জহির রায়হান কালজয়ী বাঙালি চলচ্চিত্রকার, শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক—এ তিন পরিচয়ই তিনি ছিলেন সফল। পুরো নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। জহির রায়হান নামেই তিনি বিখ্যাত। ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তার মৃত্যুর দিনটি আজও রয়ে গেছে অজ্ঞাতই। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকার মিরপুরে তার ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে তিনি আর ফিরে আসেননি। ধারণা করা হয়, মিরপুরে বিহারি এলাকায় ছদ্মবেশী পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলির আঘাতে তিনি মারা যান।
জহির রায়হান নামটি আসলে রাজনীতির সূত্রে পাওয়া। ষাটের দশকের মাঝামাঝির দিকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। এ সময়ে মণি সিংহের দেওয়া রাজনৈতিক নাম ‘রায়হান’ গ্রহণ করে হয়ে যান জহির রায়হান। তার বাবার নাম মোহাম্মদ এমদাদউল্লাহ এবং মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। বাবা ছিলেন আইন ব্যবসায়ী। রাজনৈতিক নানা অস্থিরতা জহির রায়হানকে নাড়া দিত। ছাত্রজীবনে রাজনৈতিক কারণে একাধিকবার জেলে গেছেন। তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলা চলচ্চিত্রে খুব অল্প কিছু মেধাবী মানুষের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, যারা মরে গিয়েও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন। জহির রায়হান তেমনই একজন। তার চলচ্চিত্রগুলো এখনো বিশাল একটা জায়গা জুড়ে আছে বাঙালির মনে। আর তার কিছু লেখা অমর হয়ে আছে। তার একটি কালজয়ী উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’। পরে এ উপন্যাসটির চলচ্চিত্রায়ন করেন তারই সহধর্মিণী অভিনেত্রী কোহিনূর আকতার সুচন্দা। জহির রায়হানের প্রথম স্ত্রী অভিনেত্রী সুমিতা দেবী। প্রয়াত এ অভিনেত্রীর দুই ছেলে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। দুজনই নাট্যনির্মাতা। স্ত্রী সুচন্দার ছেলে তপু রায়হানও অভিনেতা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগৎ ও জীবনমুখী সাহিত্যধারায় জহির রায়হানের অবদান অনবদ্য। তার খ্যাতি চলচ্চিত্রের জন্য হলেও শুরুটা কথাসাহিত্যিক হিসেবে। তিনি চলচ্চিত্রজগতে পা রাখেন ১৯৫৭ সালে। নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’। এ ছাড়া ‘বাহানা’, ‘বেহুলা’, ‘আনোয়ারা’, ‘জীবন থেকে নেয়া’ তার নির্মিত কয়েকটি আলোচিত চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত ২০ মিনিট দৈর্ঘ্যের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ দেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। তার সাংবাদিক জীবন শুরু হয় ১৯৫০ সালে। ‘যুগের আলো’ পত্রিকায়। পরে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে ‘প্রবাহ’ নামে একটি পত্রিকায় যোগ দেন। তার প্রথম গল্প ‘সূর্যগ্রহণ’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। এ ছাড়া রয়েছে শেষ বিকেলের মেয়ে, আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী, আর কতদিন, তৃষ্ণা ইত্যাদি। জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস ১৯৬৪ সালে ‘আদমজী পুরস্কার’ পায়। তিনি ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ’৭৭-এ মরণোত্তর একুশে পদক এবং ’৯২-এ মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন।