সুভাষ সিংহ রায়
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৪, ০৩:১৮ এএম
আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২৪, ০৮:১০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যা দেখি যা শুনি

জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ: অনেক কঠিন কাজ

জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ: অনেক কঠিন কাজ

শিরোনাম লেখার প্রথমেই মনে পড়ছে জাতীয় কবি কাজী নজরুলের কবিতার একটা লাইন—‘এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!’ অস্থির সময়কে আরও অস্থির করতে নানা ধরনের উসকানি লক্ষ করা যাচ্ছে। এমন সময়ে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। ইদানীং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর একটা কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ চাউর হয়েছে—‘নীল নদের পানি যেমন নীল না, জামায়াতে ইসলামী মানে ইসলাম না।’ ১৯৭২ সালের ‘দালাল আদেশ’, ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে কার্যকর হওয়ার আইনি নির্দেশনা থাকায় দেশব্যাপী ‘দালাল আটক’ অভিযান শুরু হয় এবং ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির ৩৭ হাজার ৪৭১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ২৬ হাজার ৮৩৫ জনকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে আটক করা হয়। এতসব আইনগত বিধান, ছাড় ও ক্ষমতা দেওয়া সত্ত্বেও গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ২ হাজার ৮৪৮টি মামলার নিষ্পত্তি হয়। দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছিল ৭৫২ জন। এর মধ্যে ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনের ইতিহাস সবার জানা। ১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল জাতীয় সংসদে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এক দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছিলেন। তখনকার স্পিকার বারবার মাইক বন্ধ করে দিচ্ছিলেন, তবুও তিনি বক্তব্য থেকে সরে আসেননি। সেই ভাষণের কয়েকটা লাইন লেখার এই পরিসরে সংযুক্ত করা যাক:

“মাননীয় স্পিকার,

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় ৩৭ হাজার দালাল বন্দি হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১১ হাজার দালাল তখনও বন্দি ছিল এবং তাদের বিচার কাজ চলছিল। এর মধ্যে অনেক বন্দি সাজাপ্রাপ্ত ছিল। পরবর্তীকালে আমরা দেখেছি, এইসব সাজাপ্রাপ্ত বন্দি এই স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর পদও অলংকৃত করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য তো বঙ্গবন্ধু অ্যাক্ট করে রেখেছিলেন, সেটা হলো Act XIX Of 1973 (আন্তর্জাতিক ক্রাইম অ্যাক্ট) এবং সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বিধান রয়েছে যে এদের বিচার করা যাবে। যারা যুদ্ধাপরাধী, বিশেষ করে যারা গণহত্যা চালিয়েছে, যারা লুটতরাজ করেছে, যারা নারী ধর্ষণ করেছে, যারা অগ্নিসংযোগ করেছে, তাদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল আইন জারি করা হয় P.O. No. VIII of 1972. ১৯৭২ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি স্ব-স্ব জেলা কোর্টে অধ্যাপক গোলাম আযম গংদের হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১৫ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন জারি করা হয়— P.O. No. 149 of 1972. ১৯৭৩ সালের ১৮ই এপ্রিল গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গোলাম আযম গংদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ মোতাবেক ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা রহিত করা হয় এবং ৬৬ ও ১২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দালালদের ভোটাধিকার ও সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার বাতিল করা হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০শে নভেম্বর বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীদের আমি আগেই বলেছি, যারা গণহত্যা করেছে, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করেছে, সেসব অপরাধীকে ক্ষমা করা হয়নি। এই আইনগুলো বঙ্গবন্ধু করেছিলেন।

মাননীয় স্পিকার,

১৯৭৫ সালের ৩১শে ডিসেম্বর ‘দালাল আইন’ বাতিল করা হয়— Ordinance No. 63 of 1975. এরপরে ১৯৭৫ সালের ৩১শে ডিসেম্বর Second Proclamation Order No. 3 of 1975 প্রথম তপশিল থেকে বাংলাদেশ দালাল আইনের যে সেফগার্ড ছিল, তা তুলে দেওয়া হয়। এরপর ১৯৭৬ সালে Second Proclamation Order No. 3 of 1976 জারি করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাদি তুলে দেওয়া হয়। Second Proclamation (ঘোষণা) জারি করে সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে দালালদের ভোটার হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। Proclamation Order No. 1 of 1977 জারি করে সংসদে নির্বাচিত হওয়ার লক্ষ্যে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের কিছু অংশ তুলে দেওয়া হয়। ১৯৭৬ সালের ১৮ই জানুয়ারি নাগরিকত্ব ফেরত পাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় হতে আবেদন করতে বলা হয় এবং Proclamation Order No. 1 of 1977 দ্বারা সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ তুলে দেওয়া হয়। এখানে আমি একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, মাননীয় স্পিকার, এসব কিছুই করা হয়েছিল কোনো সংসদের মাধ্যমে নয়; বরং মার্শাল ল অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না জামায়াত এবং এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির (যার পূর্ব নাম ছাত্র সংঘ), বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধও করে তারা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত প্যারা-মিলিশিয়া বাহিনী আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয় জামায়াত ও শিবিরের (তৎকালীন ছাত্র সংঘ) নেতাকর্মীরা। যুদ্ধাপরাধ বিচারের রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে সাংগঠনিকভাবে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ সংগঠন ছিল। তবে জিয়াউর রহমান জামায়াত-শিবিরকে পুনরুজ্জীবিত করেন। একাত্তরের খুন-ধর্ষণ-লুটপাটের জন্য জামায়াত কখনো ক্ষমা চায়নি। উল্টো পাকিস্তানই ভালো ছিল কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্থহীন—এ ধরনের প্রচারণা চালিয়েছে। এবারের ছাত্র-আন্দোলনেও জামায়াত-শিবির পরিকল্পিতভাবে একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী প্রচারণা চালায়।’

দুই. বিশ্বের তৃতীয় ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন শিবির: শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতে ঘৃণিত সংগঠন জামায়াত-শিবির। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় অন্যতম ছাত্রশিবির। সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টাল এবং ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টের তালিকায় নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী বা Proscribed Terrorist/Extremist Groups-এর তালিকাভুক্ত জঙ্গি সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Global Terrorism & Insurgency Attack Index অনুসারে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে ৩ নম্বরে রয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের মতে, ‘The outfit [Islami Chhatra Shibir (ICS)] is also reported to be maintaining close links with the Inter Services Intelligence (ISI), Pakistan’s external intelligence agency. With the help of the latter, it is reportedly working to support Islamist subversive agenda in many regions in India, particularly in areas bordering Bangladesh. The ISI is also reportedly providing substantial amount of funds to the ICS. ... ... The ICS is also reported to be maintaining close links with various terrorist outfits operating in South Asia and Afghanistan. ... A significant number of them were reportedly sent to Pakistan and Afghanistan during the reign of the Taliban regime where a large number of fanatic youth come under the direct command of Osama bin Laden. ... The ICS is also part of a larger network Islamist extremist network of the HUJI, Jamaat-e-Islami, and Islami Oikyo Jote. This network has assisted the terrorist outfits in developing an effectual infrastructure for training as also a network of clandestine camps and shelters for stockpiling weapons and supplies in Bangladesh.’

ভারত-পাকিস্তানেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়। পাকিস্তানে দুবার জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়। প্রথমবার ১৯৫৮ সালে, নিষিদ্ধের আদেশে বলা হয়েছিল, জামায়াত ও দলটির নেতারা রাষ্ট্রীয় সংহতি ও ঐক্য বিনষ্টের কাজে সক্রিয় ছিল। রাষ্ট্রের শত্রুদের কাছ থেকে দলটির অর্থ নেওয়ার প্রমাণও রয়েছে। দ্বিতীয়বার ১৯৬৪ সালে নির্বাহী আদেশে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু-সরকার ধর্মীয় সব দল নিষিদ্ধ করলে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়। ভারতেও জামায়াতে ইসলামীকে একাধিকবার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জামায়াত অন্যান্য দেশে যেসব সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত, বিভিন্ন দেশে সেসব সংগঠনও নিষিদ্ধ আছে বা ছিল। জিয়া ও বিএনপি জামায়াত-শিবিরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের যে উল্টোযাত্রা শুরু হয়, তাতে পুনর্বাসিত হয় জামায়াত। জিয়া জামায়াতকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। আর খালেদা জিয়া বিএনপির হাত ধরে ক্ষমতায় বসেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেন তিনি। ২০১৩ সালে আদালতের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হলে জামায়াত নির্বাচন করতে পারেনি, সেই নির্বাচনে বিএনপিও নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এ-কথা আমরা সবাই জানি, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি অনেক পুরোনো। ১৯৭৬ সালে জামায়াতকে রাজনীতি করার অনুমতি দিলে সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ জানায় আওয়ামী লীগ। ১৯৭৮ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সরদার গোলাম আযম দেশে এলেও এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো প্রতিবাদ করে এবং সরকারের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করে। ১৯৯১ সালের বিএনপি সরকারের সময় গোলাম আযমকে জামায়াতের আমিরের দায়িত্ব দেওয়া হলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে ওঠে। সেখান থেকেও জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি ওঠে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নিলে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতের বিচারেরও দাবি ওঠে। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চেরও অন্যতম দাবি ছিল জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘একদম চুপ, কান ফাটাইয়া ফেলমু’, অধ্যক্ষকে জামায়াত কর্মী

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন

বগুড়ায় নাশকতা মামলায় যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

বিয়েতে অস্বীকৃতি, বাবার গুলিতে মেয়ে নিহত

সাত কৃষককে ধরে নিয়ে গেল সন্ত্রাসীরা, মুক্তিপণ দাবি

ছাগলকাণ্ড : সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রিমান্ডে

চীন যাচ্ছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, হবে যেসব আলোচনা

শৈশবের বন্ধুদের প্রিয় কবিতা শোনালেন মির্জা ফখরুল

পুতুল-টিউলিপসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু

পুতুলকে ‘হু’ থেকে অপসারণে অনলাইনে চলছে গণস্বাক্ষর, ব্যাপক সাড়া

১০

চটপটির দোকানে ২৩৪ কোটি টাকা ঋণ, অনুসন্ধান করবে দুদক

১১

ভুয়া আসামি দাঁড় করিয়ে জামিন, ৪ জনের নামে মামলার নির্দেশ আদালতের

১২

অত্যাধুনিক গোয়েন্দা জাহাজ নামাল ইরান

১৩

সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বৈঠক / বাংলাদেশের সঙ্গে শক্তিশালী সামরিক সম্পর্ক গড়তে চায় পাকিস্তান

১৪

পরিযায়ী পাখির মাংস বিক্রি, বন আদালতে মামলা

১৫

দুদক সংস্কারে যেসব প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন

১৬

‘পুরুষের পদোন্নতি হলে পরিশ্রমের ফল, নারীর শরীরের বিনিময়’

১৭

যুবদল নেতার বাড়িতে হামলা, গুলিবিদ্ধ হয়ে বাবার মৃত্যু

১৮

শেখ হাসিনার একান্ত সচিব জাহাঙ্গীরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

১৯

আট মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলো ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফকে

২০
X