গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। প্রথম তিনটি স্তম্ভ—আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগ। তবে সরাসরি সরকারের অংশ না হয়েও গুরুত্ব বিবেচনায় চতুর্থটি অন্যতম। প্রথম তিনটিকে জনগণের পক্ষ থেকে ওয়াচডগ হিসেবে পাহারা দিতে হয় গণমাধ্যমকে। সারা বিশ্বে গণমাধ্যমের এ ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। বিখ্যাত মার্কিন দার্শনিক নোয়াম চমস্কি বলেছেন, ‘আমরা যদি আমাদের অপছন্দের মানুষদের বাকস্বাধীনতা না দিতে জানি, তবে ধরে নিতে হবে আমরা বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি না।’ তিনিই আবার মনে করেন, ক্ষমতাসীন বা বিত্তশালীরা নিজেদের সম্পদ পাহারায় আগে কুকুর পুষত এখন মিডিয়া বানায়। বাংলাদেশে গত দেড় দশকে অন্যান্য সেক্টরের মতো গণমাধ্যমেও নেতৃত্বের চরম অবনমন ঘটেছে। তাদের ক্ষমতার অপব্যবহারে দেশের মিডিয়া প্রায় গণশত্রুতে পরিণত হয়েছিল। সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের সাংঘাতিক বলে উপহাস করছিল। তেলবাজ, গদিমিডিয়া, সূর্যমুখী সাংবাদিকতা নানা বিশেষণে গণমাধ্যমের মর্যাদা হারাতে বসেছে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের পদত্যাগের ফলে চাপমুক্ত হয়ে গণমাধ্যম হয়তো তার হারানো ঐতিহ্য আবার ফিরে পাবে। তবে এর কার্যকারণ বিশ্লেষেণের অবশ্যই দাবি রাখে।
পক্ষে খবর প্রকাশিত হলে বলবে, আরেকটু লিখলে আরও ভালো হতো। আর বিপক্ষে গেলে তো কথাই নেই। এ ব্যাপারে কাঙ্গাল হরিনাথ থেকে ডিজিটাল সম্পাদক পর্যন্ত—একইরকম ফিডপ্যাক পেয়ে আসছে গণমাধ্যম। তবে নিজস্ব নীতিমালায় পরিচালিত বেসরকারি গনমাধ্যমগুলো বিভিন্ন সময় এককভাবে মান-অপমানের ভাগীদার হয়। জনস্বার্থে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, দৃষ্টির আড়াল থেকে স্মরণীয়-বরণীয় কোনো ঘটনা, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে তুলে আনার খবরে ভালোবাসা পায়। সংশ্লিষ্ট মিডিয়াকে মানুষ সম্মান এবং বিশ্বাস করে। আবার কোনো খবরের জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রুষ্ট হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে লিখিত প্রতিবাদ, মামলা, হুমকি, লাঞ্ছনা বা নির্যাতনের শিকার হয় ওই প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক। এ ছাড়া নিজেদের জন্য ক্ষতিকর ভেবে অনেক সময় সরকার, প্রভাবশালী ব্যক্তি, অপরাধী চক্র, কোনো কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও ক্ষুব্ধ হয় গণমাধ্যমের ওপর। এসব মেনেই সাংবাদিকরা যুগের পর যুগ কাজ করে আসছেন। দিনশেষে ছাপার অক্ষরে বা ভার্চুয়ালি তার কাজ দৃশ্যমান হলে তৃপ্তি পান। ভোক্তাদের ধন্যবাদ পেলে নিজেকে ধন্য মনে করেন। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, গণমাধ্যমের ওপর দেশের অনেক মানুষ ক্ষুব্ধ। কোথাও কোথাও ক্ষোভের প্রকাশ ঘটছে সহিংসতায়। বিক্ষুব্ধের তালিকায় রয়েছে সরকার, ক্ষমতাসীন, বিরোধী রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, ব্যবসায়ী; এমনকি শিক্ষার্থীও। কিন্তু কেন?
