইসলামের যোগদান

২০
X