ইরান সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বরাবরই একটি বিষয়ে জোর দিয়ে বলে থাকেন, সেটি হচ্ছে—তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির উদ্দেশ্য খারাপ কিছু নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে ভালো বা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্য। একই সঙ্গে বিভিন্ন সময় তাদের এ পরিকল্পনায় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির যে অভিযোগ করা হয়, তা তারা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা সর্বদাই খুব জোরালোভাবে বলে থাকেন, ইরানের সামরিক দর্শনে এ ধরনের অস্ত্র তৈরি বা অস্ত্র সংরক্ষণের কোনো স্থান নেই। এ বিষয়ে সবসময়ই তাদের সর্বোচ্চ এক নেতার একটি ফতোয়াও উদ্ধৃত করেন তারা। তবে গত বছর ৭ অক্টোবরের পর থেকে অর্থাৎ গাজা যুদ্ধের শুরুর পর থেকে ইরানের এ প্রচলিত বয়ানে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ছাড়া তেহরানে হামাসের রাজনৈতিক শীর্ষ নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার পর থেকে বিষয়টি বেশি করে সামনে আসছে। সম্প্রতি ইরানের মিডিয়ায় পারমাণবিক বোমা তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে দেশটির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে খোলাখুলিভাবে আলোচনা ও সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হচ্ছে।
২০২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দেশটির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার সাবেক প্রধান আলি আকবর সালেহি একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তিনি সেদিন বলেছিলেন, ইরানের কাছে পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই রয়েছে। এরপর চলতি বছর ১৮ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তু হওয়ার পরপরই ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) একটি ইউনিট নিউক্লিয়ার প্রোটেকশন কর্পসের কমান্ডার আহমদ হাগতালাব মন্তব্য করেছিলেন, ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের পারমাণবিকবিষয়ক দর্শন এবং পলিসিগুলো নতুন করে পর্যালোচনা করা হবে। এ বিষয়ে নানা পরিবর্তনসহ আমাদের আগের অবস্থান থেকে সরে আসাও অসম্ভব কিছু নয়। হানিয়ার হত্যার কয়েক দিন পর দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় সংস্কারবাদী দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর একটি শার্ঘ পত্রিকায় এক বিস্তৃত সাক্ষাৎকারে সংসদের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি কমিটির সদস্য আহমেদ বখশায়েশ আরদেস্তানি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি জায়নবাদি সরকার ও বাকি শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে এবং কৌশলগত ও চূড়ান্ত অর্জনের একমাত্র উপায় আমাদের কাছে রয়েছে। আর তা হলো—পারমাণবিক বোমা তৈরি করা।’ এ বিষয়ে আরদেস্তানির যুক্তি হচ্ছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন না করা পর্যন্ত ইসরায়েল তার নাশকতা ও হত্যার নীতি অব্যাহত রাখবে। তিনি বলেন, ইরানের চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা কৌশল জোরদার করতে এবং এসব সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা।
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ায় খেয়াল করলে দেখা যায়, আরদেস্তানির এ দৃষ্টিভঙ্গি বিতর্কিত ও স্ববিরোধপূর্ণ। তার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির এ মতবাদ ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে উসকে দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। এটি ইরানের জন্য একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে থাকবে। তিনি ইসরায়েলে হামলার বিষয়ে ইরানকে এর আগের নির্দেশিত সতর্কতার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, এপ্রিলে ৩০০ ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন উৎক্ষেপণের পরও ইরানের বিরুদ্ধে তেমন জোরালো কিছু ঘটেনি। তিনি আরও যুক্তি দেন যে, পারমাণবিক থ্রেশহোল্ডে পৌঁছানোর ফলে সামরিক পদক্ষেপ বা নিষেধাজ্ঞার জন্য আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের বিরুদ্ধে কোনো ঐকমত্য শক্তি দাঁড়াবে না। কারণ ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ইচ্ছা বা ক্ষমতা কোনোটাই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের নেই। আরদেস্তানির মতে, মার্কিন যুদ্ধজাহাজ এবং বিমানবাহী রণতরী মোতায়েন করে সামরিক আস্ফালন দেখাতে পারে বড়জোর; কিন্তু বাস্তবে কখনোই তারা তেহরানে হামলা চালানোর নির্দেশ দেবে না। তিনি ইরানের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল হওয়ার সম্ভাবনাও খারিজ করে দেন। তার দাবি, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আরেকটি বৈশ্বিক সংকট সহ্য করতে পারবে না।’ তিনি বিশ্বাস করেন, পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হওয়া অর্থ হচ্ছে, ইরান সরকারকে পশ্চিমাদের সঙ্গে আলোচনায় একটি শক্তিশালী দর-কষাকষির সুযোগ সৃষ্টি করবে।
আরদেস্তানি এর আগে একবার দাবি করেছিলেন, ইরান এরই মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছে। তবে এ সত্যটি প্রকাশ্যে না বলার অবস্থানে ছিলেন তারা। তিনি বলেছিলেন, আমাদের আভ্যন্তরীণ পলিসি হচ্ছে পারমাণবিক বোমা অর্জন করা; কিন্তু ঘোষিত নীতি হচ্ছে পারমাণবিক চুক্তির আন্তর্জাতিক কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করা। তখন তিনি বলেছিলেন, ইরানের বিশাল ভূখণ্ডের মধ্যে একটি গোপন জায়গা রয়েছে। জায়গাটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্যই নির্ধারিত। ফলে এখানে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার পরিদর্শকদের প্রবেশাধিকার নেই—এ বিষয়টি তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন তখন।
এটা সত্য যে, এ বিবৃতিগুলোর উদ্দেশ্য হতে পারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর এক ধরনের আওয়াজ তুলে রাখা, যেন ইরানকে সমীহ এবং ছাড় দেওয়ার প্রশ্নটি ভাবতে বাধ্য করা যায়। পাশাপাশি ইসরায়েলকেও এক ধরনের চাপের মধ্যে রাখা যেন তারা ইরানের ‘রেড লাইন’ অতিক্রম করতে সাহস করার ব্যাপারে গভীর চিন্তা করে। আবার এ বিবৃতিগুলো যে পারমাণবিক বোমার তৈরির ইঙ্গিত বা পূর্বাভাস হতে পারে, এ বিষয়টিও সম্পূর্ণরূপে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে এ প্রেক্ষাপটে ইরানের ভূখণ্ডে হানিয়াকে হত্যার ব্যাপারটি তাদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ন্যায্যতা দিতে পারে বলে অনেক গবেষকই মনে করেন।
ইরান সরকার ধরে নিয়েছিল যে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা এক ধরনের প্রতীকী হলেও ইরানকে ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তু করার ক্ষেত্রে রাশ টানতে বাধ্য করবে। কিন্তু হানিয়ার হত্যাকাণ্ড ইরান সরকারের সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে, ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনই কাঙ্ক্ষিত মাত্রার প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত নয়। তারা ভয় করতে শুরু করেছে, যেহেতু ইসরাইল ইরানের সঙ্গে জোটবদ্ধ মিলিশিয়া বাহিনীগুলোর নেতা ও অপারেটিভদের লক্ষ্যবস্তু করে চলেছে এবং ইরানের প্রতিরোধকগুলোর কার্যকারিতাও হ্রাস পাবে। এর ফলে ইরান বিশ্বকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, তারা সমর শক্তির দিক দিয়ে আরও দৃঢ় বিকল্পের অর্থাৎ পারমাণবিক বোমার অধিকারী হতে পারে। আর সেই শক্তিশালী অস্ত্র কোনো সংকট মুহূর্তে অবশ্যই ব্যবহার করা হতে পারে। এ প্রসঙ্গে অবশ্য কিছু পর্যবেক্ষকও ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করছেন।
ইরানের কিছু পলিসি মেকারের মধ্যে একটি ক্রমবর্ধমান বিশ্বাস রয়েছে যে, তেহরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা থেকে বিরত রাখতে মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ়। তা সত্ত্বেও তারা মনে করেন, ‘সবকিছু আলোচনার টেবিলে সমাধান সম্ভব’ এবং মার্কিনদের সঙ্গে তাদের সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। পলিসি মেকারদের অনেকেই আবার এমন ধারণাও করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বড়জোর ইরানের ওপর সীমিত সময়ের জন্য আরও কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে—এর বেশি কিছু নয়। শেষ বিচারে দেখা যাবে, গোটা বিশ্বই ইরানের নতুন স্ট্যাটাস (পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী) মেনে নিতে বাধ্য হবে। যদিও এ দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থতা অনিশ্চিত, তবুও এটি ক্ষমতার অনিশ্চিত ভারসাম্য এবং একটি উল্লেখযোগ্য ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনাকেই ইঙ্গিত করছে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, আন্তর্জাতিক ইনস্টিটিউট ফর ইরানিয়ান স্টাডিজ। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন সঞ্জয় হালদার