৮৪ বছর বয়সী নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস মানুষ পুরাতন। সরকারপ্রধানের অভিযাত্রায় নতুন। তবে, পথঘাট তার অচেনা নয়, বরং ভালোমতো চেনাজানা। ১৯৯৬ সালে প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। নোবেল পান আরও অনেক পরে। এরপর ওয়ান ইলেভেন আমলেও প্রধান উপদেষ্টা হতে অনেক পীড়াপীড়ি করা হয় তাকে। নানা কারণে রাজি করানো যায়নি। কারা তাকে এ কাজে রাজি করাতে দিনের পর দিন আঠার মতো লেগে থেকেছেন, পরবর্তীকালে ড. ইউনূস নামধামসহ সবই জানিয়েছেন। কেন তখন রাজি হননি, তাও প্রকাশ করেছেন।
এবার ছাত্র আন্দোলনকারীরা তাকে অনলাইনে ধরেছেন আর তিনি এতে রাজি হয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে ফ্রান্স থেকে উড়ে এসে রাতে শপথ নিয়ে ফেলেছেন—ব্যাপারটি এত সরলীকরণের নয়। তিনি এবার জেনে এবং বুঝেশুনেই এ অভিযাত্রায় পা দিয়েছেন। হোমওয়ার্কও অবশ্যই করেছেন। এই আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বকে স্থানিকে নামিয়ে বাঙালপনা কম হয়নি। শুধু বদনাম নয়, শত-শত মামলা-মোকদ্দমায় নাস্তানাবুদের একটু্ও বাকি রাখা হয়নি। দেশবিরোধী বলে প্রচার চলেছে। ডক্টর ইউনূস কোন রোগের ডাক্তার? গরুর ডাক্তার?—এ ধরনের অপমানজনক প্রশ্ন ছোড়া হয়েছে ক্ষমতায় থাকা দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে। টুপ করে পদ্মা নদীতে চুবানো-ডুবানোর অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করা হয়েছে। এই দুষ্ট লোকটিকেই আদালতের অনুমতি নিয়ে অলিম্পিক আয়োজনে প্যারিস যেতে হয়েছে। ফিরে এসে তিনিই রাজবেশে সরকারপ্রধান। জোয়ার-ভাটার বাংলাদেশের রাজনীতিকসহ বিভিন্ন মহলের অভিভাবক।
দেশের তরুণরাজদের ভরসার বাইরে বিদেশে তার বিস্তার ব্যাপক। তার নেতৃত্বাধীন সরকারকে শপথ অনুষ্ঠানের আগেই স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে আগাম আশা প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদমর্যাদার কূটনীতিক হেলেন লা ফাভে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে জানানো হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে। পাশাপাশি ঢাকায় ইইউর মিশনগুলোর রাষ্ট্রদূতরা সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর উপাসনালয় এবং লোকজনের ওপর হামলার খবরে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন। আবার সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় নেওয়া উদ্যোগকেও স্বাগত জানিয়েছেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ায় অধ্যাপক ড. ইউনূসকে অভিনন্দন জানাতে একটু্ও দেরি করেননি প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গত বৃহস্পতিবার রাতে ড. ইউনূসের শপথের পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে শুভেচ্ছা-অভিনন্দন জানানোর কাজটি সারেন মোদি। সেইসঙ্গে জানান, হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করে বাংলাদেশের স্বাভাবিক অবস্থায় দ্রুত ফিরে আসার আশাবাদ।
আন্তর্জাতিক এসব আশাবাদ ও শুভেচ্ছার মাজেজা অবশ্যই ড. ইউনূসের ষোলো আনা রপ্ত করা। দেশের চেয়ে বিদেশে তার যশ-খ্যাতি বেশি। আবার দেশের রোগও তার জানা। সামনে এখন রোগ সারানোর দাওয়াই পর্ব। কোন ওষুধে রোগ সারাবেন সেটিও তার বিষয়। এ বিষয়ক কিছু ধারণা তিনি দিয়েছেন দেশে ফিরে শপথের আগের দিনের মধ্যভাগেই। তার সমর্থকদের উদ্দেশ্য করে বিমানবন্দরে স্পষ্ট করে বলেছেন, তার কথা না শুনলে যেন তাকে আগেই মানা করে দেওয়া হয়। তাকে সমর্থন করলে তার কথা শুনতে হবে। না শুনলে, নৈরাজ্য করলে তিনি মনে করবেন, তার আসলে প্রয়োজন নেই।
ইউনূসের এই অল্প কয়েক কথায় হাজারো মানে। দিনটি ছিল বারে বৃহস্পতি। রাশি ও দিনচক্রে বৃহস্পতিকে বলা হয় শুভদিন। শনি কেটে কারও বৃহস্পতি তুঙ্গে উঠলে কেবল মঙ্গল ধরা দেয়। এটি রাশিচক্রের কথা। কিন্তু রাজনীতি-দেশ-শাসক-প্রশাসকসহ কিছু ক্ষেত্রে তা সবসময় খাটে না। ইউনূস এখন কেবল শাসক-প্রশাসক নন, রাজনীতিকেরও রাজনীতিকের আসনে। তার ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাহানা বা কথার ছলের কল বসানোরও দরজা নেই। মুখে নানা তাত্ত্বিক কথা আওড়ালেও রাজনীতি বাস্তবে মোটেই ভলান্টারি বা চ্যারিটি কাজ নয়। এই পথ বড় বন্ধুর-ভঙ্গুর। ইউনূসের জন্য আরও বেশি কিছু। তার কাছে প্রত্যাশা অনেক। প্রশাসনসহ নানা সেক্টরে পদে পদে রোগবিমারিতে ভরা। এই চিকিৎসার দায়িত্ব তারই। অন্য কাউকে দেখিয়ে বা ভেবে দেখা হচ্ছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না—টাইপের কথা বলে নিজের নিস্তার খোঁজার সুযোগ নেই। বিমানবন্দরে বলা কথায় বোধগম্য তিনি রোগ ধরেছেন ঠিকমতোই। আবার সব রোগ একসঙ্গে এক মেডিসিন বা সার্জারিতে সারিয়ে ফেলবেন, সেই বাস্তবতাও নেই। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এমনকি ভারতের অভিনন্দনের মধ্যে আশাবাদ বা প্রত্যাশার মধ্যে রোগের দিকে কূটনৈতিক ইঙ্গিত করাই আছে।
গণতন্ত্র-সুশাসন থাকলে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা আসত না। পেতে হতো না সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের কূটনৈতিক তাগাদাপত্র। কূটনৈতিক ভাষার এ প্যাঁচ অন্য অনেকের চেয়ে অবশ্যই ড. ইউনূসের বেশি জানা। তার সামনে চাই আর চাই-এর ফিরিস্তি। সংখ্যালঘুবান্ধব পরিবেশ চাই, সুষ্ঠু নির্বাচন চাই, রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চাই, ঘুষমুক্ত সরকারি সেবা চাই, সিন্ডিকেটমুক্ত বাজার চাই, নকলমুক্ত, প্রশ্ন ফাঁসমুক্ত পরীক্ষা চাই—এমন শত শত চাই আর চাই। এত চাই আর চাই-এর মধ্যে কোনটা আগে, কোনটা পরে নাকি সব একসঙ্গে; তা ঠিক করতে হবে তাকেই ও তার পারিষদকে। তাকে নিশ্চয়ই বাইরের কারও বুঝিয়ে দিতে হবে না কেন, কীভাবে, কোন রোগে আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন-বনেদি দলটির এমন অবিশ্বাস্য পতন হয়েছে? শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাতের পর কেন তার এত চাহিদা হয়েছে? এর নেপথ্যে কারা?
অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালনা হচ্ছে বেসামরিক নেতৃত্বে। কন্ট্রোলিং বডি কোথায়? আর তার নিজের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব কোথায়? কোন গুণে তিনি এতদূর এসেছেন? চট্টগ্রামের অজপাড়াগাঁয়ে জন্মে কীভাবে কেবল নোবেল জয় নয়, আন্তর্জাতিক মণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছে তার জ্যোতি? পতিত সরকারটি তাকে নাজেহাল করতে গিয়ে নিজেই চুবেছে-ডুবেছে তা বেশি জানেন ভুক্তভোগী ড. ইউনূসই। সে ক্ষেত্রে তার নিজেকে নিজের আরেকবার আবিষ্কার ও পেরিয়ে আসা দিনগুলো রিক্যাপ বা স্মরণ করার প্রধান দায়িত্ব তার নিজেরই। পৃথিবীতে সাতজন মাত্র ব্যক্তি আছেন যারা একসঙ্গে নোবেল, আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাওয়ার্ড আর কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল—এ তিনটি পুরস্কার পেয়েছেন; নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং, মাদার তেরেসাসহ কয়েকজন। সেখানে সপ্তম ব্যক্তিটি ড. ইউনূস।
