মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১
ইলিয়াস হোসেন
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৪, ০২:৫২ এএম
আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২৪, ০৯:৩৩ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যে কথা কেউ শোনে না

রাজনীতিবিদ: ব্যবসায়ীদের ফড়িয়া থেকে আমলার কামলা

রাজনীতিবিদ: ব্যবসায়ীদের ফড়িয়া থেকে আমলার কামলা

শুরুতে এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে জমিদার, আইনজীবী ও শিক্ষকদের বেশ প্রভাব ছিল। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিলেও সরাসরি রাজনীতি করতেন না ব্যবসায়ীরা। দেশের টানে, প্রিয় নেতাকে ভালোবেসে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতেন। নীতি-নৈতিকতার মধ্যে থেকে প্রতিদান পেতেন তারা। অন্তত সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়টি উৎকট মনে হতো না। এর ব্যতিক্রমও ছিল। অল্পসংখ্যক ব্যবসায়ী রাজনীতি করতেন। এর মধ্য দিয়ে ব্যবসায়িক সুবিধা নিলেও সেটা চোখে পড়ার মতো ছিল না। প্রচারণায় দেশসেবাটাই মুখ্য ছিল। তবে কালক্রমে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ এবং ব্যবসায়িক ফায়দা লোটার বিষয়টি জাতির কাছে মহামারি আকার ধারণ করেছে।

১৯৫৪-এর সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন মাত্র ৪ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১৩ শতাংশে। এরপর, ১৯৭৯-তে ৩৪, ১৯৯৬-এ ৪৮, ২০০১ সালে ৫১ ও ২০০৮ সালে ৬৩ শতাংশ। দশম সংসদ নির্বাচনে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বিশ্লেষণ অনুযায়ী দেখা যায়, ৫৪৩ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে অর্ধেকের বেশি ব্যবসায়ী। অর্থাৎ ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ বা ২৮৪ জন। আর নির্বাচিত ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে অধিকাংশই (১৭৫ জন বা ৫০ শতাংশ) ব্যবসায়ী। ২০১৮ সালে দেখা যায়, ৫৩ দশমিক ১৪ শতাংশ প্রার্থীর পেশা ব্যবসা। এ ছাড়া আইন পেশায় ৮ দশমিক ৯৮, কৃষিতে ৬ দশমিক ৯৩, চাকরিতে ১৬ দশমিক ৪৫, গৃহিণী শূন্য দশমিক ৯২ ও অন্যান্য পেশায় যুক্ত আছেন ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রার্থী। অন্যদের মধ্যে শিক্ষক, রাজনীতিক, সমাজসেবক, চিকিৎসক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা ইত্যাদি পেশা উল্লেখযোগ্য। ওই নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যদের ১৮২ জনই (৬১ দশমিক ৭ শতাংশ) পেশায় ব্যবসায়ী। নির্বাচিত ২৯৯ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ২০০ জনের পেশা ব্যবসা। সংসদ সদস্যদের ৬৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ ব্যবসায়ী। একাদশ জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী ছিলেন ১৮৫ জন বা মোট সংসদ সদস্যের ৬১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সম্প্রতি বিলুপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের প্রায় ৬৭ শতাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী। সংসদ সদস্যদের প্রায় ৯০ শতাংশই কোটিপতি। একাদশ জাতীয় সংসদের তুলনায় ব্যবসায়ী ও কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে।

উল্লেখ্য, পেশায় ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও অনেকে তাদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামায় ব্যবসার পরিবর্তে অন্য কিছুকে পেশা হিসেবে ঘোষণা দেন। এ ছাড়া কেউ কেউ সংসদ সদস্য হওয়ার পর ব্যবসায়ী হয়ে যান। সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের ভাষায়, ‘রাজনীতি আর এখন জনসেবা নয়—এটি এখন অনেকটাই ব্যক্তি-গোষ্ঠী-কোটারি সেবার উত্তম উপায়। অতীতের ত্যাগী নেতাদের অনেকেই এখন রাজনীতি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। অথবা, নিজেরাও রাজনৈতিক ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়েছেন। বস্তুত আমাদের দেশে আদর্শিক রাজনীতির মৃত্যু ঘটেছে। ফলে রাজনীতি ও ব্যবসা কোনোটাই সঠিকভাবে চলছে না।’

এরকম মন্তব্য দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলে আসছেন। এমনকি বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীরা এ বিবর্তন নিয়ে নিয়মিত সভা-সেমিনার করে থাকেন। সেগুলোতে রাজনীতিবিদরা অংশ নিয়ে অকাতরে অর্জিত অভিজ্ঞতা, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ও গঠনমূলক পরামর্শ দান করেন। লাঞ্চের ফাঁকে অথবা সম্মানী গ্রহণের তালিকায় স্বাক্ষরের সময় আফসোসের কথাও জানান তারা। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে তাদের মতামত বেশিরভাগ সময়ই উপেক্ষিত থাকে। ফলে ত্যাগী নেতা ও ভালো সংগঠকের তুলনায় দলে ব্যবসায়ী তথা টাকাওয়ালাদের কদর বেশি। আর ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদ বনে গেলেও স্বভাবতই তাদের ঝোঁক থাকে ব্যবসার দিকে। নির্বাচনকালে ব্যয়িত সময় ও টাকাকে বিনিয়োগ মনে করেন। সেই অনুযায়ী মুনাফা অর্জন করতে শুধু দুর্নীতি নয়, আইনও তৈরি করেন তারা। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন ফটকা ব্যবসায়ীরা। জনশক্তি, আবাসন, গার্মেন্ট, পরিবহন এরকম খাতে ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদে লোনের নামে ব্যাংক লুট করে বড় ব্যবসায়ী সেজেছেন অনেক টোকাই। তারা আবার একেকজন একই সঙ্গে দানবীর ও আলোচিত জনপ্রতিনিধির পরিচিতি পেয়েছেন। দার্শনিক ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, আগে জমিদারের বাচ্চারা রাজনীতি করতে এসে ফকির হয়ে যেতেন। এখন ফকিরের বাচ্চারা রাজনীতি করে জমিদার হয়ে যান। এ বিক্ষুব্ধ মন্তব্য সম্প্রতি খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। বিশেষ করে গত তিনটি সংসদ ও দেড় দশকের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিজয়ী বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধির দিকে তাকালে এ কথার সত্যতা মেলে।

রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নেতৃত্বের এ পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় শুধু ব্যবসায়ীদের আগ্রাসী মনোভাব দায়ী নয়। অদক্ষ, অযোগ্য, লোভী রাজনীতিবিদও সমান অপরাধী। বিজয়ী হওয়ার পর এলাকার জনগণের সঙ্গে শিথিল সম্পর্ক, আয়েশি জীবনযাপন, উচ্চাভিলাষী লোভে বিভোর থেকে জনপ্রিয় অনেক নেতাকে জনবিচ্ছিন্ন হতে দেখা গেছে। ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নির্বাচনী খরচ নিয়ে কেউ কেউ তা ফেরত দেওয়ার গরজ দেখাননি আর। প্রতিদান না দিয়ে নিজেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন। অথবা নতুন ব্যবসায়ী চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এতে করে ব্যবসায়ীরা ওরকম নেতাদের ‘রাজনৈতিক টাউট’ তকমা দিতে পয়সা খরচ করেন মিডিয়া ও এলাকায়। একপর্যায়ে দলের ফান্ড ও দলীয় নীতিনির্ধারকদের পকেট ভরিয়ে নিজেরাই জনপ্রতিনিধি হয়ে গেছেন। স্থানীয় পর্যায়ের ত্যাগী ও কর্মঠ নেতারা দলে অস্তিত্ব রক্ষায় বাধ্য হন মনোনয়ন কেনা লোকের রাজনৈতিক কর্মচারী হতে। আর আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নেতাকর্মীরা ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান দল থেকে।

এদিকে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে এখন পরাক্রমশীল আরেক গোষ্ঠীর নাম ‘আমলা’। রাজনৈতিক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় আমলাতন্ত্রের ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল। কোনো কোনো সময় এ নির্ভরশীলতাই রাজনীতিবিদদের জীবনে করুণ হয়ে ফিরে আসে। দুঃসময়ের পরীক্ষিত রাজনীতিবিদকেও অনেক সময় আমলার পরামর্শে কোরবানি দেয় দলীয় সরকার। জনগণের স্বার্থে কথা বলতে গিয়ে নেতাকর্মীদের নাজেহাল হতে হয় সুযোগসন্ধানী কৌশলী আমলার কাছে। সরকারগুলো তাদের মিষ্টি ও লোভনীয় ফাঁদে পা দেয়। যেনতেনভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে গত দেড় দশকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন সেক্টরের মতো আমলাতন্ত্রেরও চরম অবনমন হয়েছে। দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য-অদক্ষদের নিয়োগ, পদোন্নতি, খুশি রাখতে অপ্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এতে খুশি না থেকে তাদের লোভ আরও বেড়েছে। শুধু সাচিবিক দায়িত্বে সন্তুষ্ট না থেকে এমপি-মন্ত্রী হয়ে পরিপুষ্ট হওয়ার মিশন নিয়েছেন তারা।

১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চের মাধ্যমে সরাসরি রাজনৈতিক মতপ্রকাশ করেন চাকরিরত আমলারা। সে প্ল্যাটফর্মের ইমাম ছিলেন বহুল আলোচিত সচিব এইচ টি ইমাম। পরবর্তীকালে রাষ্ট্র ও দল পরিচালনায় তার সফলতা দেখে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আমলারা। সেই থেকে রাজনৈতিক দলগুলোয় আমলারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। এখন দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতাদেরও পরিচালনা করেন শীর্ষ নেতৃত্বের আশীর্বাদপুষ্ট আমলা রাজনীতিবিদ।

বিভিন্ন সময় সামরিক ও স্বৈরশাসনে ক্ষতবিক্ষত দেশের রাজনীতিকে সুস্থতা দেওয়ার দায়িত্ব রাজনীতিবিদকেই নিতে হবে। এজন্য সৎ, দক্ষ, যোগ্য, নির্লোভ, আধুনিক ও মানবিক গুণাবলির নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। কেননা, শেষ পর্যন্ত জনগণই রাজনীতিবিদদের প্রধান হাতিয়ার। সামরিক-বেসামরিক আমলা, দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী কেউই সহমরণে থাকেন না। রাজনীতিবিদদের কাছে মাটি-মানুষই হোক শেষ কথা।

লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশের পর প্রতিবন্ধী রনি পেল হুইলচেয়ার

শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে : আবু হানিফ

ক্রীড়াবিদ শওকত আলীর স্মরণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল

শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

রাসূল (স.) আদর্শ ধারণ করে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে

ঝিনাইদহে নাশকতা মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী সুজনের গ্রেপ্তারের খবরে বিএনপির আনন্দ মিছিল

মানিকগঞ্জে ধলেশ্বরী নদী থেকে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার

ভূমি উপদেষ্টার পরিদর্শন, হয়রানি ছাড়া নামজারি খতিয়ান পেয়ে উৎফুল্ল নাজিম  

১০

চট্টগ্রামে জশনে জুলুশে মানুষের ঢল  

১১

বন্যা পরবর্তী প্রাণী চিকিৎসায় বাকৃবি শিক্ষার্থীরা

১২

‘দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির জন্য রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করতে হবে’

১৩

নার্সের ভুলে ৩ দিনের শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ

১৪

‘স্মরণকালের সবচেয়ে বড় গণসমাবেশ’ করার প্রস্তুতি বিএনপির

১৫

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালিত

১৬

রাত ১টার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের আভাস

১৭

সিরাজগঞ্জে কবরস্থানে মিলল অস্ত্র ও গুলি

১৮

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমিরের মতবিনিময়

১৯

২৮ থেকে ৪২তম বিসিএসের বঞ্চিত সেই ক্যাডাররা ফের বঞ্চনার শিকার

২০
X