ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো/ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো/ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা/ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা...। এভাবেই বাংলার প্রকৃতি আর প্রাণের প্রতি ভালোবাসা জানিয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। সেই আকাঙ্ক্ষায় ছিল শান্তি ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ। সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়তে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সোচ্চার ছিল তার কলম।
বাংলা সাহিত্যের বহুমাত্রিক লেখক অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল মুন্সীগঞ্জের রাঢ়িখাল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবদুর রাশেদ এবং মাতা ছিলেন জোবেদা খাতুন। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন অধ্যাপনা পেশায়। গবেষক ও প্রাবন্ধিক হুমায়ুন আজাদ নব্বইয়ের দশকে প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন। ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক ও কিশোর সাহিত্যিক। ৭০টির বেশি বই লিখেছেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই সৃষ্টি করেছেন ভিন্ন এক ধারা। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় তার আলোচিত বই ‘নারী’ (নিষিদ্ধ ১৯৯৫)। এ গ্রন্থ প্রকাশের পর ধর্মীয় মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের রোষানলে পড়েন তিনি। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। ছাত্রজীবনে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। তিনি ১৯৬২ সালে রাঢ়িখাল স্যার জে সি বোস ইনস্টিটিউশন থেকে পাকিস্তানের মধ্যে ১৮তম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৬৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। উভয় ক্ষেত্রে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো—জ্বলো চিতাবাঘ, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে, যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল, আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে। হুমায়ুন আজাদের অন্যান্য বইয়ের মধ্যে অলৌকিক ইস্টিমার, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল, সবকিছু ভেঙে পড়ে, রাজনীতিবিদগণ, একটি খুনের স্বপ্ন, পাক সার জমিন সাদ বাদ, রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা, প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে, আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র, বাঙলা ভাষা (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), লাল নীল দীপাবলি, ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না অন্যতম। বাংলা সাহিত্যে প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে হুমায়ুন আজাদ যোগ করেন এক ভিন্ন মাত্রা। তার সব বই, প্রবন্ধ, কবিতা সৃষ্টি হয়েছে প্রথাকে অস্বীকার করে। তার প্রবচনগুচ্ছ এ দেশের যুক্তিবাদী পাঠকসমাজকে আরও সচেতন হতে অনুপ্রেরণা দেয়। সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং প্রতিষ্ঠিত প্রায় সবকিছু নিয়ে যুক্তিনির্ভর বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে তিনি এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন, যার ফলে তিনি যেমন নন্দিত হয়েছেন, আবার হয়েছেন নিন্দিত। ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ নামে উপন্যাস লিখে রোষানলে পড়েন স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদীদের। শিকার হন নৃশংস জঙ্গি হামলার।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, অগ্রণী শিশু-সাহিত্য পুরস্কার ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার। ২০১২ সালে পান মরণোত্তর একুশে পদক। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি হুমায়ুন আজাদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়। একই বছরের ১২ আগস্ট জার্মানির মিউনিখ শহরে তিনি মারা যান।