আন্তর্জাতিক এত অর্জন স্মরণের সঙ্গে বাংলাদেশ ও দেশটির মানুষের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য, চাহিদা-জোগানের বাস্তবতাও আমলে নেওয়ার বিষয় আছে। আজব-আচানকের মতো গণভবনে ঢুকে লুট-চুরির দৃষ্টান্ত এখানে আছে। আবার রয়েছে লুটের সেই মাল ফেরত ও উদ্ধারের মহানুভব দৃষ্টান্তও। আন্দোলন করে সফল হলো ছাত্ররা আর তাদের সাইজ করে খবরদারি কায়েম হচ্ছে কাদের—এ প্রশ্ন তোলা লোক আছে। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দুই শিক্ষার্থীকে উপদেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে ওই মহলেরই প্রশ্ন—শিশু-কিশোর দিয়ে সরকার গঠন করা হলো কেন? দেশ চালানো এত সোজা? এ ধরনের সব প্রশ্নেরই যুক্তি বড় কড়া। তারপরও কাউকে না কাউকে সামনে রেখে স্বপ্ন দেখা। স্বপ্ন না থাকলে বাঁচাই নিরর্থক। এবার প্যারিস অলিম্পিকে অবদানের জন্য প্যারিসে একটা স্কয়ারের নামকরণ হয়েছে ড. ইউনূসের নামে। মিরপুরে গ্রামীণ ব্যাংকের ২১ তলা ভবনটার চারতলায় বসতেন তিনি। লিফট ব্যবহার করতেন না। হেঁটে উঠতেন, হেঁটে নামতেন। কোনো ফাইল আগামীকালের জন্য টেবিলে ফেলে রাখার নজির তার নেই। তার রুমে এয়ার কন্ডিশনার ছিল না। এই রুমে কত দেশের প্রেসিডেন্ট, রাজা-রানি, রাষ্ট্রদূত, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট এসে গেছেন, সবাইকে সিলিং ফ্যানের বাতাস খাইয়ে দিয়েছেন। নিজের জন্য ছিল একটা শক্ত কাঠের টেবিল আর শক্ত কাঠের চেয়ার। আসবাবপত্রের মধ্যে ছিল একটা বুকশেলফ।
গ্রামীণ চেকের পোশাক পরেন এখনো। পঞ্চাশের বেশি কোম্পানি বানিয়েছেন বাংলাদেশে, কোথাও ওনার এক পয়সার শেয়ার নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে একটা বেতন পেতেন। গ্রামীণ ব্যাংকের লভ্যাংশের কোনো টাকা ওনার পকেটে ঢোকে না। গ্রামীণফোনেরও না। অন্য কোনো কোম্পানিরও না। তবে বিদেশে এক-একটা বক্তৃতা থেকে অনেক পয়সা ঢোকার কথা। একসময় বলা হতো, বিল ক্লিনটন হচ্ছেন পৃথিবীতে সবচেয়ে দামি স্পিকার। দ্বিতীয় দামি স্পিকারটি ড. ইউনূস। বিশ্বব্যাংক-জাতিসংঘ থেকে শুরু করে ৩৫টির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার উপদেষ্টা কমিটিতে থাকার রেকর্ড তারই। এ যাবৎ ৬০টিরও বেশি অনারারি ডক্টরেট পেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি। উইকিপিডিয়াতে একটা অসম্পূর্ণ তালিকা রয়েছে। ১৩০টির [৩]। জাপান থেকে পেয়েছেন চারটি। সংখ্যা বলছে—জীবদ্দশায় এত পুরস্কার এই ধরাতলে আর কারও ভাগ্যে জোটেনি।
১৯৫৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহটির অর্ধেকের চেয়ে বেশি চষে বেড়িয়েছেন ড. ইউনূস। তাদের টিমে ছিল ২৭ জন বয়স্কাউট। যাওয়ার সময় প্লেনে গেলেন কানাডায় একটা জাম্বুরিতে অংশ নিতে। হিসাব করে দেখলেন, প্লেনের টিকিটের চেয়ে তিনটি মাইক্রোবাস কিনে ড্রাইভ করে ফিরে আসা অনেক সস্তা। আর যা অভিজ্ঞতা হবে সে কি আর টাকায় কেনা যাবে? আসার সময় কানাডা থেকে জাহাজে করে ইউরোপ। জার্মানি থেকে তিনটি মাইক্রোবাস কিনে সেই মাইক্রোবাস চালিয়ে ৪ মাস ১১ দিনে অস্ট্রিয়া, গ্রিস, তুরস্ক, ইরান তুরান পাড়ি দিয়ে দেশে ফেরেন। বৃহস্পতিবার ফিরলেন আকাশপথে। বঙ্গভবনে গেলেন-এলেন সড়কপথে। যে পথের কোথাও কোথাও রক্তের দাগ লেগে আছে এখনো।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন