বহুদিন থেকেই আমাদের সমাজে বিরাজমান নানা অসংগতি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে ব্যাপক মাত্রায় প্রচলিত একটি কথা হলো—‘পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় আদালত হলো মানুষের বিবেক’। মানুষ যখন বিবেকতাড়িত হয়, তখন সে অপরাধ করে না। কাজেই এ ক্ষেত্রে আইন-আদালতের প্রয়োজনও হয় না। তবে বাস্তবতা এমনটি নয়।
বাস্তব পৃথিবীতে নানা কারণে মানুষ বিবেক বিসর্জন দিয়ে অপরাধ করে বলেই আইন-আদালতের প্রচলন সেই আদিকাল থেকে। আর আইন-আদালত অঙ্গনে উচ্চারিত একটি পবিত্রতম নাম ‘বিচারক’। মফস্বল শহরে বড় হয়েছি আমি। সেই শহরে একটি উঁচু দেয়ালঘেরা বাড়ি ছিল। মুরব্বিদের কাছে জেনেছি, এটি এই শহরের সবচেয়ে বড় বিচারকের বাড়ি। তিনি দুষ্টদের ফাঁসি পর্যন্ত দিতে পারেন। ওই বাড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে ভাবতাম, জীবনমৃত্যুর মালিক একমাত্র স্রষ্টা। আর স্রষ্টা তার ক্ষমতা পৃথিবীতে বিচারক নামক যাদের মাধ্যমে প্রয়োগ করেন, তারা কি মানুষ না ঐশ্বরিক কেউ? মানুষ হলে কেমন তাদের চেহারা, চরিত্র এবং কাজের ধরন!
সেই অল্প বয়সে আরও জেনেছিলাম, মফস্বলের এই বিচারক মানুষ বটে, তবে সব মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে তার জীবন। কেউ আবদার করলে ন্যায়বিচারে বাধা হতে পারে বলে তিনি নাকি সবাইকে এড়িয়ে চলতেন। আমরা ওই বাড়িটিকে সমীহ করে চলতাম। বলা যায়, একরকম ভয় পেতাম। আজ দেশের প্রধান বিচারপতি, যাকে মহান স্রষ্টা ফাঁসির হুকুম দেওয়ারও ক্ষমতা দিয়েছেন, তার বাসভবনে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের ঘটনার প্রেক্ষাপটে ছোটবেলায় দেখা সেই বিচারকের বাড়ির কথা মনে পড়ল।
আরও মনে পড়ল, বিচারকদের বিচক্ষণতা নিয়ে পড়া বেশ কিছু কাহিনি। এক সন্তানের মাতৃত্ব দাবি করেছিলেন দুই মহিলা। বিচারক কোতোয়ালকে হুকুম করলেন তলোয়ার দিয়ে ওই সন্তানকে দুই টুকরো করে দুই মাকে দিয়ে দিতে। বিচারকের রায় শুনে প্রকৃত মা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন এবং বললেন—না, আমি মা না, উনাকেই বাচ্চাটা দিয়ে দেন। বিচারক জেনে গেলেন আসল মায়ের পরিচয়। শাস্তি দিলেন নকল মাকে।
ইসলামের ইতিহাসে বিচারকদের সততা, বিচক্ষণতা ও সৎসাহসের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। এসবের মধ্যে অন্যতম উপযুক্ত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খলিফার আসনে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় হজরত ওমর (রা.) ও হজরত আলী (রা.)-এর বিপক্ষে নির্ভয়ে বিচারকের রায় প্রদান। বাগদাদের ক্ষমতাসীন বহু খলিফার বিরুদ্ধে অসংখ্য রায় দিয়েছেন কাজি নামে পরিচিত সেই যুগের বিচারকরা। মুঘল সম্রাটরাও কাজিদের সমীহ করে চলতেন এবং সমন পাঠালেই ছুটে যেতেন কাজির দরবারে। এমনকি এই বাংলায় কাজিরাও ভয় ও প্রভাবমুক্ত থেকেই বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।
এককালে বৃহত্তর বাংলার শাসক ছিলেন ইলিয়াস শাহি বংশীয় সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ। একদা অসতর্কতার কারণে তার নিজের নিক্ষেপ করা তীর দূরের এক বিধবার পুত্রের দেহে বিদ্ধ হলে সেখানেই মারা যায় সেই পুত্র। ফলে সেই বিধবা প্রধান বিচারপতি কাজী সিরাজুদ্দিনের দরবারে নালিশ করেন। তাৎক্ষণিকভাবে সুলতান গিয়াস উদ্দিনকে তলব করেন প্রধান বিচারপতি (কাজি)। সুলতানও সুবোধ প্রজার মতো কালবিলম্ব না করে কাজির দরবারে হাজির হন। কৈফিয়তের জবাবে সুলতান তার অপরাধ ও ভুল স্বীকার করেন। কাজি তৎকালীনভাবে প্রচলিত শরিয়াহ আইনানুসারে ‘ব্লাড মানি’ (হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতিপূরণ) পরিশোধ করে বিধবার ক্ষমা লাভের জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেন, না হয় শাস্তির আদেশ শোনানোর জন্য পরবর্তী তারিখ ঘোষণা করেন। অনুতপ্ত ও শাস্তির ভয়ে ভীত সুলতান ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে ক্ষতিপূরণ প্রদান ও যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিধবার ক্ষমা লাভ করেন ও কাজির বিচার থেকে অব্যাহতি পান।
ইতিহাস ছেড়ে ফিরে আসি সাম্প্রতিক বাংলাদেশে। ২০২৩ সালের ১৫ আগস্ট দেশের সর্বোচ্চ বিচারাঙ্গনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ প্রসঙ্গটির অবতারণা করেন। এতে পূর্ব থেকেই সমালোচনার শিকার বিচার বিভাগের গ্রহণযোগ্যতা নতুন করে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। এর আগে সম্প্রতি বিদেশে পালানো এক নগরপিতা দেশের তৎকালীন প্রধান বিচারপতিকে টেনে নামানোর ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা বলে রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে বিচার বিভাগের অসহায়ত্ব তুলে ধরেন। একজন প্রাক্তন ও বিতর্কিত বিচারপতি এক টেলিভিশন টকশোতে উপস্থাপিকার প্রতি চরম অসৌজন্য প্রদর্শন করে বিচারপতি সমাজকে মানুষের সামনে হেয়প্রতিপন্ন করেন। এর আগে কর্মরত অবস্থায় তার নানাবিধ কর্মকাণ্ড বহু বিতর্কের জন্ম দেয়। নামমাত্র সাজা হয় এমন জামিনযোগ্য ধারায় অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও একজন কর্মরত সচিবকে এক বিচারক মুহূর্তেই জামিন না দিয়ে জেলে পাঠান। পদ্মা সেতুসংক্রান্ত সেই মামলা পটপরিবর্তনের পরপরই বাতিল হয়ে যায় এবং সেই সচিব একই সরকারের অধীনে মুক্ত হয়ে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে আসীন হন। অবসর গ্রহণের পর একজন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি বারবার মেয়াদ বাড়িয়ে টানা ১১ বছর একটি রাষ্ট্রীয় পদ দখল করে রাখেন ও প্রধান বিচারপতির সমান সম্মান, মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে চিকিৎসার নামে ৯ লাখ টাকা রাষ্ট্রীয় অনুদান গ্রহণ, আগের দেওয়া সংক্ষিপ্ত রায় ১৬ মাস পর পাল্টিয়ে সরকারের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা এবং ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারিতে জড়িত ভাইকে উদ্ধার করার অভিযোগ। নৈতিক অবস্থান না থাকার কারণে অতিসম্প্রতি তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন, যা নিঃসন্দেহে একজন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির জন্য তথা বিচার ব্যবস্থার জন্য কলঙ্কময় ঘটনা।
রাষ্ট্র বনাম ব্যক্তি মামলা হলে বিচারক যেন রাষ্ট্রের প্রতি দুর্বল না হয় এবং নাগরিকের প্রতি ন্যায়বিচার করতে পারেন, সেজন্য অবসর গ্রহণের পর রাষ্ট্রীয় লাভজনক পদে কোনো বিচারক নিয়োগ করার প্রবিধান নেই বিশ্বের অধিকাংশ সভ্য দেশে। এমনকি একজন বিচারক অন্য বিচারককে ‘আপনার শরীর বোধহয় ভালো যাচ্ছে না’ বলে ইঙ্গিত করলেও অন্যজন বুঝে যান তিনি ভুল করেছেন। এমনকি তিনি এমন প্রশ্ন শোনামাত্র পদত্যাগ করেন। এটাই বিচার বিভাগের পবিত্রতা ও সৌন্দর্য।
কিন্তু হায়! বিগত দিনে এ কি বিচার ব্যবস্থা দেখলাম আমরা? জনগণের টাকায় কেনা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত মারণাস্ত্র ব্যবহার করে সরকারি পেটুয়া বাহিনী দ্বারা প্রতিবাদী ছাত্র হত্যার প্রতিকার চাওয়া হলে বিচারক অসুস্থ হয়ে যান, অনুপস্থিত থাকেন। বিচারাধীন বিষয় বিধায় ৭ আগস্টের আগে যে জীবনমরণ সমস্যার রায় আদালত দিতে পারছিলেন না, ঠিকই ২ তারিখে তা ফায়সালা হয়ে যায় গণদাবির মুখে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আদালতের রায়ে ছাত্ররা আশাহত হবে না—আর তার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বলেন, এমন রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। প্রতিদিন শত শত ছাত্র-জনতাকে যে বিচারকরা জামিন না দিয়ে অযথা জেলে পাঠান, সেই বিচারকরাই আবার হাজার হাজার তথাকথিত জামিন মঞ্জুর করেন কয়েক ঘণ্টায়। ১৭ বছরের নিচে (শিশু) এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের হাত ও কোমর দড়ি বেঁধে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলে তাদেরও জেলে পাঠানো হয়। আবার চাপের মুখে তাদের জামিনও হয়ে যায়। এসব কি বিচারকদের বিবেকের পরিচয়?
এ দেশে বহু বিচারের রায় দিয়েছেন এমন একজন বিচারকের আইনগত শিক্ষাসনদই ছিল নকল। দুর্নীতির দায় নিয়ে দেশছাড়া এক প্রধান বিচারপতির দেওয়া রায়ে বহু মানুষ আজও জেলে। হয় তিনি সত্যিই দুর্নীতিবাজ, না হয় সরকার তার গায়ে দুর্নীতির মিথ্যা কালিমা লেপে দেশছাড়া করেছে, আর বাকি সব বিচারক তা নীরবে মেনে নিয়েছেন। কী দুর্ভাগ্য! অতিসম্প্রতি ঘরদুয়ার ছেড়ে পালিয়ে বেড়ানো প্রধান বিচারপতিসহ পলাতক অন্যান্য বিচারপতির দেওয়া রায়ের ভবিষ্যৎ জানা নেই কারও। মানুষের বিবেকই যদি জগতের শ্রেষ্ঠ আদালত হয়, তবে বিচারকদের বিবেকের মূল্য কত হতে পারে, তা সম্মানিত বিচারকদের ভেবে দেখতে হবে।
বাংলা গণসংগীতের প্রবাদপুরুষ গীতিকার ও সুরকার সলিল চৌধুরী বিবেকহীন বিচারকদের কথা ভেবেই হয়তো লিখেছেন—‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা, তোমার গুলির তোমার ফাঁসির তোমার কারাগারের পেষণ শুধবে তারা ও জনতা—’। চরিত্র শুধরে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে একজন অপরাধীকে এমনকি সন্দেহভাজনকেও জেলে পাঠান বিচারকরা। এখন পালিয়ে বেড়ানো এবং অপরাধ করা বিচারকরা তো সেখানেও যেতে পারবেন না। তাহলে তাদের চরিত্র শোধরাবে কেমন করে? আর সমাজে তারা মুখ দেখাবেন কেমন করে? আচ্ছা, অন্যায়ভাবে জেলে পাঠানো কোনো বন্দির সঙ্গে একই জেলে যদি কোনো বিচারককে দেখা যায়, দৃশ্যটা কেমন লাগবে?
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর এবং গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
Email: [email protected]