ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৪, ০২:৫২ এএম
আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২৪, ০৭:৩৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

উন্নয়নের নামে দ্বিপক্ষীয় ঋণবোঝা

উন্নয়নের নামে দ্বিপক্ষীয় ঋণবোঝা

আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া ঋণের বোঝা টানতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। বড় অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য বাংলাদেশ যে ঋণ নিচ্ছে, তার পরিমাণ মাত্র সাত বছরের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন যে ঋণ করছে, তার একটি বড় অংশ যাচ্ছে সেই ঋণ পরিশোধের পেছনেই।

আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বাজেট সহায়তার জন্য বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঋণ নেয় শেখ হাসিনার সরকার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে এবং নিচ্ছে। পাবলিক ও প্রাইভেট মিলিয়ে ২০১৭ সালের শেষে বাংলাদেশের সার্বিক মোট ঋণ ছিল ৫১.১৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে এটি ১০০.৬৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।

বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর সুদ এবং আসল পরিশোধের পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ছে। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক, রাজস্ব আহরণ, রপ্তানি বাণিজ্য, ডলার সংকট ও রিজার্ভ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও চাপের মুখে পড়তে পারে। ১০০ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণটা, এর মধ্যে বেশিরভাগই সরকারের ঋণ। ৭৯ বিলিয়ন ডলার তো সরকারের। সেটা জিডিপির সঙ্গে তুলনা করলে ১৭ শতাংশের কাছাকাছি। খুব একটা চাপ না। কিন্তু পরিশোধ করার পরিমাণটা সুদ এবং আসল মিলিয়ে অনেক বেশি।

বাংলাদেশের কার কাছে কতটা ঋণ রয়েছে, সেই বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ডাটা পাওয়া যায়। এ সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণ ছিল ৫৫.৬০ বিলিয়ন ডলার। এই ঋণের অর্ধেকের বেশি ৫৭ ভাগ হলো বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছে। আর দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে ঋণ করেছে তার মধ্যে জাপান, রাশিয়া, চীন ও ভারত—এ চারটি দেশই প্রধান। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বেলায় বাংলাদেশ জাপানের কাছেই সবচেয়ে বেশি দেনায়। জাপানের কাছে বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ ৯.২১ বিলিয়ন ডলার। এরপরই রাশিয়ার কাছে ৫.০৯ বিলিয়ন, চীনের কাছে ৪.৭৬ বিলিয়ন এবং ভারতের কাছে ১.০২ বিলিয়ন ডলার ঋণী বাংলাদেশ।

বর্তমানে এ ঋণ আরও অনেক বেশি। কারণ ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ৫৬৩ কোটি ডলার ঋণ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এডিবি থেকে ১৪০ কোটি এবং বিশ্বব্যাংক থেকে ৯৬ কোটি ডলার নিয়েছে বাংলাদেশ। একই সময়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় জাপান থেকে ১৩৫ কোটি, রাশিয়া থেকে ৮০ কোটি, চীন থেকে ৩৬ কোটি, ভারত থেকে ১৯ কোটি এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতির প্রবণতায় দেখা যায় সরকারের বৈদেশিক ঋণ এবং এর পরিশোধ দুটোই ক্রমাগত বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারের যে ঋণ ৫০ বিলিয়ন ছিল সেটি ২২-২৩ অর্থবছরে ৬২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। এ ঋণ পরিশোধের ধারাও ঊর্ধ্বমুখী। পরিশোধের পরিমাণও বেড়ে চলেছে। চলমান অর্থবছরের জন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বরাদ্দ রাখতে হয়েছে বাজেটে। আগামী বছরগুলোতে সেটি ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না, উল্টো বিদেশে অর্থ পাচার, উচ্চশিক্ষা ও বিদেশে চিকিৎসার জন্য বিলিয়ন ডলারের বাড়তি ব্যয় হচ্ছে যেটা দুশ্চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশে বাস্তবতা হলো, বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব এবং ব্যয় বৃদ্ধি হচ্ছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ খাতে একটা বড় অঙ্কের ঋণের বোঝা রয়েছে সরকারের কাঁধে। ডলারের রিজার্ভও ক্রমাগত কমছে। সেইসঙ্গে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে ঋণ পরিশোধে ব্যয় আরও বেড়েছে টাকার অঙ্কে।

টাকার অঙ্কে কিন্তু আমার বৈদেশিক ঋণ প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ৮২ থেকে ১১৭ হয়ে গেছে অর্থাৎ আমাকে রাজস্ব ৪০ শতাংশ বেশি কালেক্ট করতে হবে। এটা বড় সমস্যা। আমাকে ম্যাক্রো (সামস্টিক অর্থনীতি) স্ট্যাবিলিটি রাখতেই হবে। আমাকে রাজস্ব বাড়াতেই হবে। তা না হলে আমি ম্যাক্রো স্ট্যাবিলিটি রাখতে পারব না এবং আমার কাঠামোগত দুর্বলতা আছে যেসব সেক্টরে, সেখানে বিনিয়োগ করতে হবে। এবং তা করে বৈদেশিক মুদ্রা সেভ করতে হবে।

এদিকে বিদেশি ঋণের সব দায় শেষ পর্যন্ত জনগণের কাঁধেই পড়বে। জনগণের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আদায় করেই সরকারের আয় বাড়াতে হবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছে হাসিনা সরকার, সেটির আকার সব মিলিয়ে ২ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রেকর্ড এক লাখ কোটি টাকার ওপর অর্থায়নের পরিকল্পনা বৈদেশিক উৎস থেকে।

সরকার জোর দিয়ে একটি বিষয় বলে যে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধে কখনো ব্যর্থ হয়নি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) গত ডিসেম্বরের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণদানে শীর্ষ দেশ ও সংস্থার মধ্যে ছিল বিশ্বব্যাংক, জাপান, এডিবি ও চীন। সাম্প্রতিককালে চীনা ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

বিদেশি অর্থায়নে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল গত সরকার। এর মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, মেট্রোরেল (লাইন-৬), হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ ইত্যাদি। কোনো কোনো প্রকল্পের ঋণের শর্ত ও এর উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

বিদেশি ঋণ ও ঋণ শোধের চাপ বাড়লেও রপ্তানি, প্রবাসী আয় ও বিদেশি বিনিয়োগ সেভাবে বাড়ছে না। আট বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময়ে ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৩৫ শতাংশ (২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাবে)। কিন্তু রপ্তানি আয় ৬২, প্রবাসী আয় ৬০ ও বিদেশি বিনিয়োগ ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এই তিন খাতে আয় ঋণের অনুপাতে না বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমেছে। বর্তমানে দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকলেও বড় ঘাটতি রয়েছে আর্থিক হিসাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর শেষে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ছিল ৫২৩ কোটি ডলার। আর জানুয়ারি শেষে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩৫ কোটি ডলারে। এই ঘাটতির একটি কারণ বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়ে যাওয়া। এখন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেই সেই ঋণের চাপ বহন করতে হবে।

লেখক: সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বসতবাড়ি রক্ষায় অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে গ্রামবাসীর মানববন্ধন

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণ জানালেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

সাংবাদিকদের দেশ ও জাতির স্বার্থে কথা বলার আহ্বান ব্যারিস্টার খোকনের

টানা ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর দৌলতদিয়া ৭নং ফেরিঘাট চালু

মতিঝিলে ছিনতাইকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য গ্রেপ্তার

ইজতেমা মাঠে হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে কুমিল্লায় মহাসড়ক অবরোধ

গুলশানে বিদেশি পিস্তলসহ গ্রেপ্তার ১

গাজায় শিশু হত্যার তীব্র নিন্দা পোপ ফ্রান্সিসের

শাহবাগে বেসরকারি ট্রেইনি চিকিৎসকদের বিক্ষোভ

‘ফ্রেন্ডলি ফায়ারে’ নিজেদের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করল মার্কিন সেনারা

১০

সন্দ্বীপবাসীর কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণ করবে ফেরিঘাট : বিএনপি নেতা মিল্টন

১১

বাড্ডায় ছিনতাই করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা ৩

১২

চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করল সেই পাকিস্তানি জাহাজ

১৩

সংলাপে বক্তারা / গত ১৫ বছর গণমাধ্যম জনগণের কথা বলেনি

১৪

‘বঙ্গবন্ধু রেল সেতু’র নাম পরিবর্তন

১৫

প্রশাসন ক্যাডারের ইয়াং অফিসার্স ফোরামের সভাপতি শুভ, সা. সম্পাদক জয়

১৬

সাদপন্থি নেতা মুফতি মুআজ বিন নূর ৩ দিনের রিমান্ডে

১৭

চলাচলের রাস্তায় যুবলীগ নেতার সবজি চাষ

১৮

গাজা উপত্যকা এখন মানবতার কবরস্থান : জাতিসংঘ

১৯

ক্ষেপণাস্ত্র সমালোচনা / যুক্তরাষ্ট্রকে কড়া জবাব দিল পাকিস্তান

২০
X