একজন মন্ত্রী মনে করেন, সেতু উদ্বোধনের সংবাদটি তার ছবিসহ বড় আকারে ছাপা হবে বা দেখাতে হবে। সংশ্লিষ্ট জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) এ আদেশ বাস্তবায়নে সাংবাদিক বশীকরণে নানা উদ্যোগ নেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনৈতিক পথেও হাত বাড়ান। তারপরও সৌজন্যতা বজায় রেখে কেউ কেউ সম্পর্ক ধরে রাখেন। নিউজ সোর্স হওয়ায় তাদের উপেক্ষা করা কঠিন সাংবাদিকদের জন্য। নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয় সোর্সের সঙ্গে। কিন্তু এর মধ্যে কোনো কোনো সংবাদকর্মী অতি উৎসাহ নিয়ে পিআরওর দায়িত্ব বাস্তবায়নের ঠিকাদারি নেন। দুপয়সা কামাতে নিজে এবং অন্যদের সঙ্গে নিয়ে পেশার মর্যাদা ডুবান। এ কাজটি অনেকে স্মার্টলি করে দুপয়সার মুখ দেখছেন। এতে করে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সাংবাদিকরা মুখ লুকাচ্ছেন। এটি একটি সামান্য উদাহরণমাত্র। শুধু মন্ত্রী নয়, প্রভাবশালী আমলা, পরাক্রমশীল নিরাপত্তা কর্মকর্তা, সর্বগ্রাসী ব্যবসায়ী সবার জনসংযোগ ব্যবস্থা এখন মিডিয়া প্রচারণায় অব্যর্থ ভূমিকা রাখছে। তারা মনে করছেন, সুলভে কেনা যায় সাংবাদিকতা।
আবার উদাহরণে ফিরে যাওয়া যাক। এখানে প্রকৃত সাংবাদিকতা হচ্ছে সেতু নির্মাণে কোনো দুর্নীতি হয়েছে কি না? যেমন—টেন্ডারব্যবস্থা স্বচ্ছ কি না, নির্মাণ ব্যয় কত, আর্থিক বরাদ্দ ও সময় কতবার বাড়ানো হয়েছে, কাজের মান কেমন, ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে কি না ইত্যাদি? এমনকি সেতুটি আদৌ বানানোর দরকার ছিল কি না? দেশের জন্য সাধারণ মানুষের অধিকার নিশ্চিতে এই প্রশ্ন প্রতিনিয়ত করে যেতে হয় সাংবাদিককে। যে প্রশ্ন বাদ দিয়ে প্রশংসা রপ্ত করে, সে সাংবাদিকতার নামে ‘সংবাদিতা’ করে। এটা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সংবাদ জলসা থেকে বিভিন্ন দোকান/সমিতির সংবাদ সম্মেলনে আকসার ঘটছে।
আর এ প্রবণতা (ট্রেন্ড) ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের সাংবাদিকদের মধ্যে। প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার শর্টকাট এ লাইনে এরই মধ্যে সাংবাদিকদের দ্বিতীয় প্রজন্ম তৈরি হয়ে গেছে। আনুগত্য বিবেচনায় অবস্থান অনুযায়ী তাদের মধ্যে এমপি পদে মনোনয়ন, টেলিভিশনের লাইসেন্স, পত্রিকার ডিক্লারেশন, লোভনীয় পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, প্রকল্পে অংশীদারত্ব, মূল্যবান প্লট বিতরণ করা হয়। এমনকি কোটা অনুযায়ী জমকালো পার্টি, বর্ণাঢ্য ট্যুর, দুস্থ ভাতা ভাগাভাগি করা হয় তাদের মধ্যে। এসব ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ছায়ামানবরা সাংবাদিকদের প্রতি যথেষ্ট করুণা দেখিয়ে থাকেন। পরিকল্পনামাফিক সাজানো ঘটনাগুলো ছড়িয়ে পড়ে নানা রং-ঢঙে। কেউ কেউ প্রথম প্রথম শুনে জনপ্রিয় গুজব মনে করে। তবে টকশোতে সুবিধাভোগী সাংবাদিক ব্যক্তিত্বের তোষণমূলক বক্তব্য দেখেশুনে আর সাধারণ মানুষের কাছে আজব মনে হয় না। যে কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দায়হীন অনানুষ্ঠানিক তথ্যের প্রতি আগ্রহ বাড়ে তাদের। ‘আগে মানুষ মিথ্যা বলত, মিডিয়া সত্য তুলে ধরত। এখন মিডিয়া মিথ্যা বলে, মানুষ সত্য খোঁজে’—এরকম বাণী খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মিডিয়ার নীতিনির্ধারকদের অনুগত মানসিকতার কারণে মাঠের সাংবাদিকরা প্রায়ই জনগণের কাছে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে।
এ পরিস্থিতি দৃশ্যমান হয় কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটলে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, বিক্ষোভ সমাবেশ বা বড় ধরনের দুর্ঘটনার খবর সংগ্রহের সময় নানারকম প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় রিপোর্টারদের। বিশেষ করে বিরোধীমতের সমাবেশের সংবাদ সংগ্রহের সময়। গণমাধ্যম যদি স্বাধীন না হয়, তাদের নীতি যদি সরকারঘেঁষা হয়, সেটির খেসারত দিতে হয় সংবাদকর্মীদের। পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেক সময় সচেতন নেতাকর্মীরা মিডিয়া কর্মীদের কর্ডন করে নিরাপত্তাও দিয়ে থাকেন। বিক্ষুব্ধরা অনেক সময় বুঝতে চান না মাঠের রিপোর্টারদের সীমাবদ্ধতা। তারা ভুলে যান, যতটুকু তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবাদী হয়েছেন, সেটুকুও মিডিয়া থেকে পেয়েছেন। আসলে মিডিয়ার কোনো বন্ধু নেই। থাকতে নেই। চাওয়াও ঠিক না। বন্ধুত্বের বন্ধনে জড়ালে কাজটি ঠিকমতো হয় না। গোষ্ঠী স্বার্থ মেনে চললে সঠিক সাংবাদিকতা হয় না।
উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড আর ইতিবাচক দিক প্রচারে কলাম লেখানোর উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। গত বছরের মাঝামাঝি এরকম সংবাদ প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্রিকায়। খবরটি শুনে কেউ কেউ মুখ লুকিয়ে হাসলেও উদ্যোগটি নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সরকারের আমলে এরকম কলাম পড়তে বাধ্য হয় পাঠক। এর মধ্যে সুলেখকও আছেন অনেক। তাদের লেখা সুপাঠ্য ও দামি। বিশেষ উদ্দেশে লেখা জেনেও পাঠক পড়েন। সরকার বিবেচনায় ওইসব কলামনিস্ট একাধিক নামে লিখে থাকেন। সময়ের প্রয়োজনে ‘ছুম্মা আমিন’ থেকে হয়তো হয়ে যান ‘রাসেল আমিন’। বিভিন্ন দেশে শিল্প-সাহিত্য-সাংবাদিকতা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে। এটা দোষের কিছু নয়। তবে এর গুণমান এবং জনসম্পৃক্ততা কতটুকু তা বিবেচনায় নেয় জনগণ। সেভাবেই তৈরি হয় ধারণা (পারসেপশন)। কোনো বিষয়ে ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেলে অনেক সময় বাস্তবতা (রিয়ালিটি) ভুলে যায় সাধারণ মানুষ। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে অনেক কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সাংবাদিক রাষ্ট্রীয় নানা সুবিধা নিয়েছেন। কিন্তু জাতীয় অসুবিধার কথা ভেবে তাদের বেশিরভাগই বিকল্প নীতি গ্রহণ করেছেন। বাড়ি বানানোর জন্য প্লট বরাদ্দ পেলেও, সৃষ্টিশীল চিন্তা বন্ধক রাখেননি। অনুদানকে অবদানের স্বীকৃতি মনে করেছেন তারা। অনেক চেষ্টার পরও জনগণের মৌলিক অধিকার পরিপন্থি কোনো ‘সুশীল সিন্ডিকেট’ দাঁড়াতে পারেনি সে সময়। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবিদার সরকারের আমলে গৃহপালিত সাংবাদিকতার বাম্পার ফলন দেখতে হলো। দেশের সাংবাদিকদের অন্যতম কষ্টের জায়গা ‘সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড’। বছরের পর সে মামলার তদন্ত শেষ হয় না। ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী বড় বড় সাংবাদিক নেতা সে প্রশ্নের জবাব চান না। বিনিময়ে নানা পারিতোষিক পেয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। তারা ব্যস্ত থেকেছেন সরকারের উন্নয়নের প্রোপাগান্ডা নিয়ে। মাননীয়কে নিয়ে বিকল্পহীনার মিথ রচনা করেছেন তারা। দিনের পর দিন মেধার অপচয় করেছেন স্বেচ্ছা কেরানির মতো।
অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে কোনো কিছু চাপিয়ে রাখা কঠিন। যে কারণে গণমাধ্যমের আধুনিক কনসেপ্ট হচ্ছে—‘চাপানোর চেয়ে ছাপানো ভালো’। তথ্যপ্রবাহে বাধা দিলে নানা ধরনের গুজব ডালপালা মেলে। সেটা আর সামাল দেওয়া যায় না। এ কথা জেনেও শাসকশ্রেণি সনাতনী প্রক্রিয়া গ্রহণ করে এবং পৌরাণিক ট্র্যাজেডি বরণ করে।
লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা